২০ অদ্ভূত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা ও তাদের ফলাফল

source-youtube
source-youtube

বিজ্ঞান আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত শুধু তাই নয় মানব সভ্যতার উৎকর্ষতায় বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য।  কখনও সে দিচ্ছে নতুন জীবন, কখনও এই বহ্মান্ড ছেড়ে মহাকাশের অন্য প্রান্তে খুজঁছে প্রাণের অস্তিত্ব। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার সেসব আবিষ্কারকদের অমর করে রেখেছে। কিন্তু এই বিজ্ঞানেই বিভিন্ন সময় এমন কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে যার বেশ কয়েকটি যেমনি ছিল অদ্ভুত, ঠিক তেমনি ছিল ভয়ঙ্কর। আসুন দেখি বিজ্ঞানের এমন কিছু অদ্ভুত এবং ভয়ঙ্কর এক্সপেরিমেন্টের গল্প।

১। হোমিনকিউলাস পরীক্ষা

সাল ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ। মধ্যযুগের বিখ্যাত পদার্থবিদ প্যারাসেলসাস একবার এক বিচিত্র প্রাণী তৈরির চেষ্টায় মানুষের শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু ঘোড়ার জঠরে স্থাপন মাধ্যমে তা নিষিক্ত করার চেষ্টা করেন। তিনি পরীক্ষাটির নাম দেন হোমিনকিউলাস। বলা বাহুল্য, তাঁর সেই পরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছিল।

২। মৃত ব্যক্তিকে জীবিতকরণ

১৯৩০ সালে বিজ্ঞানী রবার্ট কর্নিশ মৃত প্রাণী পুনরায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এক দল শিয়ালের উপর পরীক্ষা চালান।. মৃত শেয়ালগুলিকে অনবরত রক্ত দিয়ে এবং তাঁর নিজের আবিষ্কারের দু’টি ইঞ্জেকশন দেন তিনি। কয়েক মুহূর্তের জন্য সত্যিই শিয়ালগুলির দেহে ‘প্রাণ’ ফিরে । কিছু সময়ের জন্য মৃত শিয়াল গুলি জীবিত হলেও এরা অন্ধ এবং তাদের ব্রেইন নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তীতে এদের ক্লিনিক্যালি মৃত ঘোষণা করা হয়। তিনি এ পরীক্ষা পুনরায় আর কখনও করেন নি।

৩। শক দ্য পাপি

কুকুর কতটা মানুষের অনুগত, তা পরীক্ষা করার জন্য বিজ্ঞানী  স্টেনলি মিরগ্রাম ও তার দল ১৯৬৩ সালে একটি প্রশিক্ষিত কুকুরকে নিয়ে পরীক্ষা করেন । যখন কুকুরটি তার প্রভুর আজ্ঞা সঠিকভাবে পালন না করলেই বৈদ্যুতিক শক দেয়া হচ্ছিল।  প্রতি ভুলের জন্য একটু করে শকের পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছিল।
এই বৈদ্যুতিক শক যত বাড়ানো হচ্ছিল কুকুরটি ব্যথায় চিৎকার করছিল আর এদিক সেদিক লাফ দিচ্ছিল। কুকুরটির অবস্থা দেখে বেশ কয়েক জন এই পরীক্ষায় আর অংশ না নিয়ে বেড়িয়ে যান।

৪। প্রাণীর মস্তিস্ক নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষা

১৯৬৩ সালে বিজ্ঞানী জোসে ডেলগাডো দাবী করেন যে, তিনি একটি কম্পিউটার চিপ তৈরি করেছেন যা রিমোট কন্ট্রোলে্র মাধ্যমে প্রাণীর মস্তিস্ক নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। তিনি এর নাম দেন ‘স্টিমোসিভার’। চিপটি একটি ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মাথায় চিপ লাগিয়ে পরীক্ষা করা হয়। আশানুরূপ ফল পেয়ে মানুষের উপর শুরু হয় পরীক্ষা। ছয় এবং সাতের দশকে করা এই পরীক্ষাগুলির বহু মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছিল।

৫। মৃত্যুর সময়ে হৃদস্পন্দন কত থাকে?

মৃত্যুর ঠিক আগে মানুষের হৃদস্পন্দন কেমন থাকে তা মাপার জন্য ডক্টর স্টিফেন বেসলি এক বিচিত্র পরীক্ষা করেছিলেন। ১৯৩৮ সালের ৩১ অক্টোবর এক ব্যক্তির কব্জিতে সেন্সর বেঁধে দেন বিজ্ঞানীরা। তারপর তাঁকে গুলি করে মারা হয়। পরীক্ষায় দেখা যায়, মৃত্যুর পূর্বে যে হার্ট বিট ছিল মৃত্যুর সময় তার হার্ট বিট ছিল সবচেয়ে বেশি। মৃত্যুর আতঙ্কের কারনে তার হার্ট বিট বেড়ে যায়।

৬। দ্য ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন এক্সপেরিমেন্ট

কয়েকজন বিজ্ঞানীর ধারণা ছিল মৃত ব্যক্তির শরীরে বিদ্যুৎ শক দিলে সে জীবিত হয়ে উঠে। এ জন্য বহু বিজ্ঞানী মৃত শরীরে বিদ্যুতের শক দিলে তার ফলাফল কি হয় তার জন্য বহুবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান।  তবে ভয়ঙ্করতমটি সম্ভবত ঘটেছিল ১৮০৩ সালে। এক বিশাল প্রেক্ষাগৃহে একটি মৃতদেহের শরীরে ১২০ ভোল্টের বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয় যার ফলে মৃতদেহটি বিকৃত হয়ে স্টেজে সোজা হয়ে কাঁপতে থাকে। ভয়ে জ্ঞান হারান একাধিক দর্শক।

৭। দ্য এপ অ্যান্ড দ্য চাইল্ড

পশুদের মাঝে কোনও মানবশিশু বড় হলে তার চরিত্রে পশুদের ছাপ পড়ে। এটা বোঝার জন্য সাইকোলজিস্ট উইনথর্প কেলোগ একটি শিম্পাঞ্জির বাচ্চাকে একটি মানব সন্তানের সঙ্গে মানুষ করতে শুরু করেন । দু’জনকেই আর কারও সঙ্গে মিশতে দেওয়া হত না। ফলাফল হয় অদ্ভুত। ন’মাস পরে শিশুটি শিম্পাঞ্জির মতো আচরণ শুরু করে। শিম্পাঞ্জিটিকে এর পর তার নিজের পরিবেশে ছেড়ে দেওয়া হলে কিছু দিন পর সে মারা যায়।

 ৮। মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন

১৯৭০ সালের মার্চে বিজ্ঞানী হোয়াইট ও তার দল একটি বানরের মস্তিষ্ক কেটে অন্য একটি বানরের দেহে তা বসিয়ে দেন। অপারেশনের পর মাত্র দেড় দিন বেঁচেছিল এই বানরটি। পরীক্ষার করতে গিয়ে একাধিক বানরের মৃত্যু হয়েছিল। একাধিক সংগঠন এই পরীক্ষার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল।

৯। কাতুকুতু পরীক্ষা

ক্লরেন্স লিউবা নামে এক বিজ্ঞানী মানুষের শরীরে কাতুকুতু দিলে তা মানুষের শারীরবৃত্তীয় কারণে হাসে, না বাকিদের দেখে হাসে এটা বোঝার জন্য তিনি নিজের সন্তানের উপর অনবরত কাতুকুতু দিয়ে পরীক্ষা করেন। যে সময়ে শিশুটিকে কাতুকুতু দেওয়া হত, তখন অন্য কাউকে সেখানে থাকতে দেয়া হতো না। সাত মাস পরীক্ষার পর দেখা গেল শারীরবৃত্তীয় কারণেই কাতুকুতু দিলে মানুষ হাসে, অন্যদের দেখে নয়।

১০। বেনিফিশিয়াল ব্রেনওয়াশিং

বিখ্যাত চিকিত্সক এউইন ক্যামেরন সিজোফ্রেনিয়ার চিকিত্সায় এক বিচিত্র পদ্ধতির ব্যবহার করেন।  তাঁর দাবি ছিল, এই ধরনের কোনও রোগীর মস্তিষ্ককে দীর্ঘ দিন ভাল চিন্তা করতে বাধ্য করা হলে রোগ সেরে যায়। চিকিৎসার অঙ্গ হিসাবে দিনের পর দিন রোগীকে হেডফোনে গান শোনাতেন ক্যামেরন। রোগ নির্মূল হওয়ার বদলে রোগীর নানারকম সমস্যা শুরু হয়।

১১। লেড গ্যাসোলিন

বিজ্ঞানী টমাস মিডগ্লে জুনিয়রকে আজকের পৃথিবীর বেশির ভাগ দূষণের জন্য দায়ী করা হয়। তিনিই প্রথম লেডমিশ্রিত গ্যসোলিন আবিষ্কার করেন। এটি ক্ষতিকারক নয় বোঝাতে নিজে সেটি দিয়ে হাত ধুয়ে টানা এক মিনিট সেটির গন্ধ শোঁকেন। পরে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তিনি।

১২। পীতজ্বরের পরীক্ষা:

আমেরিকান ডাক্তার স্টাবিন্স ফার্থ এক বিচিত্র পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমান করতে সচেষ্ট হন যে পীতজ্বর ছোঁয়াচে নয় । ১৯ শতকের গোড়ার এই চিকিত্সক তাঁর বক্তব্য প্রমাণে পীতজ্বর আক্রান্ত রোগীর বমি খেতেন। পরে অবশ্য প্রমাণ হয়, ফার্থ সঠিক বলেননি। রক্তের মাধ্যমে ছড়ায় এই রোগ।

১৩। মানুষ-বানর শঙ্কর:

১৯২৭ সালে সাবেক সোভিয়েতের এক বিজ্ঞানী ইভানভ চেষ্টা করেছিলেন মানুষের সঙ্গে বানরের শঙ্কর তৈরির। পরীক্ষা করতে বহু দিন আফ্রিকায় থেকেছিলেন তিনি। পরীক্ষা ব্যর্থ হয় এবং ইভানভের জেল হয়।

১৪। কাটা মস্তিষ্কের পরীক্ষা

ফরাসি বিপ্লবের গিলোটিন পরবর্তী অধ্যায়ের পর বিজ্ঞানীরা খণ্ডিত মস্তিষ্ক জীবিত রাখা সম্ভব কি না- এই বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯২৮ সালে এক সোভিয়েত বিজ্ঞানী সার্গেই ব্রুকোনানকো এই পরীক্ষায় সফল হন। তিনি একটি হারট-লান্স যন্ত্র তৈরি করেন যার নাম দেন ‘অটোজেকটর’। তিনি একটি কুকুরের কাটা মাথা ঐ বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে ‘জীবিত’ রাখেন তিনি। এক দল বিজ্ঞানীর সামনে সেই ‘জীবিত’ মস্তিষ্ক দেখানোও হয়।

১৫। দু’মুখো কুকুর

১৯৫৪ সালে সোভিয়েত বিজ্ঞানী দেমিকভ সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন তাঁর আবিষ্কার দিয়ে। তিনি একটি জার্মান শেপার্ডের ঘাড়ের সঙ্গে একটি স্পিতজের মাথা এবং ডান পা জোড়া লাগিয়ে দেন। সবাইকে অবাক করে ‘কুকুরটি’ হেঁটে দেখায়। কিছু দিনের মধ্যেই অবশ্য প্রাণীটি মারা যায়।

১৬। সাইবর্গ পরীক্ষা:

 সাইবর্গ কথাটি তখনও বিজ্ঞানীমহলে বিশেষ পরিচিত নয়। সেই সময়ে কেভিন ওয়ারউইক নামে এক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী নিজের দেহে মাইক্রোচিপ ঢুকিয়ে সরাসরি ইন্টারনেটের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। আধুনিক রোবটের যুগে ইনিই প্রথম সফল সাইবর্গ।

১৭। আত্মার ওজন

বিংশ শতকের গোড়ায় এক মার্কিন বিজ্ঞানী ডক্টর ডানকান দাবি করেন মৃত্যুর পর মানুষের আত্মার ওজন  তিনি নির্ণয় করতে পারবেন। মৃত্যুর ঠিক আগে ও পরে একাধিক ব্যক্তির ওজন নিয়ে তিনি জানান , আত্মার ওজন ২১ গ্রাম। যদিও তাঁর এই মতামতকে বিজ্ঞানীরা গুরুত্ব দেননি।

১৮। হাতির উপর ড্রাগের পরীক্ষা

একটি হাতিকে ড্রাগ দিলে সে কি ধরনের আচরন করে তা দেখার জন্য  ১৯৬২ সালে ওয়ারেন থমাস নামক একজন  বিজ্ঞানীর নেতৃত্বেএক দল বিজ্ঞানী ওকলাহোমা সিটির লিঙ্কন পার্ক চিড়িয়াখানায়  একটি হাতির উপর পরীক্ষা চালান। তারা হাতিটিকে ২৯৭ মিলিগ্রাম এলএসডি দেন যা ছিল মানুষের সহ্যক্ষমতার প্রায় ৩ হাজার গুন। এই পরিমাণ ড্রাগ দেওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যেই হাতিটি মারা যায়।

১৯। কার্ডিয়াক ক্যাথেটেরাইজেশন:

জার্মান বিজ্ঞানী ওয়ার্নার ফোর্সম্যান ১৯২৯ সালে নিজের কাঁধ দিয়ে নিজেই একটি সার্জিকাল ক্যাথিটার হৃদপিণ্ড পর্যন্ত ঢুকিয়ে দেন। পরে নিজেই সেই অবস্থায় এক্স রে করে দেখেন। তাঁর এই অমানষিক পরীক্ষার জন্য তাঁকে বহিস্কার করা হয়। পরে ১৯৫৬ সালে প্রথম সফল কার্ডিয়াক ক্যাথেটেরাইজেশনের জন্য নোবেল পান তিনি।

২০। চোখ প্রসারণ পরীক্ষা :

এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুম গবেষক এবং মনো বিশেষজ্ঞ ইয়ান অসওয়াল্ড মানুষের ঘুমের প্যাটার্ন পরীক্ষার লক্ষ্যে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবকদের চোখ টেপ দিয়ে খুলে রাখা হয় এবং তাদের সামনে ৫ সেমি তীব্র আলোর ব্যবস্থা করা হয়। এরপর তিনি তাদের মৃদু ইলেকট্রিক শক দেন এবং  উচ্চ মাত্রার গান জোরে চালু করে দিয়ে শোনানো হয়। তবে সকলেই এসব পরীক্ষার শেষে ১২ মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে। পরে অসওয়াল্ড এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, নিয়মিত এবং পুনরাবৃত্তিমূলক একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্নের রিদম বা ছন্দ ঘুমের জন্য সহায়ক।

লেখিকা সম্পর্কেঃ পাপিয়া দেবী অশ্রু। শখ -বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে বেড়ানো, গান করা, ছবি আঁকা। লেখা – লিখিতে বেশ আগ্রহ থাকলেও তেমন ঘটা করে হয়ে উঠেনি কখনও। শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত আছি। ইচ্ছে আছে একেবারেই নতুন কিছু করার, যা বিশ্বজুড়ে সবার দেখার মতই। অদ্ভুত ইচ্ছে!!!