বর্ধমান হাউজ ও আজকের বাংলা একাডেমির কিছু গল্প

যে ভবনকে কেন্দ্র  করে বাংলা একাডেমী গ্রন্থমেলার বইয়ের দোকান,লেখক-কুঞ্জ,তথ্যকেন্দ্র,মিডিয়া সেন্টার,একুশের অনুষ্ঠান-মঞ্চ করা হয় সে ভবনটির নাম বর্ধমান হাউস।এই ভবনটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বাঙ্গালীর চেতনা,একুশের দ্রোহ এবং অমর একুশের সাফল্যগাঁথা।

বর্ধমান হাউস প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বঙ্গভঙ্গ রদের সময়ে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে।বাংলায় দ্বৈতশাসনের যুগে ১৯২২-২৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ভারতের বর্ধমান রাজা এখানে বাস করতেন বলে মনে করা হয়।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বর্ধমান হাউস উচ্চপদস্থ সরকারি কর্তাদের অতিথিশালা রুপে ব্যবহার করা হতো।১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এই বর্ধমান হাউসে অতিথি হিসেবে বেশ কিছুদিন থাকেন।

১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে ভবনটিতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রদর্শনীর আয়োজন করা হতো,এমনকি জাতিসংঘ উন্নয়ন ও তথ্য বিভাগের কার্যালয় এখানে ছিল।

আর পাকিস্তান শাসন আমলে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বর্ধমান হাউস পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

সবশেষে ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমী স্থাপনের পর থেকে বিশ্বখ্যাত পণ্ডিত,শিক্ষক,গবেষক,সাহিত্যিক,শিল্পী,ঐতিহাসিক  প্রমুখ বর্ধমান হাউসে আতিথ্য গ্রহণ করেছেন।

বর্ধমান হাউসের  পরিচয়

বর্ধমান হাউসের নিচতলায় পূর্ব ও পশ্চিম দিকে আলাদা দুটি অর্ধবৃত্তাকার সিঁড়িওয়ালা বারান্দা রয়েছে।দোতলায় এই বারান্দা দুটিতে চমৎকার একটি ঘের দিয়ে রাখা হয়েছে যেন সে ঘেরটিতে সকাল ও বিকেলের রৌদ্র উপভোগ করা যায়।তিন তলায় নবনির্মিত এই অংশে এমন বারান্দা নেই।তবে উত্তরপাশে রাস্তার দিকে খোলা

পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা একটি প্রশস্ত ও খোলা বারান্দা তিনটি তলাতেই রয়েছে,এই বারান্দা দিয়ে আলাদাভাবে বর্ধমান হাউসের প্রতিটি কক্ষে যাওয়া যায়।তিনতলা পর্যন্ত উঠার জন্য বর্ধমান হাউসের সিঁড়িটি কাঠের তৈরি।এমনকি সবগুলো দরজা-জানালা কাঠের তৈরি।তবে পরবর্তীতে নিরাপত্তার কথা ভেবে কাঠের দরজা ও জানালার ভেতরের দিকে আরেকটি কাঠ ও কাচের দরজা জানালা বসানো হয়েছে।বর্ধমান হাউসের দোতলার পূর্বদিকে একটি পূজার ঘরের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়।বর্তমানে হাউসটির নিচতলার পুরো অংশে রয়েছে বাংলা একাডেমী গ্রন্থাগার,দ্বিতীয় তলার পশ্চিম দিকেরএকটি কক্ষ বাংলা একাডেমীর গবেষণা,সংকলন ও ফোকলোর বিভাগের পরিচালকের কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং অন্য চারটি কক্ষের মধ্যে প্রাচীন পুথিশালা,শহীদুল্লাহ গবেষণা কক্ষ, নজরুল কক্ষ এবং গবেষণা উপবিভাগের উপপরিচালকের কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।তৃতীয় তলার পূর্বাংশে সংরক্ষিত রয়েছে গত শতকের ষাট ও সত্তরের দশকে গ্রামবাংলা থেকে সংগৃহীত লোকসাহিত্যের উপাদান।

বর্ধমান হাউসে ছাত্রের অধীনে শিক্ষকের চাকরি

বর্ধমান হাউসের ব্যতিক্রমী যে ঘটনাটি জেনে চমকে উঠতে হয় তা হল-এই ভবনে বাংলার জ্ঞানতাপস শিক্ষক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর নিজের ছাত্র শিক্ষাবিদ সৈয়দ আলী আহসানের অধীনে বাংলা একাডেমীর গবেষণামূলক চাকরি করেন।ভাবতেই অবাক লাগে!সৈয়দ আলী আহসানের বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, “ছাত্রের অধীনে কাজ করা গ্লানিকর।কিন্তু আলী আহসানের অধীনে কাজ করে আমি আনন্দ পেয়েছি।প্রবল শ্রদ্ধাবোধ ও কঠোরতা এই উভয়ের সমন্বয় সাধন করে সে আমাকে দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নিয়েছে।সে জন্য আমি গর্ববোধ করি।”

সাম্প্রতিক সময়ে এমন দৃষ্টান্তের কথা ভাবা যায় কি!

বর্ধমান হাউস ও কাজী নজরুল ইসলাম

বর্ধমান হাউসের পশ্চিম পাশে এখনো একটি পুকুর আছে।গ্রন্তমেলার সময়ে এটিকে দেখে অনেকে অর্থহীন এবং খামোখা অপ্রয়োজনীয় ও স্মৃতিহীন বস্তু ভাবেন।কিন্তু সেই পুকুরটির জলে যে কাজী নজরুল ইসলামের গায়ের ঘ্রাণ রয়ে গেছে তা অনেকেরই অজানা।১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কাজী মোতাহের হোসেন যখন বর্ধমান হাউসে থাকতেন তখন কাজী নজরুল ইসলাম মাঝেমধ্যে তাঁর আতিথ্য নিতেন।এ সময়ে তিনি বর্ধমান হাউসের দোতলায় অবস্থান করতেন।আর সেই পুকুরটিতে সাঁতার কাটতেন,স্নান করতেন এবং মাঝে মাঝে পুকুর পাড়ে বসে বাঁশিও বাজাতেন।

ছায়ানটের প্রথম ক্লাস

বর্ধমান হাউসের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পরিচয় দিতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় বাংলাদেশের বৃহত্তর সংগীত-নৃত্যকলা কেন্দ্র ছায়ানটের কথা।ছায়ানটের সূচনাকালে সংগীতের ক্লাসগুলো বর্ধমান হাউসের তৃতীয় তলাতে হতো।

বর্ধমান হাউসে নাট্যচর্চা

বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ও পরে উভয় সময়েই  বর্ধমান হাউসের সঙ্গে বাংলাদেশের নাট্যচর্চার ইতিহাস সংযুক্ত আছে বলে অনেকে মনে করেন।মুনীর চৌধুরী বর্ধমান হাউসে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কৃষ্ণকুমারী নাটকের মহড়া করেছিলেন।কিন্তু মোনায়েম খাঁর বিরোধিতার মুখে তা আর মঞ্চস্থ করতে পারেন নি।এ কথার সত্যতা মিলে সৈয়দ আলী আহসানের লেখায়।তিনি লিখেছেন,মুনীর চৌধুরীর নাট্যচক্র একবার বর্ধমান হাউসের হলঘরে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কৃষ্ণকুমারী নাটকটি মঞ্চস্থ করে।এ নাটকের মধ্যে যবন শব্দটি কয়েকবার এসেছে। এ খবর প্রাদেশিক গভর্নর মোনায়েম খাঁর কানে গেল।বাংলা একাডেমীর হলঘরে এমন একটি নাটক অভিনীত হয়েছে যেখানে মুসলিমদেরকে যবন বলা হয়েছে,এটি তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারেননি। তাই নাটকটি আর বর্ধমান হাউসে মঞ্চস্থ হয়নি।

বর্ধমান হাউসের গৌরব

এ ভবনেই সংরক্ষিত আছে বাংলাদেশের তো বটেই সারা উপমহাদেশের বৃহত্তর ফোকলোর সংগ্রহশালা।এ ছাড়া অসংখ্য প্রাচীন পুঁথির সংগ্রহ এবং লক্ষাধিক গবেষণামূলক গ্রন্থের সমাহার রয়েছে বর্ধমান হাউসে অবস্থিত বাংলা একাডেমী গ্রন্থাগারে।