হিটলার – এক স্বৈরশাসকের উত্থান পতন!

আচ্ছা, এই যে আমরা একটা স্বাধীন-স্বার্বভৌম দেশের নাগরিক, আমি যদি বলি আমাদের এই স্বাধীন হওয়ার পেছনে হিটলারের অবদান আছে, তাহলে আমার কথা কি কেউ বিশ্বাস করবেন? নাকি স্রেফ পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দেবেন? আমার মনে হয় বেশির ভাগ লোক দ্বিতীয়টিই করবেন, তবে সত্যিটা হল- হিটলারের আক্রমণে ফ্রান্স-ব্রিটেনের তখন দিশেহারা অবস্থা। এদিকে উপনিবেশগুলোও ক্রমশ স্বাধীনতার জন্য ফুঁসছে। গ্রেট ব্রিটেনের শাসকরা দেখল এখন যদি উপনিবেশগুলো বিদ্রোহ করে বসে, তাহলে একূল-ওকূল দুদিক যাওয়ার সম্ভবনাই প্রবল। তাই তারা উপনিবেশিক দেশগুলোর সাথে চুক্তিতে আসল- বিশ্বযুদ্ধে আমাদের সহায়তা করো, যুদ্ধ শেষে তোমরা স্বাধীনতা পাবে! ঠিক এই কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সম্রাজ্য একে একে তাদের কলোনীগুলো ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়!

বিশং শতাব্দীর সবচেয়ে বড় বিস্ময় হলেন এডলফ হিটলার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একজন মামুলি সৈনিক (পরবর্তীতে কর্পোরাল) ঠিক ২০ বছর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন, এরচেয়ে বড় বিষ্ময় আর কি হতে পারে? আজ ২০শে এপ্রিল, এই মাথাখারাপ স্বৈরশাসকের ১২৮ তম জন্মদিন। তাকে নিয়েই আজকের বাংলাহাবের এই বিশেষ আয়োজন।

এডলফ হিটলার জন্মেছিলেন অস্টিয়ার ব্রাউনাউ-আম-ইন নামক এক গ্রামে। জায়গাটা জার্মান বাভারিয়া সিমান্তের কাছেই, সময়টা ১৮৮৯ সালের ২০ শে এপ্রিল সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা। তার বাবার নাম এলয়েস হিটলার আর মা ক্লারা হিটলার। বলা হয়ে থাকে হিটলারের বাবা এলয়েস হিটলার ছিলেন তার মায়ের জারজ সন্তান, একজন ইহুদী ছিলেন তার জনক। সেই হিসেবে বলা যায়, হিটলারের আসল দাদা একজন ইহুদী ছিলেন! তার ইহুদী বিদ্বেষের কারণ কি এটাই?

পড়ালেখায় হিটলার খুব একটা ভাল ছিলেন না। ‘স্কুল লার্নিং সার্টিফিকেট’ তিনি পান নি। তবে আঁকাআঁকি বেশ ভালই পারতেন। তাই মনের মাঝে শিল্পী হবার খায়েশ জাগলো। ১৯০৭ সালে অস্ট্রিয়ার বিখ্যাত আর্ট স্কুল ‘একাডেমী অব ফাইন আর্টস’-এ ভর্তি পরীক্ষা দেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক ভাবে তিনি রিজেক্ট হন। পরের বছর আবারও চেষ্টা করেন তিনি, কিন্তু ভাগ্য এবারও সিঁকে ছিঁড়ে নি। এমনকি আর্কিটেকচারেও ভর্তি হবার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু স্কুল রেকর্ড সুবিধের না হওয়ায় ভর্তি হতে পারেন নি কোথাও। আচ্ছা একবার ভাবুন তো, হিটলার যদি জার্মানীর এক নায়ক না হয়ে যদি কোন বিখ্যাত শিল্পী কিংবা আর্কিটেক্ট হতেন, তাহলে আমাদের পৃথিবীর নতুন ইতিহাসটা কেমন হত!

১৯১৩ সালে হিটলার ভিয়েনা ছেড়ে প্রথমবারের মত জার্মানি আসেন। ১৯১৪ তে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ছোটবেলা থেকেই যুদ্ধের প্রতি অন্যরকম আকর্ষণ বোধ করতেন তিনি। কর্পদকশূন্য হিটলার স্বেচ্ছায় যোগ দিলেন ব্যাভারিয়ান রেজিমেন্টে। ১৯১৮ সালের অক্টোবরে কর্পোরাল হিটলারকে দেখা গেলো পোমারুনিয়ার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।  হাসপাতালে শয্যাশায়ী অবস্থায় হিটলার জার্মানির পরাজয়ের খবর পেলেন। এই খবর তাকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। যদিও তিনি জাতিগত ভাবে জার্মান না, কিন্তু ততদিনে জার্মান জাতিকে তিনি মনে-প্রাণে ভালোবেসে ফেলেছিলেন।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে হিটলার এক বিপর্যস্ত জার্মানিকে দেখলেন। খাদ্যাভাব তখন তুঙ্গে, আইন-শৃঙ্খলার কোন বালাই নাই। অন্যদিকে চিরশত্রু ফ্রান্সের ঘরে ঘরে তখন বিজয়ের উৎসব। শোকে মুহ্যমান হিটলার নিজ অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পারলেন, নিশ্চয় কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। নয়ত জার্মানী এত চরমভাবে হারত না। কারণ অনুসন্ধানে নেমে তিনি হারের পেছনে ইহুদী মুনাফাবাজদের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পান। তখন থেকেই তার ইহুদী নিধনের ইচ্ছা প্রবল হয়।

সম্রাট দেশ ছেড়ে নেদারল্যান্ড পালিয়েছেন। রাজতন্ত্র বিলোপ করে জার্মানিকে রিপাবলিক ঘোষণা করা হল। ওয়ার্কাস পার্টির সংস্পর্শে এসে হিটলার যেন নিজেকে নতুন ভাবে খুঁজে পেলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি গলাবাজিতে ওস্তাদ ছিলেন। ১৯২০ সালে মিউনিখে ওয়ার্কাস পার্টির প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ২৫ দফা দাবি রেখে তিনিই মঞ্চ মাতান। এক জনসভা রাতারাতি তাকে নেতা বানিয়ে দিল। পরের বছরের মাঝামাঝি সময়েই দলের সব পুরানো নেতাদের হটিয়ে তিনি দলের ত্রানকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন।

হিটলারের আগুন ঝরানো বক্তব্যগুলো জার্মানি জুড়ে স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে লাগলো। ১৯২৩-২৪ এর মাঝে প্রচুর মধ্যবিত্ত জার্মান দলে দলে হিটলারের দলে যোগ দিল। জার্মান সামরিক বাহিনীর এক শ্রেণীর অফিসারও হিটলারের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। তার দলের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রাখা হল Nazional Sozialist Party বা সংক্ষেপে Nazi বা নাৎসি পার্টি। একটি প্রাইভেট আর্মিও গঠিত হল তাদের। একে একে হিটলারের চারপাশে এসে জুটতে লাগলো গোয়েরিং , গোয়েবেলস, রোয়েম, রোজেনবার্গ, কাইটেল এর মত দুর্ধর্ষ নাৎসি নেতারা। মিউনিখ পুলিশ ব্যাপারটা ভালো ভাবে নিল না। গ্রেফতার হন হিটলার, চার বছরের জেল হয় তার। জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় হিটলার লিখলেন তার বিখ্যাত স্মৃতিচারণা মূলক আত্মকথা ‘মাইন কাম্ফ’। সমগ্র জার্মান যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল এই বইয়ের উপর। বই বিক্রির রয়্যালিটি বাবদ তার অ্যাকাউন্টে যোগ হল প্রায় তিন লাখ ডলার!

১৯৩০ সালের পর থেকে জার্মানির অর্থনীতির অবস্থা খুব দ্রুত খারাপ হতে থাকে। ১৯৩৩ সালের দিকে তা মারাত্মক আকার ধারণ করে। অর্থনৈতিক দুর্দশা বাড়ায় সাধারণ মানুষ ক্রমে চরমপন্থার দিকে ঝুঁকতে লাগলো। সরকার সাধ্যমত চেষ্টা করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছিল না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবুর্গ হিটলারকে ‘চ্যান্সেলর’ পদে আমন্ত্রণ জানান। ব্যাপারটা হল শেয়ালের কাছে মুরগী বর্গা দেয়ার মত! ক্ষমতা হাতে পেয়েই হিটলার কঠোর হাতে বিরোধীদের দমন করলেন। নাৎসি বাহিনীর মাধ্যমে পার্লামেন্টে আগুন ধরিয়ে সেই দোষ চাপালেন কমিউনিস্ট পার্টির উপর। তারপর সংসদ অবমাননার দায় তুলে পুরো কমিউনিস্ট পার্টিটাকেই মায়ের ভোগে পাঠালেন তিনি! রাজনীতির খেলা আর কাকে বলে!

১৯৩৪ সালে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবুর্গ মারা গেলে জার্মানির সর্বোচ্চ ক্ষমতায় বসেন হিটলার। প্রেসিডেন্ট আর চ্যাঞ্চেলর পদ দুইটিকে একীভূত করে দেশটির সর্বময় ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেন তিনি। নিরঙ্কুশ ক্ষমতালাভের পরেও যাতে কোথাও কোন ফাঁক না থাকে সেজন্য হিটলার সেনাবাহিনীর সকল উচ্চপদস্ত অফিসারদের কাছ থেকে আনুগত্যের শপথ আদায় করে ছাড়লেন। এই শপথ জার্মানির নামে নয়, সংবিধানের নামেও নয়, এই শপথ করতে হত ব্যক্তি হিটলারের আনুগত্যের প্রতি!

নাৎসি বাহিনীর হাতে নিহতদের স্তুপ

এরপর হিটলার যুদ্ধ ছাড়াই কেবলমাত্র সন্ত্রাসবাদ আর যুদ্ধের ভয় দেখিয়ে জার্মানির পাশের রাজ্যগুলো দখল করে ফেললেন। ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে রাইনল্যান্ড থেকে চেকোস্লোভাকিয়া পর্যন্ত নিজের দখলে নিয়ে আসলেন হিটলার। ১৯৩৯ সালে পোল্যান্ড হামলা করেন করেন তিনি। ফলশ্রুতিতে ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এভাবেই কেবল মাত্র একটা লোকের সামরিক উচ্চাশার খেসারত হিসাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু হয়।

প্রায় ১১ থেকে ১৪ মিলিয়ন মানুষ হত্যার জন্য হিটলারকে দায়ী করা হয়, এর মাঝে ৬ মিলিয়ন ছিল ইহুদী। ইহুদী নিধনের এই ঘটনাকে ইতিহাসে হলোকস্ট বলে অভিহিত করা হয়। যুদ্ধের প্রথম দিকে জার্মান নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তি এশিয়া ও ইউরোপের বেশ কিছু অঞ্চল জয় করে নিলেও ক্রমেই তারা মিত্রবাহিনীর কাছে কোনঠাসা হতে থাকে। ১৯৪৫ সালের দিকে জার্মানি প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়।

১৯৪৫ সালে যুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে হিটলার বার্লিনেই ছিলেন। মিত্র বাহিনীর রেড আর্মি যখন বার্লিন প্রায় দখল করে নিচ্ছিল সে রকম একটা সময়ে তিনি দীর্ঘ দিনের সঙ্গী ইভা ব্রাউনকে বিয়ে করেন। কথিত আছে, পরাজয়ের আগমূহুর্তে তিনি ইভাকে পালিয়ে যেতে বলেছিলেন। ইভার জবাব ছিল- ‘আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বীরকে ভালোবসেছি। পালিয়ে বাঁচায় সম্মান কোথায়? বরং আমি তোমার হাত ধরেই মরতে রাজি’। বিয়ের ২৪ ঘন্টা পরেই ফিউয়ার বাংকারে পটাসিয়াম সানায়েড স্বামী-স্ত্রী দুজন আত্মহত্যা করেন। বলা হয়ে থাকে, বাংকারের বাইরে পাহারায় থাকা গার্ড নাকি গুলির শব্দও শুনতে পেয়েছিল। ধারণা করা হয়, মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য সানায়েড খাওয়ার পরে হিটলার নিজের মাথায় গুলি করেছিল।

ইভা ব্রাউন ও হিটলার

মৃত্যুর আগে তার শেষ বিশ্বস্ত কিছু সৈনিকের প্রতি তার শেষ নির্দেশ ছিল তার লাশ যাতে মিত্র বাহিনী অক্ষত অবস্থায় না পায়। মৃত্যু নিশ্চিত হবার পর সৈন্যেরা বাংকারে ঢুকে দুজনের লাশ বের করে পাশের বাগানে কম্বলে মুড়ে জ্বালিয়ে দেয়। মিত্র বাহিনীর সৈন্যেরা যখন বাংকারের কাছে আসে সেখানে পোড়া মাংসের গন্ধ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। ৩০শে এপ্রিল, ১৯৪৫ সালে এই বদ্ধ উন্মাদ স্বৈরশাসকের ইহলোকে যাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটে!