৫ ইরানি মুভি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে

image source-http://www.kickasstoo.com/
image source-http://www.kickasstoo.com/

আমরা বিভিন্ন দেশের সিনেমা উপভোগ করে থাকি । আজ কিছু ইরানী সিনেমার কথা নিয়ে হাজির হলাম আপনাদের কাছে ।  ইরানী সিনেমা বহুদিন ধরে আমাদের বিশ্ব সিনেমা জগতে ভিন্নধারার অসাধারণ সব চলচ্চিত্র উপহার দিয়ে আসছে । এই সিনেমাগুলোর মন ছুঁয়ে যাওয়া, হৃদয়ে দাগ কেটে যাওয়া বাস্তবসম্মত গল্প, অভিনয়শিল্পীদের নিপুণ অভিনয় এবং অতিনাটকীয়তা বিবর্জিত পরিস্থিতি আমাদের ভাল লাগার এক অন্য ভুবনে নিয়ে যায় । কোন সময় হয়ত নিজেদের জীবনের কোন ঘটনার সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায় এতে, কখনও কখনও কাহিনীর গভীরতা আমাদের চোখের কোনে জল এনে দেয় আবার কখনও কখনও অভিনয় শিল্পীদের অসাধারন অভিনয় সিনেমা নয় আমাদের অন্যরকম এক বাস্তব জগতের স্বাদ দেয় । আজ আপনাদের সাথে এমনই কিছু অসাধারন ইরানী সিনেমার পরিচয় করিয়ে দেব যেগুলো দেখার পর আপনি কিছুক্ষণের জন্য হলেও আপনার ছোটকালে ফিরে যাবেন । কিছুক্ষণের জন্য গল্পের মধ্যে কোন একটি চরিত্র নিজের বলে মনে হবে, মনে হবে এসব কথা, অভিমান বা পাওয়া না পাওয়ার আনন্দ, বেদনা ছোটকালে কখনও আপনারও ছিল । কিছু কিছু ঘটনা দেখে মনে হবে এগুলো সিনেমা নয় বাস্তবতার প্রতিফলন । চলুন জেনে আসি সিনেমাগুলো সম্পর্কে ।

১। A Separation ( 2011)

অভিনয়ে পেম্যান মোয়াদি , লেইলা হাতামি , শিশুশিল্পী কিমিয়া হুসেইনি, শাহাব হুসেইনি এবং আরও অনেকে ।

সিনেমাটি একটি অস্কার জিতেছে, গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার, গোল্ডেন বার্লিন বিয়ার, ডারবান আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসবে সেরা চলচিত্র পুরস্কার সহ ৭৭ টি আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় পুরস্কার জয় করেছে। তাছাড়াও আরও ৪২ টি আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে।

নাদের এবং সিমিন বিবাহিত মধ্যবিত্ত সুখী পরিবার । তাদের ১৪ বছরের বিবাহিত জীবন এবং তারমেহ নামে তাদের ১১ বছরের একটি মেয়ে রয়েছে । সিমিন আরও ভাল জীবন যাপন করার জন্য তেহরান ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে চায় নাদের আর তারমেহকে নিয়ে । কারণ সিমিন চায় না তারমেহ এরকম পরিবেশে বেড়ে উঠুক । কিন্তু নাদের তার বাবা যে কিনা আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত তাকে ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না । নাদের যখন তেহরান ছাড়তে অনিচ্ছুক সিমিন তখন নাদেরকে ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ডিভোর্স এর আবেদন করে । কিন্তু পারিবারিক আদালত সমস্ত কিছু পরীক্ষা করে সিমিনের ডিভোর্সের আবেদন নাকোচ করে দেয় কারণ আদালত ডিভোর্স দেয়ার পেছনে তেমন কোন কারন খুঁজে পায় না । এতে সিমিন তার মেয়ে তারমেহ এবং নাদেরকে ছেড়ে তার বাবা-মায়ের কাছে চলে যায় । এভাবেই বিভিন্ন ঘটনা, দুর্ঘটনা এবং মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে সিনেমাটি পারিবারিক জীবনের কিছু কঠিন বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে ।

২ । The White Balloon (1995)

অভিনয়ে শিশুশিল্পী আইদা মোহাম্মাদখানি , শিশুশিল্পী মোহসেন কাফিলি, ফেরেস্তেহ সাদ্রে ওরাফাই এবং আরও অনেকে ।

সিনেমাটি  সেরা আন্তর্জাতিক চলচিত্র ক্যটাগরিতে  পুরস্কার এবং সেরা আন্তর্জাতিক জুড়ি পুরস্কারসহ মোট ৫ টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার জয় করেছে এবং আরও ৩ টি  আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে ।

সিনেমাটি একটি ছোট শিশুকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে । সাত বছরের ছোট্ট শিশু রাজিয়া মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান । আজ তেহরানে বর্ষবরণ উৎসব । তেহরানের একটি ঐতিহ্য হচ্ছে নববর্ষ উদযাপনের দিন মাছ ধরা বা মাছ কেনা । সেজন্য ছোট্ট রাজিয়া একটি সুন্দর গোল্ডফিশ কেনার বায়না করে যা সে কিছুক্ষণ আগে বাজার করে আসার সময় দেখে এসেছে । কিন্তু রাজিয়ার মায়ের কাছে তখন পর্যাপ্ত টাকা নেই । কিন্তু রাজিয়া জিদ করতে থাকে যে তার সেই গোল্ডফিসটি লাগবেই । কিন্তু গোল্ড ফিসটি কেনার জন্য পুরো ১০০টোমান লাগবে । এরপর রাজিয়া তার ভাইকে অনুরোধ করে তার মাকে রাজি করানোর জন্য এবং সেজন্য সে তার ভাইকে তার খুব পছন্দের একটি জিনিস দিয়ে দিতে রাজি হয় যা সে কখনও তার ভাইকে ধরতে দিতে চাইত না যা তার চাচা তাকে উপহার দিয়েছিল । এরপর সেই জিনিসের বিনিময়ে তার ভাই তার মাকে টাকা দিতে রাজি করায় এবং রাজিয়ার হাতে ৫০০ টোমান দেয় । কিন্তু এক সময় রাজিয়া তার সেই পুরো ৫০০ টোমান হারিয়ে ফেলে । এরপর সে ভয়ে আর বাড়ি যায় না । এভাবেই সিনেমার কাহিনী সামনে এগিয়ে চলে ।

ছোট্ট রাজিয়ার কান্না,ভয়, জেদ এবং গোল্ডফিস কিনতে না পারার দুঃখ আপনাকে আপনার ছোটকালের কোনকিছু পাওয়ার জন্য মায়ের সাথে জেদ করার কথা মনে করিয়ে দেবে ।

৩। Turtles can Fly ( 2004)

Original Cinema Quad Poster - Movie Film Posters
Original Cinema Quad Poster – Movie Film Posters

অভিনয়ে সোরান ইব্রাহিম, আভাজ লাতিফ, সাদ্দাম হুসাইন ফয়সাল এবং আরও অনেকে ।

সিনেমাটি এনোনিমুল আন্তর্জাতিক ইন্ডিপেন্ডেন্ট চলচিত্র পুরস্কার, বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচিত্র পুরস্কার, শিকাগো আন্তর্জাতিক চলচিত্র পুরস্কারসহ ৫৩ টি আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় পুরস্কার জয় করেছে । তাছাড়াও আরও ৭টি জাতীয় এবং  আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছে ।

সিনেমাটি ইরাক- তুর্কি সীমান্তে একটি কুর্দি শরণার্থী শিবিরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে । ১৩ বছরের ছেলে “স্যাটেলাইট” যে স্থানীয় গ্রাম্য এলাকায় ডিশ এন্টেনা স্থাপন এর জন্য সুপরিচিত এবং সে স্থানীয় শিশুদের নেতা । সে স্থানীয় শিশুদের নিয়ে খুব বিপদজনক কিন্তু প্রয়োজনীয় কাজ মাইনফিল্ডের মাইন অপসারণের কাজ শুরু করে । এই শিশুদের মধ্যে বেশিরভাগ শিশুই কোন না কোনভাবে শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত । এরপর স্যাটেলাইট স্থানীয় বাজারে অবিস্ফোরিত মাইন বিক্রয়ের ব্যবসা শুরু করে এবং সে একটি অনাথ মেয়ে এগ্রিন এর প্রেমে পড়ে যার একটি প্রতিবন্ধী কিন্তু মমতাময়ী ভাই আছে  এবং একটি অন্ধ শিশু সন্তান আছে । এগ্রিন যুদ্ধ সৈনিকদের দ্বারা গনধর্ষণের শিকার হয় এবং তার ফলস্বরূপ সেই শিশুটি তার গর্ভে আসে । এগ্রিন কোনভাবেই তার অতীতের ট্রমা থেকে বের হয়ে আসতে পারে না যখন তার সামনে তার বাবা-মাকে মেরে ফেলা হয় এবং তাকে গনধর্ষণ করা হয় । বিভিন্ন হৃদয় বিদারক ঘটনার মধ্যে দিয়ে সিনেমার কাহিনী এগিয়ে চলে ।

৪। The Circle (2000)

অভিনয়ে নার্গিস মামিযাদেহ, মারিয়াম পালভিন আলমানি, মোজগান ফারামাজি এবং আরও অনেকে ।

সিনেমাটি সান সেবাস্তিয়ান আন্তর্জাতিক চলচিত্র পুরস্কার , সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক চলচিত্র পুরস্কারসহ ১২ টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার জয় করেছে এবং আরও দুটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছে ।

সাময়িকভাবে দুজন মহিলা কারাগার থেকে মুক্তি পায় এবং একজনের গ্রামের বাড়িতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পালিয়ে যাওয়ার সময় তারা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। একই সময়ে তাদের আরেকজন বান্ধবী যে জেল থেকে পালিয়েছে সে গর্ভবতী থাকায় তার গর্ভপাত করার দরকার হয়ে পড়ে । সিনেমাটিতে এই প্রতিটা মহিলার ঘুরে দাঁড়ানোর এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার গল্প তুলে ধরা হয়েছে । যদিও সিনেমাটি ইরানে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ।

৫ । The Song Of Sparrow (2008)

অভিনয়ে মোহাম্মাদ আমির নাজি, মারিয়াম আকবারি, হামিদ আগাহি , স্কাবনাম আখলাঘি এবং আরও অনেকে ।

সিনেমাটি বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচিত্র পুরস্কার, এশিয়া প্যাসিফিক স্ক্রীন পুরস্কারসহ ৭টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার জয় করেছে এবং আরও দুটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে ।

করিম একটি অস্ট্রিচ পালন ফার্মে চাকুরি করে । একদিন ফার্ম থেকে একটি অস্ট্রিচ পালিয়ে যায় এবং তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না । এজন্য তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় । এদিকে তার বড় মেয়ে যে কিনা কানের যন্ত্র ছাড়া শুনতে পায় না সে তার কানের যন্ত্রটি হারিয়ে ফেলে পানির মধ্যে কিন্তু যখন খুঁজে পায় সেটা আর কাজ করে না । করিম মরিয়া হয়ে ওঠে মেয়ের কানের যন্ত্র কিনে দিতে কিন্তু তা কিনতে অনেক টাকা প্রয়োজন । তাদের টানাটানির সংসার কিন্তু তারপরেও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অদ্ভুত এক ভালবাসার বন্ধন ঘিরে থাকে  । করিম সংসার চালানোর জন্য শহরে মোটরসাইকেলে আরোহী আনা  নেয়ার কাজ শুরু করে । টানাটানির সংসার হলেও করিম তার ছেলে মেয়েদের বাইরে কাজ করতে দিতে চায় না । কিন্তু তার ছোট্ট ছেলেটি গোল্ড ফিশ কেনার টাকা জোগাড় করার জন্য রাস্তায় ফুল বিক্রি করে এবং তার বোনকেও সাথে নেয় । করিম এতে ছেলের উপর রেগে যায় । একদিন করিম দুর্ঘটনায় তার পা ভেঙ্গে ফেলে তখন সংসার চালানোর জন্য কাজে নামে তার ছোট্ট ছেলেটি কিন্তু করিমের তখন অসহায় হয়ে তা দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না ।

লেখিকাঃ শারমীন আক্তার সেতু। আমি পেশায় একজন মনোবিজ্ঞানী । কবিতা লিখতে এবং পড়তে পছন্দ করি । মনোবৈজ্ঞানিক ফিচার লেখার সাথে যুক্ত আছি। তাছাড়াও অন্যান্য বিষয়েও লিখতে এবং জানতে পছন্দ করি । আমি এর আগে পরামর্শ .কম এ লেখার সাথে যুক্ত ছিলাম । এখন কিছু ইংরেজি সাইটে অনুবাদের কাজ করছি । আমার শখ ভ্রমণ এবং গান গাওয়া । বাগান করতে পছন্দ করি এবং বিভিন্ন গাছ,ফুল্‌,ফল এবং নতুন নতুন জায়গার সাথে পরিচিত হতে ভাল লাগে।