বাংলার কবিদের আনন্দ বেদনার স্মৃতি বিজড়িত সেসব নদী

বাংলার সাহিত্যাকাশে নদী এক অনন্য ভালবাসার নাম। বিশেষ করে কবিদের জীবনে নদী ফিরে এসেছে বারবার। চর্যাপদ থেকে শুরু করে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, এমনকি আধুনিক যুগেও নদীকে নিয়ে কবিদের এই রোমান্টিসিজমের শেষ নেই। বাংলার প্রখ্যাত সব কবিদের তাদের প্রিয় নদীদের নিয়ে এমনি কিছু কবিতা নিয়ে সাজানো এই লেখা যা তাদের হৃদয়ের আবেগ, ভালবাসা, উচ্ছ্বাস প্রকাশিত হয়েছে প্রতিনিয়ত।  

(১) মাইকেলের ‘কপোতাক্ষ নদ ’ মাইকেল মধুসুদন দত্তের হৃদয়ের করুণঘন অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘কপোতাক্ষ নদে’। প্রবাসে থেকেও কবির হৃদয়ে বারবার ‍ফিরে এসেছে তাঁর বাল্যকালের স্মৃতিবিজড়িত কপোতাক্ষ নদ। কবি তার হৃদয়ের উচ্ছ্বাসের কথা শুনিয়েছেন এভাবে- ‘‘ সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে।/সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে,/বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদে-দলে,/কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?/দুগ্ধ-স্রোতারূপী তুমি জন্ম-ভূমি-স্তনে!/আর কি হবে দেখা?  

(২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পদ্মা’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যজীবনের এক বড় প্রেরণাই হচ্ছে নদী্। তার কবিতা ও গানের এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে পদ্মা নদী। জমিদারি দেখাশোনা করার জন্য তৎকালীন পূর্ব বাংলায় যখন ছিলেন তখন সেখানে তিনি পদ্মার ওপর বোটে বসে তার সময় কাটিয়েছেন। পদ্মার নদীর চারপাশের প্রকৃতি তিনি তুলে ধরেছেন ‘নদী’ শীর্ষক  তাঁর  বিখ্যাত কবিতার মধ্য দিয়ে। কবির কাব্যভাবনায়  পদ্মা হয়ে উঠেছে তাঁর জীবন দেবতা। কবি যে কত অন্তরঙ্গভাবে তার মানসপটে পদ্মাকে ধারণ করেছেন এবং তার কবিকল্পনার সৌরভ ছড়িয়ে দিয়েছেন কবিতাটি পড়েই বোঝা যায়। “হে পদ্মা আমার,/তোমায় আমায় দেখা শত শত বার।/একদিন জনহীন তোমার পুলিনে,/গোধূলির শুভলগ্নে হেমন্তের দিনে,/সাক্ষী করি পশ্চিমের সূর্য অস্তমান/তোমারে সঁপিয়াছিনু আমার পরান।” কবি পদ্মাকে কখনো দেখেছেন প্রেয়সীরূপে। পদ্মার প্রতি তার আবেগ, ভালোবাসা এবং উচ্ছ্বাস ইন্দিরা দেবীকে লেখা তাঁর চিঠিপত্র ‘ছিন্নপত্রে’ নান্দনিকভাবে উঠে এসেছে। তাই পদ্মাকে ভালোবেসে নদীমুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ বলছেন- ‘বাস্তবিক পদ্মাকে আমি বড়ো ভালোবাসি। ইন্দ্রের যেমন ঐরাবত তেমনি পদ্মা আমার যথার্থ বাহন …. খুব বেশি পোষমানা নয়, কিছু বুনোরকম … কিন্তু ওর পিঠে এবং কাঁধে হাত বুলিয়ে ওকে আমার আদর করতে ইচ্ছে করে।’

(৩) কাজী নজরুল ইসলামের ‘কর্ণফুলি’ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায়ও নদীকে নানা ব্যঞ্জনায় ফুটিয়ে তুলতে দেখা যায়। তাঁর হৃদয়ের ব্যথা প্রকাশ করেছেন তাঁর প্রিয় কর্ণফুলী নদীর কাছে। “ ওগো ও কর্ণফুলী,/উজাড় করিয়া দিনু তব জলে আমার অশ্রুগুলি।/যে লোনা জলের সিন্ধু-সৈকতে নিতি তব আনাগোনা,/আমার অশ্রু লাগিবে না সখি/তার চেয়ে বেশি লোনা!/তুমি শুধু জল করো টলমল;/নাই তব প্রয়োজন,/আমার দু’ফোঁটা অশ্রুজলের এ গোপন আবেদন।” কর্ণফুলীর যৌবনোচ্ছল দেখে কবি তাঁর স্মৃতিবিজড়িত বেদনামধুর দিনগুলোর কথা স্মরণ করে বলছেন, “ওগো কর্ণফুলী!/তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কান-ফুল খুলি’।/তোমার স্রোতের উজানে ঠেলিয়া কোন্ তরুণী কে জানে,/”সাম্পান”-নায়ে ফিরেছিল তার দয়িতের সন্ধানে?/আনমনা তার খুলে গেল খোঁপা কান-ফুল গেল খুলি’/সে ফুল যতনে পরিয়া কর্ণে কি কর্ণফুলী।”

(৪) জীবনান্দের ‘ধানসিঁড়ি’ কবি জীবনান্দ দাশ তাঁর মাতুলালয়ে বেড়াতে এসে ধানসিঁড়ি নদীকে অেবলোকন করে মুগ্ধ হয়েছেন । এই নদীর অপরূপ সৌন্দর্যে এতোই বিহ্বলিত ছিলেন যে পরবর্তীতে ধানসিঁড়িকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেন- “আবার আসিব ফিরে ধানসিড়ির তীরে — এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয় — হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে; হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে” তিনি বারবার ফিরে আসতে চেয়েছেন ধানসিঁড়ির তীরে এই বাংলায়। কবি তাঁর জন্ম স্থানের ধানসিঁড়ির পাড়েই শঙ্খচিল বা শালিকের বেশে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন।  

(৫) আহসান হাবীবের ‘মেঘনা’ কবি আহসান হাবীবের কবিতায়ও নদীর প্রসঙ্গ এসেছে। তার বিখ্যাত কবিতা ‘মেঘনা পারের ছেলে’ আমাদের সবারই জানা। মেঘনার দুই তীরের মানুষ এবং তাদের জীবনযাত্রা গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে যা এই কবিতার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। “আমি মেঘনা পারের ছেলে/মেঘনা নদীর নেয়ে আমি, মেঘনা পাড়ে বাড়ি।/ইচ্ছে হলেই এপার থেকে ওপারে দেই পাড়ি।/তালে তালে তালের নৌকা দু’ হাতে যাই বেয়ে/আমি মেঘনা নদীর নেয়ে ”

(৬) হাসান হাফিজুর রহমানের ‘যমুনা’ বাংলা সাহিত্যের প্রগতিশীল ও প্রতিবাদী চেতনার অন্যতম কবি হাসান হাফিজুর রহমান। তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে যমুনার উন্মত্ততা। তিনি নদীকে তিনি বাংলার চাষিদের মতো ঘাড় বাঁকানোর সাথে উপমায়িত করেছেন। তাঁর ‘স্তব্ধ মুখ’ কবিতায় তিনি তুলে এনছেন একরোখা পদ্মা ও যমুনার কথা।নদীর দুই তীরে যে পলি জমে বিস্তৃত ডানার মতো পূর্ব-পশ্চিমে ছড়িয়ে থাকা বিস্তৃত দিগন্তের অপার সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন। “নিরবধি কাল পদ্মা যমুনা বাংলারই/যদিও একরোখা গোঁ-ধরা ষাঁড়ের/মতো কিংবা বাঙাল চাষার মতো ঘাড় বাঁকানো।/দু’ ধারে তার বাৎসরিক পলিমাটি/আবাদে-অনাবাদে, ভালোমন্দে গড়ে ওঠা/পূর্ব-পশ্চিমের বিস্তৃত ডানা।”  

(৭) আল মাহমুদের ‘তিতাস’ বাংলা কবিতার অন্যতম প্রাণপুরুষ কবি আল মাহমুদ। তিনি প্রেমে পড়েছিলেন তিতাস নদীর।  প্রকৃতির প্রেমে আচ্ছন্ন হয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্যময় রূপকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তাঁর কবিতা ‘তিতাস’-এ। “আবার দেখেছি সেই ঝিকমিক শরীর তিতাস/কী গভীর জলধারা ছড়ালো সে হৃদয়ে আমার।/সোনার বৈঠার ঘায়ে পবনের নাও যেন আমি/বেয়ে নিয়ে চলি একা অলৌকিক যৌবনের দেশে।”

(৮) রফিক আজাদের সোমেশ্বরী কবি রফিক আজাদের নদী সোমেশ্বরী। এই নদী পারের মানুষের জীবনযাপনের দিনলিপির কথা অঙ্কিত হয়েছে তার নিদী বিষয়ক বেশ কয়েকটি কবিতায়। নদী যে আসলে মানুষের বোধের অতীত, সে যে শুধু নিজের গতিতেই চলে এবং নিজের মতো করে ভেঙে চলে দুই তীর। তিনি সোমেশ্বরী নদীকে ব্যক্ত করেছেন এভাবে- ”সোমেশ্বরী নামে এক নদী/মানুষের ভুলে গিয়ে প্রিয় দেবতারে/ভুলে বসতিটি গড়ে করে ভুলে-ভরা তুচ্ছ জীবনযাযন!”

(৯) মহাদেব সাহার ‘কীর্তনখোলা’ প্রেমের কবি, চির-আবেগের কবি মহাদেব সাহা তাঁর ‘এই যে বর্ষার নদী’ কবিতায় তিনি তাঁর প্রিয় নদী কীর্তনখোলাকে তুলে এনেছেন। বর্ষাকালের গ্রামের পরিবেশ ও নদীর ভরা যৌবনের কথা তুলে ধরেছেন। বর্ষাকালে নদীর উত্তাল ঢেউ এবং তার জলে খেলা করে চাঁদের আলো- তা অপরূপ ব্যঞ্জনায় চিত্রিত হয়েছে এভাবে, ” দ্যাখো এই বর্ষাকাল, গাঁ-গেরামে ফুঁসে ওঠে নদী/হাঁসেরা নেমেছে জলে আমাকে বিভোর করো যদি,/কীর্তনখোলার বুকে উঠিয়াছে পূর্ণিমার চাঁদ/সেখানে পরানসখা-তুমি আমি দুজনে বিবাদ।”

(১০) নিমলেন্দু গুণের ‘কংশ’ রোমান্টিক কবিতার পুরধার কবি নিমলেন্দু গুণ তার প্রিয় নদী কংশ নদকে তুলনা করেছেন সমুদ্রের সঙ্গে। কবি নদীপ্রেমী মানুষকে তাঁর কংশ নদের অপরূপ সৌন্দর্য দেখার আহ্বান করেছেন। কেননা এ নদী কবির শৈশবের নদী। কংস কবিতাটিতে কবি কংশ নদের রূপ ও সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন। “একবার এসেই দেখুন, কংশ নদের সঙ্গে সমুদ্রের বেশ মিল আছে।/একবার এসেই দেখুন, কংশ স্রেফ প্রথাসিদ্ধ শান্ত নদী নয়,/এখানে গর্জন আছে, শোঁ-শোঁ শব্দে হাওয়া ছোটে রাতে,/ঢেউ এসে সজোরে আছড়ে পড়ে তীরের নৌকায়।”