বুক রিভিউঃ আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরী- টেলস ফ্রম দ্য সিক্রেট অ্যানেক্স

কাহিনী সংক্ষেপঃ

১৩ বছর বয়সী একজন কিশোরী, যার চেনা পৃথিবীটা হঠাৎ করেই বদলে যেতে শুরু করে। অ্যানা ফ্রাঙ্ক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভিষীকাময় অধ্যায়ের অনেক বড় একজন সাক্ষী। যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনিশ্চিত দিনগুলোর কথা ডায়েরীতে লিখেছিল নিয়মিতভাবে। সে সময়ের ভয়াবহ দিনগুলো এই কিশোরীর কলমের আঁচড়ে ডায়েরীর পাতায় ফুটে উঠেছে। ডায়েরিটা পড়ে কেঁদে কেটে আকুল হয়েছে গোটা পৃথিবীর মানুষ।দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শুরুর পর যখন জার্মান নাৎসীবাহিনী ইহুদী হননে মেতেছিল, তখন আনা ফ্রাংকের পরিবার আমস্টারডামের একটি মৃত্যুকুপে ২৫ মাস লুকিয়ে থেকেও নাৎসীদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারেনি। এই বন্দি জীবনের বর্ণনাই ছিল আনা’র ডায়েরিতে।
জন্মগত ভাবে জার্মান হলেও নাৎসি বাহিনী ক্ষমতায় আসার পর ১৯৩৪ সালে হল্যাণ্ডের রাজধানী আর্মস্টরডেমে চলে আসেন তার পরিবার। নিজের দেশ ছেড়ে আসার একটাই কারণ, তারা ছিলো ইহুদি। যদিও ইতিহাসের নথিপত্র ঘেটে দেখা যায় তাদের পরিবার ছিলো অতি মুক্তমনা, কোনো ধর্মের সাথেই তাদের নিবিড় বন্ধন ছিল না বরং তাদের বন্ধুদের তালিকায় ছিলো নানা জাতির নানা ধর্মের মানুষ। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আনা ও তার পরিবার ১৯৪২ সালের পরপরই দখলদার নাৎসী বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে আত্মগোপন করেন।

ফ্র্যাঙ্ক পরিবার

আত্মগোপনের সময় তার ১৩তম জন্মদিনে উপহার হিসেবে পাওয়া ডায়েরীতে তার জীবনের দিনলিপি লিখতে শুরু করে আনা। আত্মগোপনকালীন জীবনের দুঃসহ অভিজ্ঞতা, কৈশোরে ডানা মেলার উত্তাল রঙিন দিনের বদলে ভ্যাপসা আঁধারে ঘেরা গুমোট জীবন- চমৎকার ভাষায় লিখে গেছে সে। আনা লিখতে থাকে তার চার পাশের বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা। মাত্র ১৩ বছরের এক কিশোরী ধর্ম সম্পর্কে কতটুকুই জানে? তবুও শুধুমাত্র জন্মগত ভাবে ইহুদী হবার কারণে তাদের পরিবারের যে এই করূণ অবস্থা- এটা তাকে আরো দুঃখী ও সংকুচিত করে তোলে। বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ের নানা ঘটনা, মাসের পর মাস একঘেয়ে ধূসর জীবনযাত্রা, বনের পশুর মতো গুহার গভীরে লুকিয়ে কেবল ধুঁকেধুঁকে বাঁচার চেষ্টার মাঝেও হঠাৎ আলোর ঝলকানির মত উকি দিয়ে যায় কৈশোর প্রেম। এভাবেই ১৯৪৪ সালের পহেলা আগস্ট পর্যন্ত ছোট ছোট আবেগে মোড়া ঘটনায় ভরে ওঠে তার ডায়েরীর পাতা। এর পর পরই গুপ্তপুলিশ গেস্টাপের হাতে বন্দী হয় অ্যানা ফ্রাঙ্ক পরিবার, থেমে যায় তার ডায়েরী ‘কিটি’র এগিয়ে চলা।

পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ

কোন বিখ্যাত আত্মজীবনীর কথা আসলে সবার আগে যে নামটি মনে পড়ে তা হল- আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি। অন্য যে কোন আত্মজীবনীর সাথে এটার তফাৎ হল, এটা লেখার সময় লেখিকা জানতো না যে তার এই ডায়েরীটা প্রকাশিত হবে। কেবল শেষদিকে রেডিওতে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ডায়েরি সংরক্ষন করা হবে- এটুকু শুনে আশা করেছিল, হয়তো তার লেখা ডায়েরিটা একদিন প্রকাশিত হবে।
যে কারণে ডায়েরিটা বিখ্যাত, সে ব্যাপারটা আমাকে তেমন ছুঁয়ে যায়নি। যুদ্ধের সময় জার্মানরা ইহুদীদের কেমন অত্যাচার করেছে, সেই কাহিনি পড়ে আমার চোখে পানি আসেনি। পাকিস্তানিরা এর চেয়ে বহুগুণ বেশি অত্যাচার আমাদের করেছে– বইটা পড়তে পড়তে এটা ছিল আমার ধারণা। পড়ে শেষ করার পর ভাবলাম, একটু রিসার্চ করে দেখি, জার্মানরা কেমন অত্যাচার করেছিল।
জার্মানির ছোট্ট শহর বের্গেন। এখানেই রয়েছে ইতিহাসের দগদগে ক্ষত কুখ্যাত বের্গেন-রেলসেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। নাৎসি অধিকৃত জার্মানিতে যুদ্ধবন্দিদের মরণফাঁদ সৃষ্ট ও পরিচালিত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোর অন্যতম বের্গেন-রেলসেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প । এই স্থানে অন্তত ৭০ হাজার তাজা প্রাণ ঝরে পড়েছে ২য় বিশ্বযুদ্ধের বছরগুলোতে। কীভাবে পরিকল্পনা করে ফ্যাক্টরিতে মুরগি প্রসেসিং-এর মতো ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্টাইলে খুন করে সুখ পেতে পারে- তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইহুদি গণহত্যার নিদর্শন না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

আনা’র হাতে লেখা মূল ডায়েরীর ছবি

১৯৩৯ সালেই এই কুখ্যাত স্থাপনার যাত্রা শুরু হয় যুদ্ধবন্দীদের বন্দী শিবির হিসেবে, যেখানা আনা হয়েছিল ফ্রেঞ্চ, পোলিশ,রেলজিয়ান ও রাশান বন্দীদের। কিন্তু বন্দি শিবিরের যথাযথ সুবিধা ছিলোনা। অপ্রতুল খাবার আর কনকনে ঠাণ্ডার কারণে ১৯৪১ সালের জুলাইতে পাঠানো ২০ হাজার রাশান বন্দীর মাঝে ১৮ হাজারই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ১৯৪৩ সালে হিটলারের অন্যতম দোসর হাইনরিখ হিমলারের নির্দেশে এই বন্দীশালাকেই পরিণত করা হয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে, আনা হয় হাজার হাজার ইহুদী ও রাশান বন্দীদের। ১৯৪৫ সালের ১৫ এপ্রিল কানাডা-ব্রিটিশ যৌথবাহিনীর হাতে এই ক্যাম্পের পতন ঘটে। তখন যৌথ বাহিনী প্রায় ৬০ হাজার বন্দীকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করতে সক্ষম হন যাদের অধিকাংশই ছিলো মারাত্মক অসুস্থ আর ১৩ হাজার শবদেহ ছিলো মাটি চাপা দেবার অপেক্ষায়। বের্গেন-বেলসেন ক্যাম্পে নিহত হয়েছিলো প্রায় ৭০ হাজার বন্দী, যার মধ্যে ৩০ হাজার ইহুদি, প্রায় সমান সংখ্যক রাশান। সেই সাথে প্রচুর সমকামী, জিপসি আর নাৎসি বিরোধী স্বদেশপ্রেমী জার্মান।

হাস্যোজ্বল অ্যানা

সত্যি বলতে কী, এই ডায়েরিতে অত্যাচারের বর্ণনাটা তেমন আসেইনি। কারণ অত্যাচারিত হবার আগেই আনা’র ডায়েরীটা হাতছাড়া হয়ে যায়। তারপরেও যেটা দেখে প্রচন্ড মুগ্ধ হয়েছি, সেটা হল ছোট্ট মেয়েটার ব্যক্তিত্ব। ওর তীব্র জীবনবোধ, আত্ম-উপলব্ধি আর বুদ্ধিমত্তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সেই সাথে ওর লেখক সত্ত্বাকেও আমার খুব ভাল লেগেছে। ছোট একটা মেয়ে এত গুছিয়ে ডায়েরী লিখেছে যা দেখে আমার মনে হয়েছে, আমিও যদি এভাবে ডায়েরী লিখতে পারতাম! ওর লেখা কিছু কিছু অংশ পড়ে মনে হচ্ছিল, এইটুকু মেয়ের জীবনবোধ এত্ত প্রবল কী করে হয়! যেমন-

“কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও আমি ভেঙ্গে পড়িনি, আমার আদর্শকে জলাঞ্জলি দিইনি। জানি, বর্তমান অবস্থায় সেগুলোর বাস্তবায়ন অসম্ভব, তবুও সযত্নে তাদের বুকের ভেতর লালন করছি। কারণ আমি এখনো বিশ্বাস করি মানুষের ভিতরটা নির্মল সুন্দর। এই বিশ্বাসই আমার স্বপ্নের ভিত্তি, আমি তো আমার স্বপ্নগুলোকে এমন কিছুর উপর দাঁড় করাতে পারি না, যা কেবল মৃত্যু-ধ্বংস দিয়ে গড়া।”

কী পরিপক্ক স্মার্ট ভাবনা! মেয়েটা তার মা কিংবা আর দশটা নারীর মত কেবল ঘর সংসার করে জীবন কাটিয়ে দিতে চায়নি। সে চেয়েছিল মৃত্যুর পরও বহুদিন বেঁচে থাকবে। তাতে যে সে সফল, সেটা তো বলাই বাহুল্য! এই ছোট্ট মেয়েটা তার বাচ্চা বয়সের প্রেম আর তার পরবর্তী সময়কার বিবেকবোধ, আত্মগ্লানি- এই সবকিছুই খুব পরিণত ছিল। অনুভূতিগুলি ব্যক্তও করেছে পাকা লেখিয়ের মত।

পড়ার সময় কিছু কিছু জায়গায় আৎকে উঠেছি। লুকিয়ে থাকার ওই ভয়াবহ সময়টায় নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে যদি ডায়েরিটা সত্যিই পুড়িয়ে ফেলা হত? তাহলে কী হত? এই ইতিহাসের কথা আমার হয়তো জানাই হত না। বইয়ের পরিশিষ্টতে বলা আছে হল্যান্ড মুক্ত হবার মাত্র দুইমাস আগে নির্যাতিতা আনা ফ্রাঙ্ক মৃত্যুবরণ করে। জানতাম না, ঠিক কী ধরণের নির্যাতনের শিকার হয়ে ও মারা গেছে। এত কষ্ট লেগেছে মেয়েটার জন্য যে খুঁজে পেতে বের করলাম ও কী ধরনের নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিল।

জানলাম। জেনে শিউরে উঠলাম আবার। একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা মতে জানা গেছে বের্গেন-বেলসেন বন্দী শিবিরের সব চেয়ে কমবয়সী বন্দী ছিল আনা ফ্রাঙ্ক। শিশুবন্দীদের গ্যাস চেম্বারে নিয়ে যাবার ঘটনায় মেয়েটা খুব কষ্ট পেয়েছিল। চরম নিষ্ঠুরতায় বন্দিদের প্রত্যেকেই পাথর ভাঙ্গা ও পরিবহনের অত্যন্ত ক্লান্তিকর কাজ করতে হত। কনসেণ্ট্রেশন ক্যাম্পের নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেকের মাথা কামানো থাকতো। হাতের এক জায়গায় বন্দী নম্বরটি উল্কির মাধ্যমে খোদাই করে দেওয়া হয়েছিল।

১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে টাইফাস রোগ এই শিবিরেও ছড়িয়ে পড়ে মহামারী আকারে। শেষ পর্যন্ত এই রোগেই মাত্র পনেরো বছর বয়সী আনা মারা যায়। তার বোন মার্গটও একই সময়ে পৃথিবী ছেড়ে যায়। কেবল বেঁচে ফেরেন তাদের বাবা অটো ফ্রাঙ্ক। তিনিই আমস্টারডমের সেই বন্দীশালা থেকে উদ্ধার করেন মেয়ের ডায়েরী ও অন্যান্য স্মৃতিবহুল সংগ্রহ। তাঁর প্রচেষ্টাতেই দিনলিপিটি ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয়। এটি মূল ওলন্দাজ ভাষা থেকে পরবর্তীকালে ১৯৫২ সালে প্রথম বারের মতো ইংরেজিতে অনূদিত হয়। এর ইংরেজি নাম দেওয়া হয় দ্য ডায়েরি অফ আ ইয়াং গার্ল। কিন্তু আমার মনে হয় ডায়েরীটার নামকরণ আনার রাখা নামেই করা উচিৎ ছিল। ও তার ডায়েরিটার নাম রেখেছিল, “দ্য সিক্রেট অ্যানেক্স“।

 

লেখিকার কথাঃরিভিউ হিসেবে হয়তো লেখাটা বেশ বড় হয়ে গেছে। কিন্তু আমি রিভিউর সাথে সাথে আমি আমার রিসার্চের অংশটুকুও দিয়ে দিয়েছি। যেসব ব্যাপারে আমার কৌতুহল জাগিয়েছে, সেসবে অন্য পাঠকদেরও আগ্রহ জাগাতে পারে। তাই ওটুকু দিয়ে দিলাম, যাতে তারা সহজেই কৌতুহল মেটাতে পারে।