৭টি বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম, যেগুলোর সূচনা হয়েছিল কারাগারে

কারাজীবন বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে অন্ধকার,জীর্ণদশার এক ভয়ঙ্কর জীবনচিত্র। আর সে বদ্ধ কারাগারে বসে প্রিয় ব্যক্তিত্বরা লিখে যাচ্ছেন তাদের শ্রেষ্ঠ মাস্টারপিসগুলো – এ কথা কারো জন্য কল্পনা করা কষ্টকর হলেও, বাস্তবে তা ঠিকই ঘটেছে। কারাজীবনের একাকিত্ব ও ক্ষোভ কয়েকজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে কলম ধরতে, যার ফলে সৃষ্টি হয়েছে কিছু শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম। কারাগারের বন্দী জীবন তাদের অন্তর্দৃষ্টিকে এবং কাজকে প্রভাবিত করেছে বলেই মার্টিন লুথার কিংয়ের অমর ‘জেলখানার চিঠি’ কিংবা অস্কার ওয়াইল্ডের আত্মোপলব্ধিমূলক রচনা সাহিত্যে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে।
কারাগারের অন্ধকার থেকে বাহিরের আলোতে আসা এরকম ৭টি সাহিত্যকর্ম নিয়ে আজকের আয়োজন –

ডন কুইক্সোট/ কিহোতে – মিগুয়েল দে সার্ভেন্টেস : কে ভাবতে পেরেছিল পপ সংস্কৃতির আদর্শবাদী মডেল কিংবা নাটকীয় উপন্যাসটির উৎপত্তি হয়েছে কারাগার থেকে? হাস্যরসাত্মক এবং ব্যঙ্গাত্মক লেখনীর মিশ্রনে সৃষ্টি ডন কুইক্সোট প্রথম আধুনিক ইউরোপীয় উপন্যাস বলে বিবেচিত, এবং তার নায়ককেও “নাইট ইন শাইনিং আর্মর” হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উপন্যাসটিতে মূলত ১৭ দশকের স্পেনের সামাজিক অবস্থা তোলে ধরা হয়েছে। স্পেনের ঋণ সংক্রান্ত সমস্যার জন্য কারাগারে থাকাকালীন সময়ে সার্ভেন্টেস তাঁর মহৎ কর্মের অংশটি লিখেছিলেন।

ট্রাভেলস অব মার্কো পোলো- রুস্টচিলো দ্য পিসা : মার্কো পোলো ছিলেন ভেনিসের একজন পর্যটক। মাত্র ১৭ বছর বয়সে এশিয়ার উদ্দেশ্যে তিনি তার ভ্রমণ শুরু করেন। প্রায় ১৫,০০০ মাইল ভ্রমণ শেষে, ২৪ বছর পর তিনি জেনোয়া যুদ্ধে অংশ নিতে ইতালিতে ফিরে আসেন। জেনোয়ার বিপক্ষে একটি নৌবহরকে নেতৃত্ব দেয়াকালীন সময়ে মার্কো পোলোকে বন্দী করা হয়। কারাগারে পোলো অধিকাংশ সময়ই সহবন্দী রুস্টচিলোকে নিজের ভ্রমণ কাহিনী শুনাতেন। পরবর্তীতে রুস্টচিলো এ ভ্রমণ স্মৃতিগুলো বই আকারে প্রকাশ করেন। ‘ট্রাভেলস অব মার্কো পোলো’ নামের বইটি খুব দ্রুত ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, আর পশ্চিমারাও সুদূরের পূর্ব সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে শুরু করেন।

সিভিল ডিস অবিডিয়েন্স- হেনরি ডেভিড থোরো : হেনরি ডেভিড থোরোর ‘সিভিল ডিস অবিডিয়েন্স’ নামক প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৪৯ সালে। হেনরি কারাগারের বাসিন্দা ছিলেন না। তবে সরকারকে ট্যাক্স পরিশোধে অস্বীকৃতি জানালে ( কারণ এই ট্যাক্স সম্পর্কে তার কিছু মতানৈক্য ছিল) তাকে এক রাত কারাগারে কাটাতে হয়। আর এই একটি রাতই তাকে অনুপ্রেরণা যোগায় রাষ্ট্রের বিভিন্ন অসঙ্গতি নিয়ে লেখা শুরু করতে। প্রবন্ধটিতে হেনরি লিখেছিলেন “এমন এক সরকারের অধীনে যে অন্যায়ভাবে কারাদণ্ড দেয়, সেখানে ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির জন্যও সত্যিকারের স্থান হচ্ছে কারাগার।”

লেটার ফ্রম বার্মিংহাম জেল- মার্টিন লুথার কিং : বার্মিংহামের আলবামায় জাতিগত বিচ্ছেদের বিরুদ্ধে একটি অহিংস প্রতিবাদ সংগঠিত করায়, ১৯৬৩ সালে মার্টিন লুথার কিংকে আটক করা হয়। বার্মিংহামের একদল পাদ্রীবর্গকে (যারা তার আন্দোলনের নিন্দা জানান এবং তাকে বাহ্যিক আন্দোলনকারী বলে অভিহিত করেন) নিজের প্রতিক্রিয়া জানাতে মার্টিন লুথার পত্রিকার খালি অংশ ও কারাগারের টয়লেট পেপারে লিখতে শুরু করেন, যেখানে তিনি লিখেন তার অমর বাণী “যেকোন জায়গায় অবিচার সর্বত্র ন্যায়বিচারের জন্য হুমকি”। পরে তার সহযোগীরা লেখার টুকরোগুলো সংগ্রহ করে, এবং তার মুক্তির কিছুদিন পূর্বে তা প্রকাশ করা হয়। ‘লেটার ফ্রম বার্মিংহাম জেল’ খুব দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পরে, এবং তা আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের এক অনুপ্রেরণা হয়ে উঠে !

দে প্রফুন্দিস -অস্কার ওয়াইল্ড : বুদ্ধিদীপ্ত ও রসাত্মক সাহিত্য সৃষ্টিতে অস্কার ওয়াইল্ড ছিলেন বিখ্যাত। তবে কারাগারে থাকাকালীন সময়ে তার লেখনীতে ফুটে উঠে মলিনতা ও স্ব-প্রতিবিম্ব। মানুষের সাথে (বিশেষ করে লর্ড আলফ্রেড ডগলাস) অভদ্র ব্যবহারের জন্য অস্কার ওয়াইল্ডকে দুই বছর কারাগারে কাটাতে হয়। কারাগার থেকে ওয়াইল্ড নিজের অনুতাপের অনুভূতি প্রকাশ করে ডগলাসকে একটি চিঠি লিখেন। ওয়াইল্ডের মৃত্যুর পর তার এই আত্মোপলব্ধিমূলক লেখা প্রকাশ পায়, লেখাটি ছিল অনুতাপ ও অনুতাপ থেকে মুক্তির এক আধ্যাত্মিক যাত্রা !

কনভার্সেশনস উইথ মাইসেলফ- নেলসন ম্যান্ডেলা : দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ‘ব্ল্যাক প্রেসিডেন্ট’ হওয়ার আগে নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন রবেন আইল্যান্ডে কারাগারের এক বন্দী, যেখানে তিনি ২৭ বছরের দীর্ঘ কঠিন সময় কাটিয়েছেন। ১৯৭৪ সালে তিনি কারাগারে বসে গোপনে আত্মজীবনী লিখা শুরু করেন, যেখানে উঠে আসে তার বিপ্লবী ও বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের বহু কথা। ১৯৯৪ সালের আগ পর্যন্ত এই আত্মজীবনীটি প্রকাশিত হয়নি, সেসময় ম্যান্ডেলা তার বিখ্যাত বই ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’ লিখতে গিয়ে তার আত্মজীবনীর সাহায্য নিয়েছিলেন।

ইন দ্যা বেলি অব দ্যা বিস্ট -জ্যাক অ্যাবট : ইন দ্যা বেলি অব দ্যা বিস্ট বইটিতে জ্যাক অ্যাবটের ২৫ বছরের কারাজীবনের বর্ণনা রয়েছে, তাছাড়া রয়েছে কারাগারের নিষ্টুরতা ও অন্যায় একজন ব্যক্তির মানসিক অবস্থাতে কি প্রভাব ফেলে – তার ভীতিকর বর্ণনা! বইটিতে অ্যাবট ও বিখ্যাত লেখক নর্মান মেইলারের মধ্যেকার চিঠিপত্র যুক্ত করা হয়। মেইলার অ্যাবটের লেখনী প্রতিভায় মুগ্ধ হন, তিনি ১৯৮১ সালে অ্যাবটের শর্তাধীন মুক্তির ব্যবস্থা করে দেন। সে বছরই অ্যাবটের বইটি প্রকাশ পায়। তবে মুক্তির মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে হত্যার অভিযোগে তাকে আবার কারাগারে ফেরত পাঠানো হয়।