প্রাচীন ৭ সেতু, যা ব্যবহার হচ্ছে আজো

8Angelo

ছবিঃ listverse

আমরা যখন প্রাচীন ভবনগুলোর কথা চিন্তা করি যেগুলো বর্তমান দিনে টিকে আছে,তাদের কাঠামো চিন্তা করি যেমন কলোসিয়াম,পিসার হেলানো টাওয়ারএবং পিরামিড। কিন্তু কি অবস্থা কাঠামোগুলোর যেগুলো বর্তমান দিনেও ব্যবহার হচ্ছে-তাদের প্রথম ব্যবহারের সময় থেকে আজকের দিন পর্যন্ত?

যদিও প্রাচীন কাঠামোগুলো পর্যটকদের আকর্ষণের কা্রণে পুনরায় জীবন পেয়েছে, সামান্য কিছু সেতু অক্ষুণ্ণ রয়েছে বছরের পর বছর। অনেক সেতু আছে যেগুলো আমাদের সময় থেকে কয়েক’শো বছর আগে নির্মিত হয়েছিল এবং সেগুলো এখনো প্রতিদিন ব্যবহার হচ্ছে। যদিও পুরানো সেতুগুলো প্রায়ই ধ্বংস হচ্ছে দুর্যোগে, যুদ্ধে, দুর্ঘটনায় পুড়ে-এই সেতুগুলো অপরিবর্তনীয় আছে।

খাজু সেতু

১৬৬৭ সালে একটি পুরনো সেতুর ভিত্তিতে এটি নির্মিত হয়েছিল, দ্বিতীয় শাহ্‌ আব্বাস এর নির্মাণগঠন নির্দেশ দিয়েছিলেন, এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জনসাধারনকে যায়ানদেহ নদী পার হতে, কিন্তু আরও অন্যান্য ব্যবহারও ছিল। এটা জলের বাঁধা আটকিয়ে রাখতো এবং এর স্লুইচ গেট ছিল,যদিও সামাজিক দিকই ছিল এর আকর্ষণীয় ব্যবহার।

সেতুটির সাথে এখনো আকর্ষণীয় চিত্রকর্ম এবং টালি কাজ দৃশ্যমান।একটি তাঁবু মাঝখানে নির্মাণ করা হয়েছিল যেন দ্বিতীয় শাহ্‌ আব্বাস এবং উনার সভাসদরা এর সুন্দর দৃশ্য দেখতে পারে। সেই দিনগুলোতে তাঁবুটি ছিল একটি শিক্ষণীয় ঘর এবং শিল্প গ্যালারি। এটাই যথেষ্ট নয়, তাঁবুটিতে একটি পাথরের বসার আসন ছিল যেটা দ্বিতীয় শাহ্‌ আব্বাস ব্যবহার করতেন নদীটি দেখার জন্য। আসনটি এখনো আছে কিন্তু আগের উজ্জ্বলতা নেই।

শাহারাহ সেতু

এটি ‘দীর্ঘশ্বাস সেতু’ (কিন্তু ভেনিস এর সেতুটি নয়) নামেও পরিচিত,শাহারাহ সেতুটি ইয়েমেন এ অবস্থিত। ১৭ খ্রিষ্টাব্দে এটি নির্মিত হয়েছিল,শাহারাহ সেতুতে একটি গিরিপথ আছে যা দুটি পাহাড়কে সংযুক্ত করে -জাবাল আল এমির, জাবাল আল ফাইশ। গিরিপথটির প্রসার ২২০ মিটার গভীর (৬৫০ফিট)। একজন আর একজনের সাথে দেখা করা উভয় পাহাড়ের বাসিন্দাদের জন্য অনেক কষ্টদায়ক ছিল, কারন একটি পাহাড় থেকে নিচে নামা এবং অপরটির জন্য আরোহণ করা। সেতুটি বানানো হয়েছিল উভয় পাহাড়ের গ্রামগুলোর সাথে উন্নত সংযোগ করতে যেন তাদের সময় এবং প্রচেষ্টা বাঁচে।

এটি একটি গরম জায়গা ছিল যোগাযোগের জন্য। শাহারাহ শহরের একমাত্র প্রবেশপথ ছিল, নিজেদেরকে তুর্কিশ আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য দেয়ালে ঘেরা ছিল। এটি প্রচলিত ছিল যে স্থানীয়রা জানতো গ্রামবাসীকে কিভাবে বিপদ থেকে আলাদা করা যায়- সেতুটিকে করে।
সেই দিনগুলোতে শাহারাহ সেতুটি একটি প্রধান পর্যটক আকর্ষণ ছিল,এটি এখনো একটি কার্যকারী সেতু হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে।

কেনদের সেতু

‘সেভারেন’ সেতু নামেও পরিচিত, এটি দ্বিতীয় শতাব্দীতে তুর্কিতে নির্মিত হয়েছিল, চারটি কমেগেনান শহরের দ্বারা। রোমান সম্রাট সেপ্তিমিউয়াস সেভারুস,তাঁর পত্নী জুলিয়া এবং তাদের দুই ছেলে,কারাকেল্লা ও গেতাকে সম্মানের উদ্দেশে এটি নির্মিত হয়। যদিও অনেক পুরনো তবু এটি ‘দ্বিতীয় দীর্ঘতম প্রধান সেতু’ হিসেবে রোমানদের নির্মিত স্বীকৃতপ্রাপ্ত।

প্রত্যেকপাশে দুটি করে সারি আছে যা সম্রাটের পরিবারের সদস্য নিদর্শন করে-সেভারুস এবং জুলিয়া এক পাশে,কারাকেল্লা ও গেতা অন্য পাশে।যদি তুমি নিজে এখন দেখতে যাও তাহলে লক্ষ্য করবে সেখানে বর্তমানে গেতার সারিটি অনুপস্থিত।কারণ কারাকেল্লা গেতাকে হত্যা করেছিল একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যখন গেতা তার মায়ের কাঁধে ছিল। কারাকেল্লা গেতার বন্ধু এবং জোটকে মৃত্যুমুখে ফেলে অনেক দূরে চলে যায়। কারাকেল্লা পুরোহিতকে আদেশ দেন গেতার উত্তরাধিকার নিরবচ্ছিন্ন করে ফেলতে ইতিহাস থেকে, এবং তাই সারিটি প্রদর্শন করে গেতার ধ্বংসের।

আঞ্জি সেতু

ঝাওঝো সেতু নামেও পরিচিত, আঞ্জি সেতু চীনের প্রাচীনতম সেতু ৬০৫ খৃষ্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল। এটিকে অনুবাদ করলে হয় ‘নিরাপদ পারাপার সেতু’। এটি পৃথিবীর অন্যতম পরিচালনা সেতু। ঐ সময়ে এটি অধিক প্রযুক্তিসম্পন্ন উন্নত সেতু ছিল। এর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর এটি পুরস্কার পায়। এটি আমেরিকার সিভিল ইনজিনিয়ার সমিতি দ্বারা প্রশংসিত হয়েছিল ১২তম আন্তর্জাতিক সিভিল ইনজিনিয়ারিং মাইলফলক হিসাবে এবং পুরষ্কার পায় ব্রোঞ্জ স্মৃতিচিহৃ।

এটি এখনো পারাপারের জন্য অক্ষত আছে, আকৃতির কোন পরিবর্তন হয়নি। প্রকৃতপক্ষে সেতুটি এখনো দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এটি ১০টি বন্যা,৮টি যুদ্ধ, অগণিত ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পেয়েছে,যদিও মাত্র নয়বার পুননির্মাণ করতে হয়েছে।

পন্তে সেন্ট অ্যাঞ্জেলো

১৩৬ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট হাদ্রিয়ান এর আদেশে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল,পন্তে সেন্ট অ্যাঞ্জেল (পবিত্র পরীর সেতু) রোমের একটি অন্যতম বিখ্যাত সেতু এবং অন্যতম সুন্দর।হাদ্রিয়ানের একটি ক্ষুদ্র ইচ্ছা ছিল সেতুটিকে পুরো রোমের সাথে তার সমাধিস্তম্ভে সংযুক্ত করা,সেন্ট অ্যাঞ্জেলো প্রাসাদ (পবিত্র পরীর প্রাসাদ)।তারা উভয়ে ‘পবিত্র পরী’ হিসেবে আখ্যায়িত ছিল কারন দেবতা মাইকেল এর ভাস্কর্যটি সমাধিস্তম্ভের উপরে বিদ্যমান।ধারণা করা হয় ৫৯০ খ্রিষ্টাব্দে দেবতা সেই একই ভবনটিতে এসেছিলো এবং দৈবক্রমে রোমে প্লেগ ছরিয়ে পড়ে।

দীর্ঘদিনপর সেতুটিতে একটি অন্যতম সংযজন ঘটে,হাদ্রিয়ান নিজে এর চারপাশে ঘুরে দেখতেন।১৬৬৮সালে স্কাল্পচার লরেঞ্জ বেরিনিনি ১০জন দেবতার নকশাচিত্র করে সেতুটির আকর্ষণ বাড়িয়ে ছিল, তিনি নিজেই দুটি তৈরি করেন।প্রত্যেক দেবতা যীশুর ক্রুশটির প্রতীক প্রদর্শন করে, যেমনটা কাঁটার মুকুট অথবা চাবুক।এমনকি এতবছর পরও সেতু এবং দেবতারা উভয় দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে,একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান।

টার স্টেপস

দক্ষিণ ইংল্যান্ডের টার স্টেপস যেটা পরিচিত ছিল ক্লাপার সেতু নামে,এই সেতুটি ভিতরের দিকে তৈরি ছিল পাথর দ্বারা যা অবস্থান করেছিল উপরের দিকে একটির উপর একটি।এটা কখন তৈরি হয়েছিল তা বলা কঠিন।যদিও বলা হয় এটা খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০বছর পূর্বে অথবা ৩০০০-১৫০০ খৃষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে তৈরি হয়েছিল।এটা ১৬০০ শতাব্দীতে তৈরি হয়েছিল যেটা বুঝায় এটি মূলত ১৫০০ শতাব্দীতেই তৈরি হয়েছিল।

টার স্টেপ একটি আঞ্চলিক কিংবদন্তি বর্ণনা করে।এটি শয়তান নিজে তৈরি করেছিল,কেউ যদি এটি অতিক্রম করে তাহলে তাকে মেরে ফেলবে।তখন গ্রামবাসী একটি বিড়ালকে পাঠিয়েছিল এটি অতিক্রম করতে।বিড়ালটি উধাও হয়ে গিয়েছিল।তারপর তারা একটি পাদ্রী পাঠিয়েছিল(যে সম্ভবত আগেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিল সেও বিড়ালের মত উধাও হবে) শয়তানের সাথে দেখা করতে সেতুর মাঝখানে।তখন পাদ্রী ও শয়তান একটি তর্কে উপনীত হয়েছিল।শয়তান একটি চুক্তি করেছিল,যেকেউ সেতুটি ব্যবহার করতে পারবে কিন্তু যখন সে সূর্যস্নান করবে তখন কেউ গেলে তাকে হত্যা করবে।যদি তুমি নিজে এতা অতিক্রম করো তখন নিশ্চিত হয়ে নাও শয়তান যেন সূর্যস্নান না করে।

টার স্টেপ কিছুটা ব্যতিক্রম অন্যান্য সেতুর ঐতিহ্য থেকে যেগুলো বছরের পর বছর ঠিক আছে।ঐতিহাসিকভাবে প্রস্তুতির সময় একগুচ্ছ পাথর যথেষ্ট নয়।স্তরগুলো বন্যার কারনে ভেঙ্গে গিয়েছিল।এ কারনে পাথরগুলোতে পরবর্তীতে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল এবং সেখানেই রাখা হয়েছিল যেখানে অক্ষত থাকবে।এটা এখনো প্রযুক্তিগতভাবে একই রকম আছে।

আরকাডিকো সেতু

আরকাডিকো সেতু গ্রিস এর প্রাচীনতম খিলনাকৃতসেতু,যেটি এখনো টিকে আছে,এমনকি ব্যবহার হচ্ছে।ধারনা করা হয় ১৩০০-১২০০ খ্রিষ্টপূর্বে গ্রিক ব্রোঞ্জ যুগে এটি নির্মিত হয়েছিল,যা আজকের দিনে অনেককিছু দিয়ে গিয়েছে।

এটি দুটি শহর তাইরিন এবং এপিদাউরাস এর মাঝে সামরিক রাস্তা হিসেবে কাজ করে।সাধারন পায়ে হাঁটার সেতু থেকে এর একটি চওড়া স্থান ছিল,যার রাস্তা ২.৫ মিটার চওড়া(৮ফিট)। ঐতিহাসিকগণ ধারনা করতেন রথ পরিচালনা করার জন্য সেতুটি অধিক চওড়া করা হয়।যেই জিনিশটি সেতুটিকে অধিক আকর্ষণীয় করে তা হল এটি সম্পূর্ণ চুনাপাথরের ছিল কিন্তু কোনরকম বাধাই পাথর ব্যবহার করা হয়নি পাথরগুলোকে অক্ষত রাখতে।তারমানে সেতুটি তিন হাজার বছরের ও উপর সেই চুনাপাথরে সুনিপুনভাবে টিকে আছে।

লেখিকা সম্পর্কেঃ ফাহমিদা নাসরিন।পেশায় শিক্ষক।ভাল লাগে বই পড়তে আর ঘুরে বেড়াতে।অবসর সময় কাটে ক্রাফটিং করে।