১০ অনিন্দ্যসুন্দর ফুলের স্পর্শ যখন হতে পারে আপনার মৃত্যুর কারণ

image source-eventa.co.uk
image source-eventa.co.uk

ফুল আমাদের সবার প্রিয়। ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন । আর এই ফুলের সৌন্দর্য আর সুঘ্রাণে আকর্ষিত হয়ে অনেক পোকা এর মধ্যে অবস্থান করে। এটা আমরা সবাই জানি । কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই এটা জানিনা যে, ফুলে শুধু পোকাই থাকে না ভয়ানক বিষ ও থাকে যা কেড়ে নিতে পারে কারও জীবন। আসুন আজ এমনই কিছু ফুলের কথা জেনে নিই যেগুলোর সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে প্রাণঘাতী ভয়ানক সব বিষাক্ত রাসায়নিক।

১। ক্যাস্টার গাছ

আমরা  কম বেশী সবাই রেড়ীর তেল বা  ক্যাস্টার অয়েলের নাম শুনেছি। এই রেড়ীর তেল বা ক্যাস্টার অয়েল সৌন্দর্য চর্চার প্রসাধনী হিসেবে ব্যবহৃত হয় । কিন্তু আমরা কি কেউ এটা ভাবতে পারি যে বর্তমানে এই রেড়ী গাছের নাম গিনিস বুকে সবচেয়ে বিষাক্ত গাছের রেকর্ড ধরে রেখেছে। আসুন এ সম্পর্কে জানা যাক ।

রেড়ী গাছের জন্মস্থান ভূমধ্য সাগরীয় অববাহিকা, পূর্ব আফ্রিকা এবং ভারত। এটি সাধারণত শোভাবর্ধক গাছ হিসেবে বহুল ব্যবহৃত। পুরো গাছে রিসিন নামে একধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ থাকে, প্রধাণত এদের বিচিতে বেশী থাকে যা থেকে ক্যাস্টার অয়েল বানানো হয়। এর একটি কাঁচা বা অপরিশোধিত বিচি ২ দিনের মধ্যে একজন মানুষকে মেরে ফেলার জন্য যথেস্ট ,এটি মানুষকে পীড়া দেয়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে অবধারিত মৃত্যুর পথে এগিয়ে নিয়ে যায় ।  এর প্রাথমিক লক্ষণ এই কাঁচা বা অপরিশোধিত বিচি খাওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে প্রকাশ পায় । যেমন – মুখে ও গলায় জ্বালা পোড়া, তলপেটে ব্যথা , ডায়রিয়া এবং বমি হওয়া। এভাবে পানিশূন্যতার ফলে ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে।

সুতরাং, কেউ যদি ভুল করে এই বিচি খেয়ে ফেলে সাথে সাথে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন এবং যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা করানো জরুরী।

আশঙ্কার কথা হচ্ছে এই রেড়ীর বিচির প্রভাব অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে মানুষের উপর বেশি । একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষকে মেরে ফেলার জন্য এর ১-৪ টি বিচিই যথেস্ট যেখানে ১১টি বিচি প্রয়োজন একটি কুকুরকে মারতে এবং নাহলেও ৮০ টি বিচি লাগবে একটি হাঁসকে মারতে । তাই সবারই এই গাছ এবং বিচি থেকে সাবধান থাকা দরকার । আর যদি এই গাছের উৎপাদন বা চাষ করতে চান কেউ তবে অবশ্যই যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করবেন ।

২। বেলাডোনা গাছ

বেলাডোনা গাছের জন্মস্থান ইউরোপ , উত্তর আফ্রিকা এবং পসচিম এশিয়া। এই গাছটি শয়তানের বেরি অথবা মৃত্যু চেরি নামেও পরিচিত । এটাও পৃথিবীর বিষাক্ত গাছগুলোর মধ্যে অন্যতম । এতে রয়েছে ট্রপেন এল্কালয়েডস নামের রাসায়নিক যা চিন্তাবিভ্রম এবং দৃষ্টিবিভ্রম ঘটায় । এই বিষে আক্রান্ত হলে আরও যেসব লক্ষন দেখা যায় সেগুলো হল কথা বন্ধ হয়ে যাওয়া , মুখ শুষ্ক হয়ে যাওয়া , মাথা ব্যাথা , শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া এবং খিঁচুনি হওয়া ।

এই পুরো গাছই খুবই বিষাক্ত কিন্তু এর ফলগুলো খুব বেশী বিষাক্ত কারন এগুলো খেতে মিস্টি এবং শিশুদের আকর্ষণ করার ক্ষমতা আছে । এর ১০-২০ টা ফলই যথেস্ট একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষকে মেরে ফেলার জন্য । আর তার চেয়েও ভয়ংকর বিষাক্ত হচ্ছে এর পাতা । এর শুধুমাত্র একটি পাতাই যথেষ্ঠ একজন মানুষকে মেরে ফেলার জন্য ।

সুতরাংট, সবারই বিশেষ করে শিশুদের এই গাছের নাগাল থেকে দূরে রাখুন আর কেউ এই গাছের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হলে দেরী না করে সাথে সাথে চিকিৎসকের শরনাপন্ন হোন ।

৩। রোজারি পী

আমরা ছোটকালে সবাইকে বলতে শুনেছি ছবির এই ফলটা যদি সরিষার তেলের মধ্যে রাখা হয় তবে চুল কালো হবে । এবং এই বিশ্বাসে অনেককে তেলের মধ্যে এই ফল রাখতেও দেখেছি । ফলগুলো দেখতেও কিন্তু খুব সুন্দর । তবে ফলগুলো দেখে বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ করছি । কারন একটু অসচেতন হলেই এই গাছটিও আপনার প্রান নিয়ে পারে । আসুন জেনে নিই এই গাছটি সম্পর্কে ।

এই গাছের নাম রোজি পি। এই গাছের জন্মস্থান ইন্দোনেশিয়াতে কিন্তু তাছাড়াও পৃথিবীর যেকোনো জায়গাতেই এই গাছের দেখা পাওয়া যায় । এই গাছের বিচিটি উজ্জ্বল লাল এবং উপরে একটু কালো যা ফলটির সৌন্দর্য বর্ধনে কাজ করে । এই ফলটিকে অনেকে পুঁতি হিসেবে ব্যবহার করে থাকে । এই ফলে নয় গাছে বিষ থাকে । এই গাছে যে বিষাক্ত রাসায়নিক থাকে তার নাম এব্রিন যা রিসিন এর মতই বিষাক্ত । কিন্তু রিসিন আর এব্রিন এর মধ্যে একটা মূল পার্থক্য হল এব্রিন ৭৫ গুন বেশী শক্তিশালী বিষ রিসিনের চেয়। একজন মানুষকে মেরে ফেলার জন্য এর ক্ষুদ্র পরিমান বিষই যথেস্ট । কিছু কিছু ক্ষেত্রে ৩ মাইক্রোগ্রাম এব্রিন একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষকে মেরে ফেলতে পারে । এমনকি এর বিচি পুঁতি হিসেবে ব্যবহার করলেও তাতেও জীবন হুমকি থাকে কারন অনেকেই এই ছোট বিচিটাকে ড্রিল দিয়ে ছিদ্র করতে গিয়ে নিজের হাতের আঙুল ফুটো করে ফেলে ।

৪ । ওলেন্ডার

এই সুন্দর ফুলটির  নাম অলেন্ডার । এই ফুল টি বিখ্যাত এর সুঘ্রা্ণ এর জন্য । এই গাছটি সাধারণত বাগানের সৌন্দর্য বর্ধনের এবং অলংকরনের জন্য ব্যবহার করা হয় । কিন্তু এই গাছের সব অংশই মারাত্মক বিষাক্ত । এর মধ্যে রয়েছে lethal cardiac glycosides যা oleandrin এবং  neriine নামে পরিচিত। যদি এটার কোনটা খাওয়া হয় তবে ব্যক্তির বমি হতে পারে, ডাইরিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে , স্পন্দন অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে , খিঁচুনি হতে পারে , কমায় চলে যেতে এমনকি সাথে সাথে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে । কারও কারও ক্ষেত্রে এর রস বা পাতা শরীরে লাগে তবে ত্বকে জ্বালা পোড়া হতে পারে র‍্যাশ দেখা দিতে পারে । এই অলেন্ডারের বিষ এতই শক্তিশালী যে, যদি কেউ এই ফুলের মধু যা মৌমাছি থেকে পাওয়া যায় খায় তবে সে অসুস্থ হয়ে পড়বে । আশার কথা হল এই গাছটা খুবই তিক্ত স্বাদের তাই এই গাছ বা ফুল খাওয়া থেকে প্রাণীরা বিরত থাকে তাই এ থেকে মৃত্যুর হার খুবই কম ।

৫। লিলি অফ দ্য ভ্যালি

এই সুন্দর  সাদা সুভ্র স্নিগ্ধ ফুলটির নাম কনভালারিয়া মাজালিছ ( Covallaria Majalis ) যা সাধারনত লিলি অফ দ্য ভ্যালি নামেই অধিক পরিচিত । কিন্তু এই ফুলের স্নিগ্ধতা দেখে ভুল করবেন না কারন এই ফুলের মধ্যে যে বিষাক্ত রাসায়নিক বিদ্যমান তা একজন মানুষকে ধীরে ধীরে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট । এটি এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যে খুঁজে পাওয়া উচ্চমাত্রার বিষাক্ত গাছগুলোর মধ্যে একটি ।

এতে amino acid এবং  azetidine-2-carboxylic acid নামের রাসায়নিক বিষের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে । এই ফুলের সুন্দর ঘণ্টার মত আকার এবং উজ্জ্বল লাল বেরির মত ফল সহজেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কিন্তু এর পুরো গাছটাই বিষে পরিপূর্ণ । এই গাছের বিপদজনক রাসায়নিক বিষ হৃদ স্পন্দন কমিয়ে দিতে পারে, বমির কারন হতে পারে এবং তলপেটে খিঁচুনি সৃষ্টি করতে পারে । আর সব শেষে এটি ধীরে ধীরে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে কাউকে । তাই এই ফুলের সৌন্দর্যে মোহিত হলেও এর থেকে নিরাপদ দূরে অবস্থান করাই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক ।

৬।  উলফসবেন

উলফসবেন যা লেপার্ড বেন , ওমেন্স বেন বা ডেভিলস হেলমেট নামে পরিচিত । এটি ঝুমকোলতা প্রজাতির গাছের অন্তর্ভুক্ত । এই বহুবর্ষজীবী উদ্ভিতটির আদিনিবাস উত্তর গোলার্ধের পার্বত্য এলাকা । এই গাছে alkaloid pseudaconitine নামে উচ্চমাত্রার বিষাক্ত রাসায়নিক রয়েছে । এটি যদি কেউ খেয়ে ফেলে তবে সাথে সাথে তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গে এবং তলপেটে জ্বালা পোড়া শুরু হবে । আর কেউ যদি অতিরিক্ত পরিমানে খেয়ে ফেলে তবে ২-৬ ঘণ্টার মধ্যে তার মৃত্যু হতে পারে । আর এর মাত্র  ২০ মিলিগ্রামই যথেষ্ট একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষকে মেরে ফেলার জন্য । আগে জাপানে এই বিষ ব্যবহার করা হত শিকার করার জন্য এবং তীরের অগ্রভাগে লাগানোর জন্য ।

৭। ওটাম ক্রোকাস

এই অটাম ক্রোকাস এর জন্মস্থান ইউনাইটেড কিংডম । এই ফুলের স্নিগ্ধ  হালকা বেগুনী রং , শান্ত এবং নিরীহ গঠন দেখে প্রথম দেখাতেই সবাই মোহিত হবে । কিন্তু এই অসাধারন সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে colchicine নামক ভয়ংকর রাসায়নিক যা আর্সেনিক বিষক্রিয়ার সাথে তুলনীয় । এই ফুলের মধ্যে এই colchicine নামক রাসায়নিক বিষের মাত্রা অতি উচ্চমাত্রায় বিরাজমান ।

এই ফুলের বিষের মধ্যম মাত্রায় আক্রান্ত হলে ব্যক্তির গলায় এবং মুখে জ্বালাপোড়া অনুভূতি হতে পারে, বমি হতে হতে পারে এমনকি ব্যক্তি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে । আর চরম মাত্রায় এই শান্ত, নিরীহ চেহারার ফুলটির বিষাক্ত রাসায়নিক যকৃত এবং বৃক্কের কাজ বন্ধ করে দিতে পারে , হৃদপিণ্ডের কাজ বন্ধ করে দিতে পারে এবং মৃত্যুও ঘটাতে পারে ।

৮।  ফক্সগ্লভস

এই মন মাতানো নজরকাড়া ফুলের নাম ডিজিটালিস যা সাধারনত foxgloves বা মৃত মানুষের ঘণ্টা নামে পরিচিত । এই ফুলের আগা থেকে গোঁড়া এমনকি বীজও খুবই বিষাক্ত । যদি কেউ এই ফুল খায় তবে তার বমি হতে পারে, দৃষ্টিভ্রম  হতে পারে, চিন্তাভ্রম ঘটতে পারে, হৃদ স্পন্দন ওঠানামা করতে পারে এবং কাঁপুনি হতে পারে । যদি অনেক পরিমানে খাওয়া হয় তবে ব্যক্তির মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে ।

৯। ইংলিশ ব্রুম

এই ফুলের জন্মস্থান ইংল্যান্ডসহ পশ্চিম এবং মধ্য ইউরোপ এর শেষপ্রান্ত পর্যন্ত । এই উজ্জ্বল নজরকারা ফুলের গুচ্ছ দেখলে মনে হবে ছোট ছোট কলার মত । এবং সৌন্দর্য যে কারও মন হরন করে নিতে পারে কিন্ত এই সুন্দর ফুলের রয়েছে ভয়ঙ্কর বিধ্বংসী ক্ষমতা ।

এই ইংলিশ ব্রুম এর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে সাইটিসাস স্কোরপেরিয়াস । এই ফুলের মধ্যে একধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক আছে যা মানুষের হৃদ স্পন্দনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে এমনকি হৃদ স্পন্দন এবং স্নায়ুতন্ত্রের কর্মক্ষমতা দুর্বল করে দিতে পারে । তাই এটি শিশু, গর্ভবতী মহিলা এবং যাদের হৃদরোগ আছে তাদের জন্য ক্ষতিকর ।

১০।  হোয়াইট স্নেক রূট

এই ফুলটির নাম হোয়াইট স্নেক রূট ( white snakeroot)  যার বৈজ্ঞানিক নাম আজারাটিনা অল্টিসিমা (ageratina altissima ) । এই ফুলের আদি নিবাস উত্তর আমেরিকা । এই ফুলে রয়েছে tremetol নামের রাসায়নিক যা খুবই বিষাক্ত । এটি এতই বিষাক্ত যে, কোন ব্যক্তি যদি এমন গরুর দুধ পান করে যে গরু এই গাছ খেয়েছে সেই ব্যক্তির মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে ।

লেখিকা সম্পর্কেঃ শারমীন আক্তার সেতু। আমি পেশায় একজন মনোবিজ্ঞানী । কবিতা লিখতে এবং পড়তে পছন্দ করি । মনোবৈজ্ঞানিক ফিচার লেখার সাথে যুক্ত আছি । তাছাড়াও অন্যান্য বিষয়েও লিখতে এবং জানতে পছন্দ করি । আমি এর আগে পরামর্শ .কম এ লেখার সাথে যুক্ত ছিলাম । এখন কিছু ইংরেজি সাইটে অনুবাদের কাজ করছি । আমার শখ ভ্রমন এবং গান গাওয়া । বাগান করতে পছন্দ করি এবং বিভিন্ন গাছ,ফুল্‌,ফল এবং নতুন নতুন জায়গার সাথে পরিচিত হতে ভাল লাগে ।