আড়ালে থেকে যাওয়া বাংলা সাহিত্যের ৫ জন প্রতিভাবান কবি

image-slider-1সেই বহুকাল বহুকাল আগে থেকেই কবিতা অজান্তে হলেও মানুষের বন্ধু হয়ে আছে। কবিতা পড়েই মানুষ বিদ্রোহী,আবেগী হয়েছে, ভালোবাসতে শিখেছে, অভিমানি হতে শিখেছে,ভাবতে শিখেছে,আবার এতো কিছুর পরও অনেকের কাছে পাগলের প্রলাপ হিসেবেও পরিগণিত হয়েছে। তবুও খুব কম মানুষই আছেন যাদের হঠাৎ কখনও ছন্দে বাধা দুটো লাইন ভাবায়নি কিম্বা উদ্বেলিত করেনি। হাজার পাতার একটা গল্প কিংবা একটা পুরো জীবনের গল্প অল্প ক’টা ছন্দে বাধা লাইনে কবিতাতেই সম্ভব।কবিদের কথা উঠলেই হয়ত শুধু ভাবনায় আসেন রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জসীমউদ্দীন, শামসুর রাহমান কিংবা ছোট বেলা থেকে পাঠ্য বইয়ে পড়ে আসা আর বর্তমানে ফেসবুক এর কল্যাণে। হয়ত সেখানেও অনেকের নাম জানিনা। আজ আমার এই লিখায় তেমনি ক’জন কবির প্রতি সম্মাননা থেকে লিখা হয়ত তাদের নাম শুনি নি বা শুনলেও মনে রাখিনি। হয়ত তারা যা সম্মান পেয়েছেন, তার চেয়ে কম পেয়েছেন।

১। আবুল হাসান

 ‘দু’চোখ ভরে যে দেখতে চাও

রঞ্জন রশ্মিটা চেনো তো’?

আমার অন্যতম প্রিয় একটি লেখা। কবিতাটির নাম প্রশ্ন। যার হয়ত আরো অনেক পাবার ছিল তেমনি একজন ক্ষণজন্মা কবি, কবি আবুল হাসান। তাই হয়ত নিজেকে নিয়ে লিখা ‘আবুল হাসান’ কবিতায় লিখেছিলেন,

‘সে এক পাথর আছে কেবলি লাবন্য ধরে,উজ্জ্বলতা ধরে আদ্র,

মায়াবী করুণ’

যতখানি পেয়েছেন তার প্রায় সবটাই মৃত্যুর পর। তার লিখা গল্পগুলোও গল্প সংকলন আকারে বের হয় তার মৃত্যুর অনেক বছর পর। বাংলা একাডেমী পুরষ্কার ও একুশে পদক প্রাপ্ত হন মৃত্যুর পর। ছোট থেকেই ছিলেন বাত জ্বরের রোগী। নিজের প্রতি খামখেয়ালীপনা, অবহেলা আর পরিশ্রমের ভারে শেষ করে ফেলেছিলেন নিজেকে অনেকটা স্বেচ্ছায়।হাসপাতালের বিছানায় যখন মৃত্যুর সাথে শেষ লড়াই চলছিল তখনও লিখে গেছেন। মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় তার শেষ কাব্যগ্রন্থ,’পৃথক পালংক’। শেষ সময়ে লিখেছিলেন,

‘ঝিনুক নীরবে সহো,নীরবে সহে যাও,

ভিতরে বিষের বালি,মুখ বুজে মুক্তো ফলাও!!

কবির অন্য দু’টি কাব্যগ্রন্থ হল ‘রাজা যায়,রাজা আসে’,’যে তুমি হরন করো’। ১৯৭৫ সালে এ ক্ষণজন্মা, আধুনিকতার কবি আমাদের ছেড়ে চলে যান।

২।কবি রফিক আজাদ

‘আমার ক্ষিদার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ,

ভাত দে হারামজাদা,তা না হলে মানচিত্র খাবো’

হয়ত অনেকেই কবিতার এই লাইনটা শুনেছি। খুব বেশি শুনেছি কয়েকটা দিন আগেই। হয়ত অনেকে এর আগে শুনিও নি।  সদ্য প্রয়াত কবি, কবি রফিক আজাদের লিখা। শুধু উনি নয় ওনার মত সকল শিল্পীদের নিয়ে বলতে গেলেই বলতে ইচ্ছে হয়,

‘তুমি বড় রঙ্গীন ছিলে গো,

এই আলোকছটায়”।

বেঁচে থাকা অবস্থায় ক’জন বা ছিলাম তার নাম মনে রাখার। কিন্তু মৃত্যুর পর বহু কিছু হারালাম।কবি সম্বন্ধে জানতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি যা জানা যায় তার সারসংক্ষেপ হয়,তিনি বড় ডানপিটে আর প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন। ছোট বেলায় পালিয়েছিলেন ঘর থেকে পি সি সরকারের কাছে যাদু শিখবেন বলে।লাঠিয়াল হবার শখ ছিল খুব।এক দাদার কাছে শিখতেও যেতেন।কৈশোরে সব শাসন উপেক্ষা করে ছুটে গিয়েছিলেন ভাষা শহীদদের স্মরণে খালি পায়ে মিছিল করেন।তিনি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও।বাংলা একাডেমী পুরষ্কার সহ বিভিন্ন পুরষ্কারে ভুষিত হন এই কবি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হল, ‘পাগলা গারদ থেকে প্রেমিকার চিঠি,অসম্ভবের পায়ে, চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া,’ ইত্যাদি।

কবিকে শেষ করি কবির লিখা ‘আমাকে খুঁজোনা বৃথা’ কবিতার ক’টা লাইন দিয়ে

‘আমার দু’চোখের অবিরল ধারা বয়ে গিয়ে

কানায়-কানায় ভ’রে দিচ্ছে সব ক’টি শুষ্ক নদী,

এবং দেখতে পাবে

শ্যামল শস্যের মাঠ

আমার বুকের নিচে আগলে রেখেছি. . .’।

৩।কবি আসাদ চৌধুরি

‘কোথায় পালালো সত্য?’

টেলিভিশন উপস্থাপনা বা কোন আয়োজন যেখানেই লোকটাকে দেখেছি, সব সময় একটা আদুরে সরল হাসি তার মুখে সব সময় থাকে। পান খেয়ে লাল করা মুখ।কিছুদিন আগে ওনার একটি সাক্ষাৎকার শুণলাম বহুদিন পর। ওনার উচ্চারন,আবৃত্তি মুগ্ধ করে।উচ্চারনেও সারল্য ভরা। কখনও শুণে থাকলে দেখবেন আঞ্চলিকতার যে টান তা লুকিয়ে রাখার এতটুকু চেষ্টা নেই। ওনার কবিতায় যেমন প্রতিবাদ আছে,তেমনি আছে জীবনের বর্ণণা। কিভাবে একটি কবিতায় ফুটিয়ে তোলা যায় জীবন ও জাগিয়ে তোলা যায় প্রতিবাদ তা কবির ‘রিপোর্ট ১৯৭১’ কবিতা পড়লে পাওয়া যায়। পাশাপাশি উনি অনেক শিশুতোষ রচনাও করে থাকেন।কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হল, তবক দেয়া পান,মেঘের জুলুম পাখির জুলুম,ভালোবাসার কবিতা’ ইত্যাদি।কবিকে নিয়ে শেষ করি কবির লিখা আরেকটি প্রিয় কবিতার লাইন দিয়ে,

এখন এ-সব স্বপ্নকথা

দূরের শোনা গল্প,

তখন সত্যি মানুষ ছিলাম

এখন আছি অল্প।

যে লাইনগুলো সত্যি প্রতি যুগে যুগে। আপনার এই সারল্য মাখা হাসি বেঁচে থাক আরো বহুদিন।

৪। শিতালং শাহ

 ‘পিঞ্জরায় থাকিয়া করলাই প্রেমেরও সাধন,

পিঞ্জরা ছাড়িয়া যাইতে,

না লাগে বেদন,

সুয়া উড়িল,উড়িল জীবেরও জীবন,

সুয়া উড়িল রে’

গানটার লাইনগুলো আমাদের অনেকেরই শোনা।প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ স্যার এর তৈরি করা শেষ চলচিত্রের গান।গানটির রচয়িতা শিতালং শাহ। যদিও এটি ওনার মুরশিদ প্রদত্ত নাম। আসল নাম মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ। উনি ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক সাধক এবং ধর্মপ্রান মানুষ।তাওহীদ,রিসালাত ও মানব জীবনের ভেদ রহস্য উদঘাটন ছিল তাঁর লিখার মূল বিষয়। যেমন তিনি লিখেছিলেন,

প্রাণধন কালা – ও কালা অপূর্ব মহিমা তোমার লিলা

নিশানা নমুনা নাই – সৎ রুপে তোমারে পাই

আছো তুমি শয়াল জোড়িয়া

ভাবের ভাবিনি হইয়া – নিজ নামে ডাকি প্রিয়া

একবার দরশন দিবায়নি কালিয়া-রে।

এই বিখ্যাত মরমী সাধক নিয়ে অনেক কিছু আমার নিজেরই এখনো জানার আছে। কখনো সুযোগ পেলে তাঁর সকল সংগ্রহ নিয়ে একবার বিশাল আকারে লিখবো। কিন্তু অনেক অনেকটাই জানার বাকী। ওনার মাজার রয়েছে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার বারঠাকুরী গ্রামে।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়

‘ছেলেটা খুব ভুল করেছে শক্ত পাথর ভেঙ্গে,

মানুষ ছিল নরম,

কেটে ছড়িয়ে দিলেই পারতো’

শক্তি চট্টোপাধ্যায় এর ‘ছেলেটা’ কবিতাটি ’২২ শে শ্রাবন’ সিনেমায় আমরা হয়ত অনেকেই শুনেছি।আজকের লিখার শেষ কবি,কবি শক্তি চট্টোপধ্যায়।আরেকজন অকাল প্রয়াত কবি। কবির যে কবিতাখানি খুব বেশি উদ্দেলিত করে তা হল,’অবনী,বাড়ি আছো?’

দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া

কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া

‘অবনী বাড়ি আছো?’

প্রথম জীবনে লিখা শুরু করেন স্ফুলিংগ সমাদ্দার ছদ্ম নামে। খ্যাতির শুরু বলতে হয় সুনীল গঙ্গোপধ্যায় সম্পাদিত ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় লিখার মাধ্যমে। প্রথম জীবনে তাঁর লিখার মূল উপজীব্য ছিল শোষনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ,বিদ্রোহ নিয়ে। কিন্তু তিনি প্রেম,মানব জীবন সহ বিভিন্ন আঙ্গিকে তাঁর লেখনিকে প্রকাশ করেছেন। ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য ,ধর্মে আছো জিরাফেও আছো ,সোনার মাছি খুন করেছি’  ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। কবিকে নিয়ে শেষ করি কবির ‘আমি যাই’ কবিতা দিয়ে যা বাস্তবতার সম্মীলন,

‘যেখানেই থাকো

এ পথে আসতেই হবে

ছাড়ান্ নেই

সম্বল বলতে সেই

দিন কয়েকের গল্প

অল্প অল্পই

আমি যাই

তোমরা পরে এসো

ঘড়ি-ঘন্টা মিলিয়ে

শাক-সবজি বিলিয়ে

তোমরা এসো’।

এটুকুতেই সমাপ্তি আজ। বেঁচে থাক সকল কবি তাঁর কবিতায়, বেঁচে থাকুক কবিতার জন্য ভালোবাসা বা ভালোবাসার জন্য কবিতা।

লেখক সম্পর্কেঃ মোঃ মাহফুজুল হক মিথুন। ভালোবাসি কবিতা লিখতে,বই পড়তে,এক সময় ছিল বাগান করা যেটা সুযোগের অভাবে আর হয়না। প্রায় দেড় বছর ধরে যুক্ত আছি জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি,বাংলাদেশ এর একটি প্রজেক্ট এ।যদিও কোথাও তেমন লিখালিখির সুযোগ অদ্যাবধি খুব কম।এক সময় একটি রম্য প্রকাশনায় লিখতাম।