উত্তরের সুর ও আরো ৫টি ভিন্ন স্বাদের বাংলাদেশি চলচ্চিত্র

image source-http://www.dw.com/
image source-http://www.dw.com/

এই লেখাটি পড়ার সময় না থাকলে, শুনতে পারেন এর অডিও ভার্সন। ক্লিক করুন নিচের প্লে-বাটনে।

সিনেমা আমাদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম । দুঃখজনক হলেও সত্যি যে হলিউড এবং বলিউডের সিনেমার দৌরাত্ম্যের এই যুগে বাংলা সিনেমা খুব একটা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না । কিন্তু বাংলাদেশেও একসময় অনেক ভাল সিনেমা হতো এবং এখনও হচ্ছে কিন্তু আমরা হয়ত প্রচারণার অভাবে সেসব সিনেমা সম্পর্কে জানতে পারছিনা । আসুন আজ আপনাদের সাথে এমনই কিছু ভাল লাগার মত বাংলা সিনেমার পরিচয় করিয়ে দেব ।

এই সিনেমাগুলো গতানুগতিক বাণিজ্যিক সিনেমার মত নাচ, গান বা অতি নাটকীয়তায় ভরপুর নয় তবে এগুলোর বাস্তবসম্মত কাহিনী, নিপুণ নির্মাণ কৌশল এবং অভিনয় শিল্পীদের মন ছুঁয়ে যাওয়া অভিনয় আপনাদের চোখে জল এনে দেবে । কিছুক্ষণের জন্য আপনাদের নিয়ে যাবে অদ্ভুত ভাল লাগার এক জগতে । যারা সিনেমাতে বাস্তবতার ছাপ খুঁজে বেড়ান তারা সিনেমাগুলো উপভোগ করতে পারেন । আশা করা যায় ছবিগুলো দেখে দর্শকরা নিরাশ হবেন না ।

১। উত্তরের সুর

অভিনয়েঃ উৎপল, লুসি এবং মেঘলা।

সিনেমাটি ৪টি বিভাগে জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার জয় করেছে ।

সিনেমাটিতে উত্তরাঞ্চলের এক দরিদ্র বাউল শিল্পীর জীবন তুলে ধরা হয়েছে । বাউল আর তার মেয়ে রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করে । গান গেয়ে যে সামান্য টাকা তারা উপার্জন করে তা দিয়ে তাদের সংসার চলে না । মাঝে মাঝে বাউলের স্ত্রী পাড়া প্রতিবেশীদের থেকে চাল ডাল ধার করে খাবারের ব্যবস্থা করে । প্রচণ্ড দারিদ্রতার মধ্যেও তাদের সংসারে অদ্ভুত এক ভালবাসার বাঁধন থাকে । তাদের দারিদ্রতার জন্য তারা তাদের একমাত্র মেয়ের চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারে না । একসময় গ্রামে ডিশ এন্টেনা এলে কেউ আর বাউল গান শুনতে চায় না । ধীরে ধীরে বাউলের সংসারে অভাব বাড়তে থাকে কিন্তু বাউল তার গান ছেড়ে অন্য কোন পেশা বেছে নিতে নারাজ কারণ তার মতে বাউলদের একটা আত্মসম্মান আছে । তারা যেনতেন কাজ করতে পারবে না । এর মধ্যে তাদের একমাত্র মেয়ের এক কঠিন রোগ ধরা পড়ে । মেয়েটির অনেক দিনের ইচ্ছা সে পোলাও খাবে কিন্তু তার বাবা মা তাকে বলে ঈদের দিন ছাড়া পোলাও খাওয়া যাবে না । মেয়েটি অধীর আগ্রহে ঈদের দিনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে যখন সে পোলাও খেতে পারবে কিন্তু তার আর পোলাও খাওয়া হয় না । এভাবেই নানা হৃদয়বিদারক ঘটনার মধ্যে দিয়ে ছবির কাহিনী এগিয়ে চলে ।

২। ক্ষতিপূরণ

অভিনয়েঃ আলমগীর, রোজিনা, শিশুশিল্পী বিনতু।

সিনেমাটি একটি বোবা শিশুকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। শওকত এবং শরীফ দুজন ব্যবসা সুত্রে বন্ধু এবং শেয়ার পার্টনার। কিন্তু শওকতের পুরো ব্যবসার অংশ নিজে একাই ভোগ করার জন্য শরীফ তার বন্ধু শওকতকে খুন করে। কিন্তু এই খুনের সময় এক দম্পতি এবং তাদের শিশু কন্যা তা দেখে ফেলে । এরপর শরীফ এই দম্পতিকেও খুন করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ছোট্ট বোবা মেয়েটির সামনে তার মাকে চাকু দিয়ে খুন করে। কোনভাবে মেয়েটি সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে মেয়েটিকে খুঁজে পায় আলম যে কিনা তার স্ত্রীকে আত্মহত্যা করার অপবাদে মাতাল জীবনযাপন করে । সে এই বোবা মেয়েটির মধ্যে তার মৃত মেয়েকে খুঁজে পায় । কিন্তু একদিন মেয়েটি রাস্তায় তার মায়ের খুনি ড্যানিকে দেখতে পায়। এরপর থেকে ড্যানি আর শরীফ মেয়েটিকে নিজেদের জন্য হুমকি মনে করে তাকে বিদেশে পাচার করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় । এভাবেই বিভিন্ন ঘটনা আর দুর্ঘটনার মধ্যে দিয়ে ছবির কাহিনী এগিয়ে চলে ।

৩। মাটির ময়না

অভিনয়ঃ জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, রোকেয়া প্রাচী, লামিছা রিমঝি , সোয়েব ইসলাম ,নুরুল ইসলাম বাবু, রাসেল ফারাজি ।

সিনেমাটি দুটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার জয় করেছে এবং আরও দুটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল ।

কাজি যে কিনা একজন রক্ষণশীল মুসলমান । সে জোর করে তার ছেলে আনুকে মাদ্রাসায় পড়তে পাঠায় । সে আধুনিক কোন কিছু মেনে নিতে চায় না । কাজি একজন হাতুড়ে ডাক্তারও । সে গ্রামের অনেক মানুষের চিকিৎসা করে । কাজির গোঁড়া মানসিকতার জন্য তার আদরের মেয়ে আসমা অসুস্থ হয়ে মারা যায় । এর মধ্যেই আনুর সাথে মাদ্রাসায় এক বন্ধুর পরিচয় হয় যার কিনা হরেক জিনিসের একটি লুকানো ঘর আছে । সেখানে সে পুরনো টায়ার,কাচের টুকরো এবং আরও অনেক পরিত্যক্ত জিনিস কুড়িয়ে এনে রেখে দেয় । মাঝে মাঝেই সে অদ্ভুত কথা বলে । এজন্য মাদ্রাসার সবাই বলে তার উপর জীনের আছর পড়েছে । এদিকে কাজির গ্রামে পাকিস্থানি মিলিটারিরা হামলা করে । সবাই চলে যেতে চায় কিন্তু কাজি বলে  ঘর বাড়ি টাকা পয়সা ছেড়ে সে কোথাও যাবে না  । এভাবেই অনেক দ্বন্দ্ব, অনেক বিতর্কের মধ্যে দিয়ে সিনেমার গল্প এগিয়ে চলে ।

৪। বৃহন্নলা

অভিনয়ঃ সোহানা সাবা, ফেরদৌস, আজাদ আবুল কালাম,ইন্তেখাব দিনার  ।

সিনেমাটি গ্রাম্য রাজনীতির উপর ভিত্তি করে নির্মিত । গ্রামের একদল গোঁড়া মুসলমান এবং একদল গোঁড়া হিন্দু নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে । এই অপরাধগুলো তারা করে একটি পুরনো গাছের দোহাই দিয়ে । এই গাছ সর্বনাশা এবং এই গাছের কাছে যে যায় সে মারা যায় । গ্রামে ভাল কোন এম বি বি এস ডাক্তার নেই । ফেরদৌস গ্রামে ডাক্তার হয়ে আসে এবং এসে গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয় । সাবা একজন হিন্দু বিবাহিত মহিলা । তাকে চক্রান্তের ফাঁদে ফেলে ফেরদৌসকে গ্রাম ছাড়া করার দায়িত্ব দেয়া হয় । হিন্দুরা চায় সরকারের ঐ খাস জমিতে যেখানে ঐ খুনি গাছটি রয়েছে সেখানে একটি মন্দির করতে আর মুসলমানরা চায় মসজিদ করতে যেন গাছের দোষ কেটে যায় । এজন্য ঐ জমির গাছটিকে খুনি গাছ সাব্যস্ত করা হয় এবং এই গাছের নিচে একের পর এক খুন হতে থাকে । গল্পের শুরু থেকে রহস্য আর উত্তেজনা আপনাকে নিয়ে যাবে এমন এক চিন্তার জগতে যেখানে আপনি অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াবেন ।

৫। শাস্তি

অভিনয়ঃ রিয়াজ, পূর্ণিমা , ইলিয়াস কাঞ্চন।

সিনেমাটি একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার জয় করেছে এবং গোল্ডেন জুবিলী অডিয়েন্স পুরস্কার জয় করেছে। এছাড়াও আরও অনেকগুলো ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার জয় করেছে ।

ছবির শুরু হয় চন্দনা আর সিদাম এর খুনসুটি দিয়ে । গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের বেঁচে থাকার সংগ্রামের গল্প । দুখুরাম, সিদাম আর রাধার সংসার । দুখুরাম আর সিদাম দুই ভাইয়ে গলায় গলায় ভাব । সেখানে চন্দনা বউ হয়ে আসে । দুখুরামের স্ত্রী রাধা মা হতে পারবে না বলে সিদাম চন্দনা আর তার নব্যজাত সন্তানকে রাঁধার কোলে তুলে দেয় । কিন্তু রাঁধা তা জানে না । সে ভাবে চন্দনা আর কোনদিন মা হতে পারবে না । সেজন্য রাঁধা তার সন্তানকে চন্দনার কাছে ভিড়তে দেয় না । এ নিয়ে তাদের সুখের সংসারে অশান্তির আগুন জ্বলে ওঠে । অশান্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে দুখুরাম রাগের মাথায় তার স্ত্রীকে খুন করে কিন্তু সিদাম এই খুনের দায় চন্দনার উপর চাপিয়ে দেয় কারন তার মতে বউ মরলে বউ পাওয়া যাবে কিন্তু ভাই মরলে ভাই পাওয়া যাবে না । চন্দনা সিদামের এ কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে পুলিশের কাছে তার উপর দেয়া মিথ্যা খুনের দায় শিকার করে নেয় । এভাবেই হাসি,কান্না, ঘটনা, দুর্ঘটনা নিয়ে সিনেমাটি আমাদের সমাজের কিছু কঠিন বাস্তবতাকে তুলে ধরেছে ।

৬। নিরন্তর

অভিনয়ঃ শাবনূর, ইলিয়াস কাঞ্চন, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, লিটু আনাম এবং আরও অনেকে ।

সিনেমাটি সেরা চলচিত্র ক্যাটাগরিতে ২টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার জয় করেছে । একটি আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভালে স্পেশাল জুরি এ্যাওয়ার্ড জয় করেছে এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশ থেকে অস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে ।

একটি নিম্ন মধ্য বিত্ত পরিবারের জীবন যাত্রা নিয়ে সিনেমাটি নির্মিত । ঢাকার একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল । সিনেমার নায়িকা তিথির বাবা চিকিৎসার অভাবে অন্ধ হয়ে যাচ্ছিল এবং খুব বেশীদিন আর কাজ করতে পারছিল না । এদিকে হিরু তিথির ভাই একজন বেকার যুবক যে কিনা কোন চাকুরি বা কাজ করতে চায় না । পরিবারের বেশীরভাগ টাকা হিরুর পেছনে নষ্ট হতে থাকে । এজন্য পরিবারের দায়িত্বের ভার পড়ে সুন্দরী তিথির উপরে। তিথি পরিবারকে সাহায্য করার জন্য নিরুপায় হয়ে পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়। এভাবেই টানাপোড়ন আর পারিবারিক অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে যাওয়া গল্পের সংলাপ,অভিব্যক্তি আর কঠিন বাস্তবতা আপনাকে কিছুক্ষনের জন্য ভাবনার এক অন্য জগতে নিয়ে যাবে ।

লেখিকা সম্পর্কেঃ শারমীন আক্তার সেতু। আমি পেশায় একজন মনোবিজ্ঞানী । কবিতা লিখতে এবং পড়তে পছন্দ করি । মনোবৈজ্ঞানিক ফিচার লেখার সাথে যুক্ত আছি । তাছাড়াও অন্যান্য বিষয়েও লিখতে এবং জানতে পছন্দ করি । আমি এর আগে পরামর্শ .কম এ লেখার সাথে যুক্ত ছিলাম । এখন কিছু ইংরেজি সাইটে অনুবাদের কাজ করছি । আমার শখ ভ্রমন এবং গান গাওয়া । বাগান করতে পছন্দ করি এবং বিভিন্ন গাছ,ফুল্‌,ফল এবং নতুন নতুন জায়গার সাথে পরিচিত হতে ভাল লাগে ।