আইনস্টাইন সম্পর্কে ১০ টি অজানা তথ্য

6371624-einstein

Image Courtesy: কালারবক্স

অধিকাংশ মানুষই আইনস্টাইনকে একজন মহান বিজ্ঞানী হিসেবে মানে। অনেক খ্যাতিমান মানুষের মতোই আইনস্টাইনের জীবনে এমন কিছু সত্য আছে যেগুলো অনেকেই জানেন না। তথ্য গুলো যে কোন মানুষকে অবাক করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। আজকে আমরা এরকম ১০ টি তথ্য সম্পর্কেই আলোচনা করবো।

১। আপেক্ষিক তত্ত্ব নিয়ে বিবাদ

আইনস্টাইনের বিখ্যাত “”আপেক্ষিক তত্ত্ব “ নিয়ে একসময় বিবাদের সূচনা হয়েছিল। জার্মান বিজ্ঞানী ডেভিড হিলবারট দাবি করেছিলেন ,আপেক্ষিকতার তত্ত্বটি তাঁর দেয়া এবং আইনস্টাইন সেই থিওরিটি চুরি করে নিজের নামে চালিয়েছেন। আইনস্টাইনও পাল্টা অভিযোগ আনেন হিলবারটের বিরুদ্ধেসবাই ধারনা করতে থাকলো উভয় বিজ্ঞানীই স্বাধীনভাবে “আপেক্ষিক তত্ত্ব “ নিয়ে কাজ করেছেন। পরবর্তীতে প্রমানিত হয় জার্মান বিজ্ঞানী হিলবারটই আইনস্টাইনের থিওরি থেকে কিছু লেখা চুরি করে নিজের নামে চালিয়েছিলেন ।

২। আইনস্টাইন তাঁর হাই স্কুলে কখনোই ফেইল করেননি

একটা মিথ প্রচলিত আছে যে ,আইনস্টাইন তার স্কুলে অনেকবার ফেইল করেছিলেন । কথাটি মোটেই সঠিক নয়। বরং তিনি গনিত বিষয়ে ছিলেন তুখোড় মেধাবীদের একজন । মাত্র ১২ বছর বয়সেই তিনি উপরের ক্লাসের কঠিন কঠিন ক্যালকুলাস গুলো সমাধান করে ফেলেছিলেন ।মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি ক্যাল্কুলাস সম্পর্কে আস্ত একটা রচনা তৈরি করে ফেলেন যেটা তার অতুলনীয় মেধার পরিচয় বহন করে।

হাই স্কুলে ফেইল করার মিথটি সম্ভবত জার্মান এবং সুইস স্কুলের ভিন্ন ভিন্ন মারকিং সিস্টেমের জন্য তৈরি হয়েছিল। ক্যান্টন স্কুলের গ্রেডিং সিস্টেমটা ছিল ১-৬ ( A-F) ,যেখানে ১ ছিল সবচেয়ে ভালো এবং ৬ ছিল সর্বনিম্ন গ্রেডিং। সুইস স্কুলে এসে পুরো গ্রেডিংটাই উল্টে গেলো। এখানে ৬ ছিল সব থেকে ভালো গ্রেড এবং ১ ছিল সব থেকে খারাপ । তবে হ্যা ,কলেজ এন্ট্রেন্স পরীক্ষায় আইনস্টাইন একবার ফেইল করেছিলেন। সুইজারল্যান্ডের ফেডারাল পলিটেকনিক স্কুলের সেই পরীক্ষায় আইনস্টাইন গনিত এবং পদার্থ বিজ্ঞানে যথেষ্ট ভালো করেছিলেন । অন্য বিষয়গুলোতে তিনি যথেষ্ট খারাপ করেছিলেন ,বিশেষত ফ্রেঞ্চ ভাষায় ।

৩। আইনস্টাইনের আবিস্কারসমূহ

নিজের জীবদ্দশায় আইনস্টাইন বেশ কিছু উদ্ভাবনের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন । বিজ্ঞানি লিও জিলারডের সাথে মিলে তিনি তৈরি করেছিলেন আইনস্টাইন রেফ্রিজারেটর। অন্যান্য রেফ্রিজারেটরের সাথে এটার পার্থক্য হলো এটি ইলেক্ট্রিসিটি ছাড়াই খাবার ঠাণ্ডা রাখতে পারে। এটি শোষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গ্যাস এবং তরলের আন্তঃপরিবর্তনের মাধ্যমে ভেতরের ফুড চেম্বারকে ঠাণ্ডা রাখে।

তখনকার সময়ে রেফ্রিজারেটরের কম্প্রেসারে বিষাক্ত সালফার ডাই অক্সাইড এবং মিথিলিন ক্লোরাইড গ্যাস ব্যাবহার করা হতো। এগুলো লিক হয়ে অনেক মানুষের মৃত্যুর কারন হতো। আইনস্টাইন তার কম্প্রেসারবিহিন ফ্রিজটি তৈরির উৎসাহ পেয়েছিলেন এরকমই একটি ঘটনা থেকে। কম্প্রেসার লিক হয়ে এক জার্মান পরিবারের মৃত্যুর কথা তিনি জানতেন।

আইনস্টাইনের অন্যতম আরেকটি আবিস্কার হচ্ছে পাম্প এবং ব্লাউজ। এই পোশাকে ২ সেট বোতাম ছিল। এটিকে যে কোন অবস্থায় শরীরের সাথে স্লিম ফিট করে নেয়া যায়। শরীরের পরিসর বাড়লেও পোশাকটিকে ইচ্ছেমতো ফিট করা সম্ভব ছিল।

৪। সংবিধানের একটি ছোট ভুল আমেরিকাকে একনায়ক তান্ত্রিক করে তুলেছিল

২য় বিশ্ব যুদ্ধের সময় বিজ্ঞানী কার্ট গডেল নাৎসিদের আক্রমন থেকে বাঁচতে পালিয়ে আমেরিকা চলে এসেছিলেন। আইনস্টাইনের মতো এতো সহজে গডেল আমেরিকার নাগরিকত্ব পাননি । তাকে একটি ইন্টার্ভিউয়ের জন্য ডাকা হয়।গডেল কে এমন দুজন মানুষকে আনতে বলা হয় যারা গডেলের হয়ে জামিন হবেন। গডেল তার বিজ্ঞানি বন্ধু আইনস্টাইন এবং অস্কার কে ডেকে আনেন।

কাকতালীয় ভাবে ইন্টার্ভিউটি নিচ্ছিলেন জাজ ফিলিপ ফোরম্যান। তিনি আইনস্টাইনের বন্ধু। ফোরম্যান গডেল কে বললেন ,আমেরিকা কখনোই জার্মানির মতো এক নায়ক তান্ত্রিক হবে না । গডেল বিষয়টা নিয়ে তর্কে যেতে চাইলেন। কথাটা তিনি মানতে চাইলেন না । আইনস্টাইন স্পষ্ট বুঝতে পারলেন এই তর্ক বিতর্ক গডেলের নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগটুকু নষ্ট করে দিতে পারে। তাই তিনি গডেলের কথাইয় বাধা দিয়ে ইন্টার্ভিউ তাড়াতাড়ি শেষ করলেন। পরবর্তীতে গদেল আমেরিকার নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন।

এই ঘটনাটির উল্লেখ ছিল বিজ্ঞানি অস্কারের ডায়রিতে। যদিও সেখানে উল্লেখ করা হয়নি ঠিক কি বিষয়ে গডেল দ্বিমত হয়েছিলেন ,তথাপি অনেকেই ধারনা করে থাকেন গডেল সম্ভবত আর্টিকেল ৫ এর কথা বলেছিলেন।

৫। FBI ধারনা করতো আইনস্টাইন একজন সোভিয়েত এজেন্ট

১৯৩৩ সালে আমেরিকায় আসার পর থেকেই FBI আইনস্টাইনের উপর নজরদারি করতো। আইনস্টাইনের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তাদের এই নজরদারি অব্যাহত ছিল । FBI মনে করতো আইনস্টাইন একজন সোভিয়েত এজেন্ট।

তাদের এই ধারনার মুলে ছিল আইনস্টাইনের রাজনৈতিক দর্শন এবং যুদ্ধ বিরোধি একাধিক মানবাধিকার সংগঠনের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।তারা প্রায়ই আইনস্টাইনের ফোনে আড়ি পাততো। তার চিঠিপত্রগুলো ঘেঁটে দেখতো। সব সময় একটা মোটিভ খুজতো যেটা প্রমান করে আইনস্টাইন একজন সোভিয়েত এজেন্ট।

আমেরিকায় পৌঁছার আগেই WOMAN PATRIOT CORPORATION ,আমেরিকান স্টেট গভর্নমেন্ট কে ১৬ পাতার একটা চিঠি দিয়েছিল যেখানে আইনস্টাইনের আগমন নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলেছিল। এর ফলে স্টেট গভর্নমেন্ট আইনস্টাইনকে অতিরিক্ত নজরদারির মধ্যে রাখতে বাধ্য হয় । ত্যাক্ত বিরক্ত আইনস্টাইন এরপরেও আমেরিকার নাগরিকত্ব পান এবং সেখানে অবস্থান করতে থাকেন যদিও তিনি জানতেন তার উপর নজরদারি করা হচ্ছে ।

৬। পরমাণু বোমা প্রকল্পে যুক্ত থাকার জন্য আইনস্টাইন আক্ষেপ করতেন

ম্যানহাটন প্রোজেক্ট যেটা কিনা ২য় বিশ্বযুদ্ধে প্রথম পারমানবিক বোমা তৈরি করে সেটার সাথে আইনস্টাইন যুক্ত ছিলেন না। তবে তিনি এই প্রকল্পে যুক্ত হতে চেয়েছিলেন । ক্লিয়ারেন্স না থাকার কারনে সেটা হয় নি। এমন কি এই প্রকল্পের অন্য বিজ্ঞানীরাও আইনস্টাইনের সাথে যোগাযোগ করতে পারতেন না ।

পরমানু বোমার ভয়াবহতা আইনস্টাইন জানতেন । সেইকারনে তিনি ভীত হয়েছিলেন জার্মানির হাতে পরমানু বোমা এলে কি ঘটতে পারে। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট কে আইনস্টাইন পরমাণু বোমার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে একটা চিঠি লিখিছিলেন। পরবর্তীতে আমেরিকা পরমাণু বোমা তৈরী করলো। তারা সেই বোমা ফেলল জাপানের উপর। সেদিন আইনস্টাইন তার চিঠির জন্য খুব আক্ষেপ করেছিলেন।

৭। এডওয়ার্ড আইনস্টাইন

আইনস্টাইন এবং তার স্ত্রি মিলেভা মেরিকের ইয় সন্তান এডওয়ার্ড আইনস্টাইন। তার জন্ম সালে। ডাক নাম ছিল TETE। এডওয়ার্ড সিজোফ্রিনিক রোগে আক্রান্ত ছিলেন। আইনস্টাইন এতে মোটেই অবাক হননি। কারন তার স্ত্রী মিলেভার বোন ও সিজোফ্রিনিক রোগী ছিলেন। ১৯১৯ সালে মিলেভার সাথে আইনস্টাইনের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বিচ্ছেদের পরেও মিলেভা এডওয়ার্ডের দেখা শুনা করতেন। একসময় এডওয়ার্ডকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ইউরোপে থাকার সময় আইনস্টাইন প্রায়ই তার ছেলেকে দেখতে যেতেন। যখন আমেরিকা চলে গেলেন তখন তিনি ছেলেকে চিঠি লিখতেন। চিঠিগুলোতে আইনস্টাইন তার ছেলেকে দেখার ইচ্ছা ব্যাক্ত করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং তাদের আর দেখা হয়নি।

আইনস্টাইনের স্ত্রী মিলেভা মারা যান ১৯৪৮ সাল। এডওয়ার্ড হাস্পাতালেই থেকে যান। ৬৫ সালে তিনি মারা যান ।

৮। দুটো জিনিস আইনস্টাইন খুব ভালোবাসতেন

একটি ছিল তার বেহালা এবং আরেকটি ছিল পাইপ । তিনি একজন চেইন স্মোকার ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন মনের স্থিরতার জন্য ধূমপান আবশ্যক। আইনস্টাইন “”মন্ট্রিল চেইন স্মোকার ক্লাব “ এর আজীবন সদস্য ছিলেন। একবার তিনি জাহাজ থেকে পানিতে পড়ে গিয়েছিলেন। পুরো ব্যাপারটাতে তিনি মোটেই বিব্রত হননি বরং একটা পাইপ জ্বালিয়ে দিব্যি উপভোগ করলেন।

৯। আইনস্টাইনের নারী আসক্তি

গবেষণা ছাড়া বাকি সময়টুকু আইনস্টাইন কাটাতেন তার নারী বন্ধুদের সাথে। কখনো বেহালা বাজিয়ে। কখনো চিঠি লিখে । তবে সেই অর্থে তিনি খারাপ স্বামী কিংবা বাবা ছিলেন ন। তার ২য় স্ত্রী ছিল এলিসা । আইনস্টাইন বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কেও জড়িয়েছিলেন। তার বান্ধবী ছিল ৬ জন । এস্টেলা ,এথেল ,টনি এবং মারগারীটা।

১০। শেষ কথা

আইনস্টাইন যথেষ্ট মেধাবি ছিলেন ,কিন্তু নিখুঁত ছিলেন না। E=mc2 প্রতিপাদনের সময় তিনি টি ভুল করেছিলেন । ১৯১৭ সালে তিনি আপেক্ষিকতার সুত্রে কসমোলজিক্যাল কন্সট্যান্ট বা মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের সংযুক্তি ঘটান যেটাকে গ্রিক ক্যাপিটাল ল্যামডা দ্বারা নির্দেশ করা হয় ।

আইনস্টাইন এটা করেছিলেন কারন অধিকাংশ বিজ্ঞানি তখন মনে করতেন পৃথিবী স্থির। পরবর্তীতে আইনস্টাইন ল্যামডা প্রতীকটি তুলে নেন মকারন তিনি জানতে পারেন প্রিথিবি স্থির নয় এবং ক্রমশ বর্ধনশীল। কিন্তু সালে বিজ্ঞানীরা প্রমান করেন যে , ল্যামডার প্রচলনটাই সঠিক ছিল , কারন এটি “”DARK ENERGY “”নির্দেশ করে।

লেখক সম্পর্কেঃ আরাফাত আব্দুল্লাহ । লেখালেখির সাথে যুক্ত আছি । কিছু অনুবাদের কাজ করেছি । প্রিয় কাজ সমসাময়িক বিষয়ের উপর লেখালেখি করা ।