ভৌতিক গল্প- লোকটি কথা দিয়েছিল, সে “আত্মা” দেখাবে

অজয়ের আত্মা দেখার ইচ্ছে বহুদিনের। বহুদিন আগে কোকড়া চুল, দাড়িগোঁফ ভর্তি অদ্ভূত এক লোক  অজয়কে বলেছিলো আত্মার কথা। জানিয়েছিলো- মানুষ মরে গেলে হারিয়ে যায় না, মৃত্যুর পর আত্মা  হয়ে ফিরে আসে। গভীর রাতে ঘুরে বেড়ায়। কখনও একা, কখনোবা  দল বেঁধে। ওরা প্রিয়জনদের দেখতে আসে। প্রিয় স্থানের মায়ার টানেও আসে। কেউ কেউ আসে কিছু আনন্দঘন মুহূর্ত কাঁটাতে। মুক্ত হাওয়ায় প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে। সেই থেকে অজয় রাতের পর রাত দূরবীণ চোখে  অপলক দৃষ্টিতে ছাদে বসে থাকে। কিন্তু আত্মার সন্ধান মেলেনি।

স্পষ্ট মনে আছে, অদ্ভুত লোকটি বলেছিলো- আত্মারা মানুষের রূপ বেশি নেয়। মানুষের সাথে দেখা হলে সালাম দেয়। ভদ্রতার সাথে কথা বলে। ফলে আত্মা চেনাও কষ্টকরই বটে! তবে অজয়ের দৃঢ় বিশ্বাস-  আত্মার সাথে তার একদিন না একদিন সাক্ষাত হবেই।

এভাবে অনেক দিন গেল। রাত জেগে জেগে অসুস্থ হয়ে গিয়েছে। আত্মার দেখা মিলছে না। এদিকে অসুস্থতার কারণে কাজে মন দিতে পারছে না। ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলো। একমাস রাত জাগা যাবে না- বলে দিয়েছেন ডাক্তার। কিন্তু আত্মার দেখা না পেলে অতৃপিত থেকে যাবে। অজয় অতৃপ্ত থাকতে চায় না।

অদ্ভুত লোকটি বলেছিলো- কোনো এক পূর্ণিমায় আত্মারা সবাই একত্র হয়। ওরা দলে বিভক্ত হয়ে নাচে, গায়, আড্ডায় মজে। কিন্তু সেটা কোন পূর্ণিমা, তা বলেনি। অজয় প্রতি পূর্ণিমায় খেুব সজাগ থাকে। কান খাড়া রাখে। চোখ রাখে তীক্ষ্ণ।

আজ পূর্ণিমা। বাইরে সুকান্তের ঝলসানো চাঁদ। ডাক্তারের নিষেধের কারণে ঘর থেকে বের হতে পারছে না অজয়। অথচ আজ যদি সেই পূর্ণিমা হয়। অজয়ের মন খারাপ। দখিনের জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে আছে। জানালার কিছু দূরে সমুদ্র। ছাদ থেকে সমুদ্রের পাড় স্পষ্ট দেখা যায়। অদ্ভুত লোকটি বলেছিল- পূর্ণিমার রাতে আত্মারা সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসে ভেসে তীরে আসে। কিন্তু যেখানে সমুদ্র নাই?- মনে প্রশ্ন জেঁকে বসে। পরেক্ষণে আবার মনোযোগী হয়ে। যেখান থেকে পারে আসুক। তার কাছেই সমুদ্র। তাকে সমুদ্রের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

রাতের প্রথম প্রহর। জোছনা বৃষ্টি হচ্ছে যেনো। অজয়ের মন ছটফট করছে। আজ মধু-পূর্ণিমা। আত্মারা না বেড়িয়ে পারবে না। যে করেই হোক বাহিরে যেতে হবে। অজয় চুপিচুপি দরজা খুলে বের হয়ে ছাদে গেল। দূরবীণ হাতে চেয়ারে বসলো।

সাগরে ঢেউয়ের তীব্র গর্জন কান ছুঁয়ে যাচ্ছে। রাতের দ্বিতীয় প্রহর প্রায় ছুঁই ছুঁই। সাগরের ঢেউ ঘেঁষে একদল সাদা পোশাকধারী তীরে আসতে দেখা গেল। সহসা অজয়ের মুখে আনন্দের হাসি ফুঁটে উঠলো। এরাই আত্মা হবে। অজয় কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। দৌড়ে কাছে যাবে, না ছাদে বসেই আত্মাদের কার্যলাপ দেখবে? কাছে গেলে যদি আত্মারা হারিয়ে যায়? তাহলে এতদিনের স্বপ্নের প্রতীক্ষা ব্যর্থ হয়ে যাবে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আজয়। দ্রুতই স্বাভাবিক হলো। অনেক ভেবে সিদ্ধান্তে আসলো। ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আত্মা দেখবে। দূরবীণে সাগর পাড় স্পষ্ট দেখায়। সাদা পোশাকের সারিবদ্ধ দল। একটি নয়, দুটি নয় অনেকগুলো। ওরা এক একটা দল এক এক স্থানে। অজয় অপলক দেখতে থাকে।

অজয়ের অনেক সাহস। তারপরও কিছু ভয় কাজ করছে। শরীরের পশম কিছুটা দাঁড়িয়ে গেছে।  নিজেকে নিজেই সাহস দেয়- ভয় করা যাবে না। একদমই না। ভয় করলে আর আত্মা দেখা যাবে না। এই দিনটা জীবনে দ্বিতীয় বার নাও আসতে পারে। রিলাক্স অজয়, রিলাক্স।

সাগরের পাড় ঘেঁষে কিছু সাদা পোশাকধারী গুটিসুটি হয়ে পরামর্শ করছে- দেখতে পেলো। এর কিছু দূরে একদল হলুদ পাঞ্জাবী ও হলুদ লুঙ্গির কয়েকজনকে দেখলো। মাথায় বড় বড় চুল। হাতে বাউলের যন্ত্রাদি। একতাঁরা, সেতার, ঢোল, বাঁশি, খঞ্জন। অজয় এতখনে বুঝতে পারলো। ওরা বাউল। যাদের একমাত্র পেশা গান। বনে-বাদারে, গ্রামে-গঞ্জে খঞ্জন, বাঁশি, একতারা বাজিয়ে গান করে। পালা গান, যাত্রা গান,আধ্যাতিক গান। আজও ওরা গান ধরছে। কেউ কেউ গানের তালে মাথা ঝোকাচ্ছে। আবার কেউ মৃদ্যু তালে কোমর দুলাচ্ছে। অনেক দূরে একদলকে দেখা গেল ধ্যান মগ্ন অবস্থায় আসন গেড়েছে। সাদা পাঞ্জাবী, পাকা গোঁফ-দাড়ি, মাথায় পাগড়ি হাতে তসবি। ওরা প্রভুভক্ত। এর কিছু দূরে একদল বামুন ঢাকের তালে নাচছে। পাশে কিছু পুরোহিত রামরাম কৃষ্ণকৃষ্ণ নমস্কার দিচ্ছে দেবীর পায়ে। যীশুসূত্রের সামনে আরেক দল প্রার্থনা করছে। যে যার মত কাজ করে যাচ্ছে। কেউ কাউকে বিরক্ত করছে না।

 

অজয় এবার সাহস করে ছাদ থেকে নামলো। সোজা সাগর পাড়ে গেল। কাছ থেকে সব অদ্ভুত মনে হলো।

আত্মা মানুষের ছদ্মবেশ ধারণ করে । নিজের চোখে দেখে বিশ্বাস হলো। অদ্ভুত লোকের সব কথা সে মেনে নিতে পারেনি। এখন মানতে হচ্ছে। হুবুহু মানুষের মত কণ্ঠ, মানুষের মতই অঙ্গ। মানুষের মত বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করতে দেখে অজয় বিস্মিত। অদ্ভুত লোকটি বলেছিলো। মানুষ বেঁচে থাকা অবস্থায় যা যা করে মৃত্যুর পর আত্মারাও একই কাজ করে। খুব কৌতূহলজনক। এবার অজয় বাউল দলের কাছে গেল। বসে গান শুনছে। হঠাৎ অজয় কাউকে দেখে হটচকিয়ে উঠল। গানের দলের মধ্যেয একটা পরিচিত মুখ। খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। কোথায় যে তাকে দেখছে ঠিক মনে পড়ছে না।

অজয়কে চিন্তিত দেখায়। লোকটি অজয়কে দেখে ভিড় ঠেলে সামনে আসল। অজয়ের পাশে বসল।

-আমাকে চিনতে পারছো? অজয় হা করে থাকে।কিছু বলতে পারলো না।

-বুঝেছি তুমি চিনতে পারোনি।

-নজির উদ্দিন চাচাকে কি মনে পড়ে তোমার? ঐ যে গ্রামের দূর সম্পর্কের চাচা।মাঝে মধ্যেয় তোমাদের বাসায় আসতো।তোমাকে অনেক গল্প শুনাতো। অজয়ের মুখে হাসি ফুঁটলো।পরিচিত মুখটি মনে পড়ে গেল।এ যে আত্মার সমন্ধে বলেছিল অদ্ভুত সেই লোকটি। কোকড়া চুল, গোফ-দাড়িতে মুখ ভর্তি। অজয় জানতো অদ্ভুত লোকটি দূর সম্পর্কের আত্মীয় হয়।

– তোমার চোখ দেখে বুঝেছি । তুমি আমাকে চিনতে পারছো।

অজয় মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিল।

– একদিন তোমাকে আত্মার গল্প বলেছিলাম। মনে পড়ে কি?

– হ্যাঁ। সবকিছু মনে আছে।

– আজ এখানে যাদের দেখছো।একমাত্র তুমি ছাড়া সবাই আত্মা।

– তার মানে আপনিও?

– হ্যাঁ। গত বছর আমি মারা গিয়েছি।তুমি হয়ত আমার মৃত্যুর খবর জানো না।আমিও আত্মা। আজ বৈশাখী পূর্ণিমা। সবচেয়ে বড় পূর্ণিমা। আত্মাদের ছুটি।আত্মারা সবাই একত্র হয়েছে।সবাই সবার কাজে ব্যাস্ত।ধল প্রহরের আগেই আবার সবাই চলে যাবে।

– আত্মাদের নিদিষ্ট কোন ছুটি থাকে?

– অবশ্যই। থাকবে না কেন? আত্মারা এক সময়তো মানুষই ছিল।আজ হয়ত মরে গিয়ে আত্মা।তাই বলে কি তাদের ছুটি থাকবে না, এটা কেমন কথা। তবে আত্মাদের ছুটির তালিকা মানুষের মত বেশি না।খুব স্বল্প।বছরে সবোর্চ্চ দুই তিন রাত।

– বলেন কি?

– হ্যাঁ। তোমার ভয় করছে না?

– না। আত্মারাতো মানুষের মতই।ভয় করবে কেন?

-হা-হা-হা।বুঝেছি তুমি অনেক সাহসী।একদিন অনেক কিছু করতে পারবে। নজির উদ্দিনের সাথে এভাবে কথা বলতে বলতে রাত প্রায় শেষ পর্যায়। আত্মারা সবাই তৈরি হয়েছে গন্তব্যর দিকে রওনা হবে। নজির উদ্দিন অজয়কে বলল,

-বাসায় চলে যাও।একদিন কথা দিয়ে ছিলাম। তোমাকে আত্মা দেখাব।আজ দেখালাম।ভালো থেকো।শুভ বিদায়।আবার কোন একদিন দেখা হবে।

হঠাৎ এক ঢেউয়ে সবাই অদৃশ্য হয়ে গেল। অজয় এখানে সেখানে খুঁজলো। কাউকে দেখতে পেল না। অনেকটা সময় সাগর পাড়ে দাড়িয়ে থাকলো। মন খারাপ করে বাসায় ফিরল। নজির উদ্দিনের মুখটা শুধু চোখের সামনে ভাসতে থাকল।আত্মারা বুঝি এমনি অদৃশ্য।