বাংলাদেশি চলচ্চিত্র নিয়ে একজন সাধারণ দর্শকের বক্তব্য, শুনবেন কী?

ছবি- ফ্লিকার থেকে

সালটা ঠিক মনে নেই হয়তো ১৯৯৬ জীবনের প্রথম সিনেমাটি দেখেছিলাম কিয়ামত থেকে কিয়ামত। যদিও ছবিটি রিলিজ হয়১৯৯৩ সালে। আর আমার তখন বয়স মাত্র দুই! যা হোক পরিচালক ছিলেন সোহানুর রহমান সোহান। একজন বাংলাদেশের গুনী পরিচালক। আর আমি তার অন্ধ ভক্ত। বুদ্ধি হওয়ার শুরুর দিকেই এক কথায় আধুনিক সিনেমার দেখার সুযোগ পেয়েছি। আর সিনেমার প্রতি গভীর টান তখন থেকেই শুরু। সিনেমা বলতে টেলিভিশনে যা দেখতাম তা সবই বাস্তব মনে করতাম। সে তা এক শিশুময় মজার অনুভুতি,যা ভোলার নয় কোনো দিন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বুঝতে লাগলাম একটা সিনেমা বানাতে আসলে কি কি প্রক্রিয়া পেরোতে হয়। আসলে কোন রিসার্চ যাতীয় কিছু নয়,বলতে পারেন কৌতূহল থেকেই আসলে কিছুর প্রশ্ন খুজতে গিয়েই….

আসল কথায় আসি…..

এই ছোট জীবনে আমি অনেক কিছুই দেখেছি এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির।

কত ভাঙগা গড়া, যেমন সালমান শাহ্-র মৃত্যু (বয়স কম থাকলেও আবেগী মন ভেতরটা চুরমার করে দিয়েছিলো আমার) এর পর আরও অনেকের ছবি দেখেছি মান্না, রুবেল, আমিন খান, শাকিল খান, রিয়াজ, ফেরদৌস, অমিত হাসান, শাকিব খান ইত্যাদি।

বাংলাদেশের মানুষ সিনেমাকে কিভাবে আপন করে নিয়েছিলো তা আমি নিজে স্বাক্ষী। এর পর এলো এক ভাইরাস! ২০০০ সালের পর। বাংলা সিনেমার এক ভয়ংকর কীট, যা অনেকের ভাষায় ‘ন্যাকেট’। সুশীল সমাজ সিনেমা বিমুখ হয়ে উঠলো। সিনেমা হলে দুষ্ট লোকের আনাগোনা বাড়তে লাগলো। গুনী সামাজিক সিনেমা নির্মাতা, প্রযোজক মহোদয়গন আর্থিক ভাবে বিপর্যস্ত হলো। ফলে ভালো মানের নির্মাতা কমে গেলো। সেই সাথে কিছু চরম ঘৃণীত মানষিক বিকার গ্রস্ত নির্মাতা মাথাচড়া দিয়ে দাড়ালো। এরা সিনেমা বাক্যটির নতুন শব্দার্থের গঠন করল তা হলো ব্লু-ফিল্ম! বেশ কয়েক বছর যাবৎ আমাদের এই সব “স্যারেরা” আমাদের ক্লাসে এগুলো শিখাতে বাধ্য করলো।

আমার মতে তৎকালেই বাংলা সিনেমার মহা দুর্দশার বীজ বুনে রাখে এসব পাপীরা। আমাদের বীরেরা তাদের এই আপকর্মের জন্যই কি দেশটা স্বাধীন করছিলো? না মোটেও নয়! প্রশাসনও সেসময় কিছুটা নিষ্ক্রিয় ছিল,তারপর কিন্তু বন্ধ করেছে বেশ ঢাক ঢোল বাজিয়ে!তারপরেও সরকারকে অসংখ্য ধন্যবাদ অনেক দেরি হবার আগেই এদের নির্মুল করে চলচিত্র-কে শিল্প হিসেবে ঘোষনা করার জন্য।

আচ্ছা এর পর চিত্র নায়ক মান্নার হাত ধরে এই ইন্ডাস্ট্রি অনেক অনেক উচ্চতায় উঠে এল। তার পরেও সাধারণ দর্শকেরা যেনো সেই পুরোনো নোংরা স্মৃতি ভুলতে পারেনি। তার পর হঠাৎ একদিন মান্নাও না ফেরার দেশে চলে গেলেন। ইন্ডাষ্ট্রির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো। আবারও বুকটা চিরে যেনো বিশ টুকরো হলো আমার। এবার না কেঁদে আর পারলাম না।

আল্লাহ্ তাকে বেহেস্ত নাসিব করুন(আমিন)।

আসলে একজন চলে গেলেও সেই স্থান বেশিদিন শুণ্য দেখতে হয়নি আমাদের। তারই এক উত্তরসূরী একজনকে নায়ক হিসেবে পেলাম আমরা। শাকিব খান, হ্যা ঁতাকে আরও আগেই ইন্ডাষ্ট্রি বানিয়েছিলো।

কিন্তু ‘কোটি টাকার কাবিন’ সিনেমার মাধ্যমে তার যোগ্যতা,ক্ষমতা,গুণ তাকে আবারও নতুন করে পরিচয় করে দিলো।

তার যাদুতে সিনেমা পাড়ায় মানুষের ভীড় বাড়তে লাগলো। আমরা অনেক অনেক সফল সিনেমা পেলাম।

ততদিনে আমাদের দেশে মোবাইল নামের উন্নত যাদুর বক্স বেশ সস্তায় আমাদের হাতে পৌছে গেলো। এই জিনিসটার ফিচার উন্নত হতে হতে আর আমাদের ‘সিনেমা হল’ আমাদের পকেটে চলে আসলো! সাথে পাইরেসিও বেশ লাগাম হীন বেড়ে চললো। সাথে ডিজিটাল বাংলাদেশের যাদুতে আমরা পেলাম সহজ ইন্টারনেট। “ডাউনলোডার হিরোরা” পরম মমতায় আমাদের হাতে পৌঁছে দিতে লাগলো একের পর এক বিদেশী সিনেমা(বিশেষ করে বলিউড, টালিউড) এসব আরও আগেও এসেছে কিন্তু তেমন সহজ লভ্য ছিলোনা তখন। সো আমরা সমস্ত কিছু দেখলাম নিরব দর্শক হিসেবে। বিদেশী সিনেমা দেখতে দেখতে দর্শকদের চোখ খুলে গেলো(বিশেষ করে তরুনদের)। বিদেশিদের সিনেমার গল্পের ভিন্নতা,উন্নত টেকনিক্যাল সাপোর্ট,অ্যাকশন ইত্যাদি মুলত এদেশের মানুষের দেশি সিনেমা থেকে মুখ ঘোরাতে বাধ্য করেছে। আচ্ছা এখন আমার প্রশ্ন,দোষটা কার? দর্শকদের? আপনার উত্তর যদি হয় হ্যাঁ, তবে বলব আপনি প্রচন্ড দেশ প্রেমী,তবে বুঝার ক্ষেত্রে আপনারও কিছুটা ভুল হলো। আসলে এ দেশের প্রযোজক ও নির্মাতারা ঘোলকে দুধ বলে বিক্রি করার কৌশল আয়ত্ব করে রেখেছিলো। মানে অল্পতে বেশী পাবার আশা! আর সে জন্যই তারা ছোট খাট অনেক কাজই অাছে যা তারা আর ডেভলপ করার প্রয়োজন মনে করেন নি। তারা সেটা জানেন বুঝেন কিন্তু করেন নি। অথচ এক সময় কলকাতার শিল্পীরা এখানে কাজ করে সম্মান বোধ করতো। মাত্র দেড় দশকে দৃশ্যপট একেবারে উল্টে গেলো। তাদের চলচিত্র উন্নত হলো ব্যাপক হারে। আর আমরা আমদের রাখলাম ঘোর অন্ধকারে। ভাই কি বলেন, আমরা আমাদের দায়িত্ব ঠিক মতো পালন করলে,এই অল্পতে বেশি না খেলে হয়তো আজ আমরা তাদের থেকে অনেক অনেক উচুতে থাকতাম।দিন বদলের সাথে সাথে না চলতে পারলে ছেলে বাবার কথা কতক্ষন শুনবে?

নিজেরা তো পারেন না, দুই বাংলা মিলে সিনেমা তৈরি করছে, দর্শক সিনেমা হল মুখী হচ্ছে, ভাল সাড়া মিলছে, তা হলে কেন এত শোরগোল পাকানো? মিশা সওদাগর,রিয়াজ,ডিপজল এরা তো অভিনেতাই। কেনো তারা এমনটা করছে? সম্ভাব্য কারণ আমার মতে- ১,শাকিবের উন্নতিতে গা জ্বলা ২,সাংগঠনিক ভাবে নিজের গদি পাকা পোক্ত করা। আচ্ছা দেশের সকলেই জানে শাকিব ‘শিকারি’ ছবিতে চুক্তি হওয়ার সময়ই তাকে শিল্পী সমিতি থেকে জোর করে পদত্যাগ করানো হয়েছিলো,তাতেও তাতের ক্ষুধা মেটেনি! ‘শাকিবের ছবি কেমন করে চলে দেখে নেব’ ,এসবও বলতে শুনেছি। তাকে বয়কট করা হলো, আসলে আর কি চায়? মিশা সওদাগর, রিয়াজ,আলমগীর এসব কেন করছে? না তাদের কেউ করাচ্ছে! তাও অসম্ভব নয়, নির্মাতা প্রযোজকেরা হয়তো টাকার বিনিময়ে বা ক্ষমতার দাপটে করাচ্ছে,আমি অাসলে বলতে বাধ্য হচ্ছি। তা না হলে প্রথম অপশনটাই গ্রহনযোগ্য, গা-জ্বলা! আর আমরা এ অপশন টা কোন অবস্থাই আশা করিনা। কারন সিনেমায় যারা কাজ করেন তারা আমরা সাধারণ মানুষের কাছে গুণী জন হিসেবেই বিবেচিত। তারা আমাদের বিনোদন দিয়ে থাকেন। আর আমি তাদের সবচেয়ে সভ্য হিসেবেই বিবেচনা করি। আর হওয়া উচিৎ তো তাই। কিন্ত যেন আচমকা ভিন্ন পরিবেশ উপস্থাপন করলেন তারা! শিল্পি সমিতি নির্বাচনের দিনে শাকিবকে মেরে এই সম্মানিত শিল্পীরা তাদের হিংসাত্বক রুপ প্রকাশ করে। আমার মনে আছে একবার এক বন্ধুর সাথে এফ,ডি,সি-তে গিয়েছিলাম। মিশা সওদাগর সাহের সাথে দেখা করার সুযোগও মিলে যায়! তিনি মাথায় টুপি পরা অবস্থায় নামাজে যাচ্ছেন হয়তো। কিন্তু তাকে বিরক্ত করার সাহস করতে পারিনি,কারণ তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমাকে আটকে দিয়েছে।

শুধু আমি না আমার মত লক্ষ কোটি ভক্ত তাদের এই রকম ভাবে ভালোবাসছে প্রতি নিয়ত। কিন্তু তারা তাতের ভেতরের কোন্দল প্রকাশ দায়িত্ববোধকে চরমভাবে অবহেলা করছে। আচ্ছা তারা যে নিয়ম নিয়ে কথা বলছে তার বেশিরভাগ বিষয় প্রশ্নবিদ্ধ, তারা এটা জানেন, আর এটা যে একমাত্র সাকিবকে ঠেকানোর পাঁয়তার,সবাই এটা ভালো করেই বুঝেছে। তবে দেশের মানুষ সাকিব খানকে হৃদয়ের গভির থেকে ভালোবাসে। হ্যাঁ, শাকিব খানের কিছু অন্যায় হয়েছে, সে থাকার পরও এফ,ডি,সি র আধুনিকায়ন না হওয়াতে  সমালোচনা হয়েছে।

সম্মানিত শিল্পী সমিতির সকল সদস্যর প্রতি অনুরোধ আপনাদের যখন আন্দোলনের শখ রয়েছে তো ভিন্ন টপিক ব্যবহার করুন, সাধারণ মানুষ আপনাদের সায় দেবে। আপনারা দেশের সকল সিনেমা হল সংস্কারের উদ্যোগ নিন সাথে নতুন হল তৈরির তাগিদ দিন সরকারের কাছে। সিনেমাতে আপনাদের নেগেটিভ চরিত্রের কাজ আমারা উপভোগ করি কিন্তু তা বলে বাস্তবে করে দেখানোর প্রয়োজন কিন্ত একদমই নেই……

আমি কক্সবাজারের একটি উপজেলাতে থাকি কিন্তু এখানে আসে পাশে কোন হল নেই। শুধু এখানে কেনো বাংলাদেশের অনেক এলাকায় নেই সিনেমা হল। আশা করি আপনাদের মাধ্যমে এসব এলাকায় নতুন করে হল নির্মিত হবে।

বাংলাদেশের মানুষ সংস্কৃতি মানুষ। সিনেমার এক অপার সম্ভাবনা রয়েছে এতে। তবে দর্শক নতুন ধারার সিনেমা দেখতে চায়, এটা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে।

সর্বশেষ একটি কথাই বলব, শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।

সবাই ভাল থাকবেন, আল্লাহ্ হাফেজ।