বেবি ব্লু নাকি জন্মত্তর বিষণ্ণতা? বিষণ্ণতার ২টি ধরন যা দেখা দিতে পারে প্রসব পরবর্তী সময়ে (পর্ব ১)

baby-blues

baby-blues

গর্ভাবস্থাকে একটি অনেক আনন্দের ও সুন্দর সময় বলা হয়। আপনিও ধীরে ধীরে প্রস্তুত হয়েছেন সেই আকাঙ্খিত মুহূর্তটির জন্য। হঠাৎ খেয়াল করলেন সন্তানটি প্রসবের পর আপনার যেভাবে আনন্দ উদযাপনের কথা ছিল, ঠিক সেরকম অনুভব করছেন না। পরিবারের নতুন সদস্যটিকে নিয়ে অন্যদের সাথে আনন্দে যোগ দিতে পারছেন না। অথচ এই আনন্দ উদযাপনের কত প্ল্যানই না আপনি করেছিলেন!

সন্তান প্রসবের পর থেকে আপনার মধ্যে আবেগিয় যে পরিবর্তনটি হচ্ছে তাকে বেবি ব্লু (baby blue) বলে, যেটি প্রসবের ১ সপ্তাহ বা তার পর থেকে শুরু হয়ে প্রায় ২ সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এটি মৃদু পর্যায়ের বিষণ্ণতা। মা হবার পর প্রায় ৬০%- ৮০% ভাগ নারী এই অবস্থাটি পার করেন।

বেবি ব্লু-এর সাধারণ লক্ষণঃ

১। অতি সংবেদনশীলতা ও অযৌক্তিক বোধ করা
২।কোন বিশেষ কারন ছাড়াই থেকে থেকে কান্না পাওয়া
৩। মৃদু বিষণ্ণতা বোধ ও দুশ্চিন্তা
৪। মেজাজের তারতম্য যেমন অভিমানবোধ, বিরক্তিবোধ, খিটমিটে লাগা

কারনঃ

১। প্রসব পরবর্তী নারীর দেহে প্রসবের কারনে হঠাৎ হরমোনাল ও রাসায়নিক পরিবর্তন

২। জরায়ু মুখ প্রসারিত না হওয়া এবং প্রসবকালীন ধকল

৩। মানসিক চাপ, যেমন- দাম্পত্য অশান্তি, সন্তান দেখতে মনের মত না হওয়া, দুগ্ধদান করতে না পারা।

৪। পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা না পাওয়া ও বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা

৫। ঘুমের সমস্যা, ক্লান্তি

৬। নিজের পেশাগত জীবন নিয়ে দুশ্চিন্তা

৭। প্রসবোত্তর শারীরিক গঠনে পরিবর্তন নিয়ে দুশ্চিন্তা – ইত্যাদি কারনে বেবি ব্লু দেখা দিতে পারে।

পর্যাপ্ত বিশ্রাম, সুষম খাবার ও সন্তান পালনে যথেষ্ট সহযোগিতা পেলে এই সময়টা মায়েরা সহজে কাটিয়ে উঠতে পারেন। যদি এই লক্ষনগুলো ২ সপ্তাহেরও বেশী সময় ধরে থাকে তাহলে এটি নিয়ে একটু ভাবনার দরকার আছে।

প্রসব পরবর্তী মানসিক সমস্যা ৩ প্রকারঃ

১। বেবি ব্লু বা Postpartum Blue

২। জন্মত্তর বিষণ্ণতা বা Postpartum Depression

৩। প্রসব পরবর্তী মনোব্যধি বা Postpartum Psychosis

জন্মত্তর বিষণ্ণতাঃ

সন্তান জন্মের পর বিষণ্ণতা মায়ের জন্য পীড়াদায়ক। ১০-১৫% ভাগ মা জন্মত্তর বিষণ্ণতা (postpartum depression)য়  ভোগেন। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৩০% নারী জন্মপূর্ব বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হন এবং এরা যদি তখন প্রয়োজনীয় সাহায্য ও চিকিৎসা না পান তবে এদের প্রায় ৫০% জন্মত্তর বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হন। গর্ভকালীন সময়ে বিষণ্ণতা ও এর সাথে যুক্ত উপসর্গ সম্পর্কে উদাসীনতা ও যথাযথ চিকিৎসামূলক পদক্ষেপ নেয়ার অভাবে মায়ের মধ্যে জন্মত্তর বিষণ্ণতা দেখা যাওয়া সহ মা ও সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর উপর ক্ষতিকর প্রভাব পরে। প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতায় আক্রান্ত নারীটি অনেক সময় তার বিষণ্ণ অনুভূতি সম্পর্কে নিরব থাকেন, আবার বন্ধুবান্ধব-পরিবারের সদস্যরা তার এই মানসিক অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞাত থেকে যান।

প্রাথমিক অবস্থায় বেবি ব্লু ও জন্মত্তর বিষণ্ণতা-দুটিকে আলাদা করে শনাক্ত করা সহজ হয় না। জন্মত্তর বিষণ্ণতা সাধারনত সন্তান জন্মের ২–৮ সপ্তাহের মধ্যেই দেখা দেয় এবং তা প্রায় ১ বছরের মধ্যে প্রকট হতে পারে। প্রসব পরবর্তী সময়ে ক্লান্তি, বিরক্তবোধ, ক্ষুধামন্দা এসব স্বাভাবিক হলেও জন্মত্তর বিষণ্ণতায় বিষণ্ণতার মাত্রা দিন দিন বাড়তে থাকে।

জেনে নেয়া যাক লক্ষনগুলো-

লক্ষনঃ

বেবি ব্লু-এর লক্ষনগুলোর সাথে সাথে আরও যেসব লক্ষনের কারনে নারীটি স্বাভাবিক জীবন অভ্যাসে ফিরতে পারেন না, সেগুলো হল-

  • সহজেই বিরক্ত হওয়া, রেগে যাওয়া বা অতি সংবেদনশীলতা
  • আতঙ্ক অনুভূতি
  • সারাদিন ধরেই কান্না করা বা কান্না কান্না ভাব
  • অনিদ্রা
  • প্রচণ্ড ক্লান্তি
  • ভুলে যাওয়া ও অমনোযোগিতা
  • কোন কিছুতে আগ্রহ না পাওয়া
  • অসহায় ও অতিরিক্ত অপরাধবোধ
  • ক্ষুধামন্দা
  • সঙ্গীর প্রতি অভিমান ও দূরত্ব তৈরি করা
  • নিঃসঙ্গ অনুভূতি
  • সন্তানের প্রতি মায়া কমে যাওয়া অথবা অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা
  • হতাশা ও নিজেকে অযোগ্য মনে হওয়া
  • মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, পেশিতে ব্যথা ইত্যাদি
  • জীবনটাকে অর্থহীন মনে হওয়া ও আত্মহত্যার চিন্তা করা।

সাধারণত যে ১১ টি বিষয় জন্মত্তর বিষণ্ণতার ঝুঁকি বাড়ায়ঃ

১। গর্ভাবস্থায় হঠাৎ বিষণ্ণতা বা দুশ্চিন্তায় ভোগা

২। পূর্বে বিষণ্ণতার ইতিহাস বা পরিবারের কারো আবেগিয় মনোরোগের ইতিহাস থাকলে

৩। অপরিকল্পিত বা অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারন করলে,

৪। গর্ভধারণ সংক্রান্ত তীব্র কোন জটিলতা থাকলে,

৫। শৈশবের কোন তীব্র ট্রমা বা নির্যাতিত হবার ইতিহাস থাকলে

৬। পর্যাপ্ত মানসিক সহায়তা না পাওয়া

৭। দাম্পত্য সমস্যা, সাম্প্রতিক তালাক বা বিচ্ছেদ

৮। শিশু পালন নিয়ে মানসিক চাপ

৯। আর্থিক উদ্বেগ

১০। হীনমন্যতা বোধ

১১। পারিবারিক ও সামাজিক সহায়তা না পাওয়া।

বেবি ব্লু, জন্মত্তর বিষণ্ণতার কারন ও লক্ষন সম্পর্কে সচেতন থাকলে, যদি তা মায়ের মধ্যে দেখা দেয় তাহলে দ্রুত তা সনাক্ত করে পেশাদার কাউন্সেলিং, স্বামী ও পরিবারের সকলের সহযোগিতা, যদি প্রয়োজন হয় সঠিক ওষুধ সেবনের মাধ্যমে জন্মত্তর বিষণ্ণতা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব।