প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের এক অনন্য ঠিকানা খৈয়াছড়া ঝর্ণা

প্রকৃতি ও মানবের প্রেম আদিকাল হতে। প্রকৃতির অকৃতিম রূপের সন্ধানে যুগ যুগ ধরে মানব ছুটে বেড়িয়েছে দেশ থেকে দেশে, বন-জঙ্গল, পাহাড়ে। আর প্রকৃতির এ অকৃত্রিম রূপের একটি নিয়ামক হচ্ছে ঝর্ণা। বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকা- চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটে রয়েছে বেশ কিছু ঝর্ণা। এগুলোর কয়েকটা পর্যটকদের কাছে পরিচিত হলেও এমন কিছু ঝর্ণা আছে যেগুলো অসাধারন সৌন্দর্য্যময়ী হওয়া সত্ত্বেও পর্যটকদের কাছে তেমন পরিচিত নয়। এমন একটি ঝর্ণা হচ্ছে ‘খৈয়াছড়া’। আজকে এ নয়নাভিরাম সৈন্দর্য্যময়ী ঝর্ণা নিয়েই কিছু লিখছি।

দেশের অন্যান্য ঝর্ণা থেকে খৈয়াছড়া একটু আলাদা ধাঁচের। এর বিশেষত্ব হচ্ছে, এ ঝর্ণার পানি পাহাড়ের চূড়া থেকে ছোটবড় মোট সাতটি ধাপ পার হয়ে নেমে আসে। এ বিরল বৈশিষ্ট্যের ঝর্ণা বাংলাদেশের অন্য কোথাও নেই। তাছাড়া আকার ও আয়তনে এটি দেশের সবচেয়ে বড় ঝর্ণা। আর এ কারণেই অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত যায়গাটি কৌতুহলপ্রিয় মানুষের এক অনন্য ঠিকানা। উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ পেরিয়ে সর্বপ্রথম যেটি চোখে পড়ে , সেটি হল ঝর্ণার সবচেয়ে নিচের স্তর। এখানে পানি অনেক উপর থেকে পতিত হয় এবং এই স্তরটিই মূল ঝর্ণা। ঝর্ণার পানি নেমে আসা ঢাল বেয়ে উপরে উঠতে থাকলে একের পর এক স্তর উন্মুক্ত হবে। প্রতিটি স্তরেই আছে নতুনত্ব ও কৌতূহল।

blank
ঝর্ণার কয়েকটি ধাপ

অবস্থান :

ঝর্ণাটি অবস্থিত চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায় । উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিওনের বড়তাকিয়া বাজারের ঠিক উত্তর পার্শ্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হতে পূর্বদিকে ৪.২ কিলোমিটার ভেতরে এটি অবস্থিত।

সংক্ষিপ্ত ইতিহাস :

খৈয়াছড়ার পরিচিতি অল্প কিছুদিন হলেও এটি প্রায় ৫০ বছর আগে থেকেই প্রবাহতি হচ্ছে। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা এবং ঘন ঝোপ-ঝাড়ের জন্য এটি অনাবিষ্কৃত রয়ে যায় দীর্ঘদিন। এছাড়া এই এলাকায় মানুষের বসতি তেমন ছিলোইনা। অবশেষে ২০১০ সালের দিকে সরকার কর্তৃক বারৈয়াঢালা ব্লক হতে কুন্ডের হাট পর্যন্ত সমগ্র পাহাড়ি এলাকাকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করার বদৌলতে খৈয়াছড়া ঝর্ণা আবিষ্কৃত হয়।

যেভাবে যাবেন:

ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে এসি, নন-এসি অসংখ্য বাস যাতায়াত করে। ঢাকা থেকে যেকোনো একটি বাসে উঠে পড়ুন। চট্টগ্রাম শহরের পৌছানোর বেশ আগেই খৈয়াছড়ার অবস্থান। আশেপাশে থাকার ব্যবস্থা হলে মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া বাজারে নামা যেতে পারে। ওখান থেকে সিএনজি যোগে ও পায়ে হেঁটে যেতে হবে খৈয়াছরা। তবে ওখানে আবাসিক হোটেলের সুব্যবস্থা না থাকায় সরাসরি চলে যেতে পারেন চট্টগ্রাম শহরে। শহরে থাকার ব্যবস্থা করে একটু সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হবে; কেননা ঝর্ণায় পৌছতে ও ফিরে আসতে বেশ সময় লাগে। সেক্ষেত্রে শহর থেকে বড়তাকিয়া বাজারে আসতে হবে গাড়িতে করে। গাড়ি ভাড়া মাথাপিছু ৫০ টাকা করে নিবে। এছাড়া নিজের সুবিধামতো ব্যক্তিগতভাবে সিএনজি ভাড়া করে নিতে পারেন।

বড়তাকিয়া বাজারে নামার পর ওখান থেকে আবার সিএনজি করে খৈয়াছড়া যেতে হবে। সিএনজিতে প্রতিজন ২০ টাকা ভাড়া। লোক বেশি হলে রিজার্ভ করেও নিতে পারেন।

আগেই বলেছি খৈয়াছড়া এডভেঞ্চার-প্রিয় মানুষের উত্তম যায়গা ; তবে সৌখিন ও অলস মানুষের জন্য যায়গাটি মোটেও সুবিধার নয়। কেননা খৈয়াছড়ার অমায়িক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে হলে আপনাকে যাত্রাপথে পাড়ি দিতে হবে দুর্গম এলাকা। সিএনজি যেখানে এসে নামিয়ে দিবে, সেখান থেকেই পায়ে হাটার পথ। প্রায় এক ঘণ্টার মত পায়ে হাটতে হবে দূর্গম পথ মাড়িয়ে। তবে হাটার গতির উপরে সময়টা কমবেশি হতে পারে। যেখান থেকে হাটার পথ শুরু, ঐখানেই দোকান থেকে কিনে নিতে হবে বাঁশ কেটে তৈরি করা লাঠি। লাঠিগুলো পিচ্ছিল ও পাথুরে পথে চলার সময় কাজে লাগবে। হাঁটা শুরু করলে রাস্তার বেশ কিছুদুর পর্যন্ত পথে পড়বে ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট ও বিশ্রামাগার। প্রয়োজন হলো এসব রেস্টুরেন্টে হাল্কা নাস্তা সেরে নিতে পারেন বা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে পারেন।

blankযাত্রাপথের প্রায় পুরোটাই ঝিরিপথ। চলতি পথে দেখতে পাবেন খৈয়াছড়া ঝর্ণা থেকে নেমে আসা পানি উঁচুনিচু পাথুরে পথ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। আর আপনাকে যেতে হবে ঐ প্রবাহিত পানির উপর দিয়ে কিংবা কখনো যেতে হবে গভীর বনের ভিতর দিয়ে। চারিদিকে উঁচু উঁচু সব পাহাড়, গাড় সবুজ বনের সৌন্দর্য্য আর চমৎকার শীতল ও পরিষ্কার আবহাওয়া মনে এক অমায়িক দোলা দিয়ে যায়। তবে চলার সময় বেশ সাবধান থাকতে হবে; কেননা যেকোনো মুহূর্তেই পা পিছলে পড়ে যেতে পারেন আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধারালো পাথরে কেটে যাওয়া বা হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে।

এভাবে প্রায় ঘণ্টা খানেক হাটার পর ঝর্ণার পানি পড়ার এক অমায়িক ঝমঝম শব্দ শোনা যাবে। আপনি পৌছে গেছেন অমায়িক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ‘খৈয়াছড়া ঝর্ণা’ ! এবার দেখবেন সুউচ্চ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসছে শীতল মিঠাপানির ফোয়ারা। ঝাঁপিয়ে পড়ুন যৌবনবতী ঝর্ণার পাদদেশে! ভয় নেই; তলিয়ে যাবেন না। এখানে পানির গভীরতা বুক সমান।

চমকের এখানেই শেষ নয়। সাতটি স্তরে নেমে আসা ঝর্ণার এটি হচ্ছে সর্বনিম্ন স্তর। এবার বামদিকের উঁচু ঢাল বেয়ে উঠতে থাকুন। উপরে উঠার সময় সাবধান। অনেক মানুষের উঠানামার কারনে এখানকার ঢালগুলো ভেজা ও পিচ্ছিল। এক্ষেত্রে পাহাড়ের গায়ে ঝুলে থাকা শিকড়গুলোর সাহায্য নিতে পারেন। পাহাড় বেয়ে উপরে উঠতে থাকলে নতুন নতুন বিষ্ময় উন্মুক্ত হবে। উপরে উঠেই দেখবেন নতুন আরেকটি ঝর্ণা! এভাবে পরপর ঠিক সাতটি ধাপ উপরে পাহাড়ের চূড়া থেকে মুল ঝর্ণাটির উৎপত্তি।