ক্রিকেট তো নয়, এ যে এক সুখের কাব্যগাঁথা!!!

শুক্রবার হলেও টিউশনি ছিলো। সাততাড়াতাড়ি সবগুলো শেষ করে বাসায় এসে পড়েছি। এসেই রান্নাঘরে, ইফতারি বানাতে শুরু করে দিয়েছি। আজকে যে বাংলাদেশের খেলা আছে! আগে আগে কাজ শেষ হলেই আরামসে খেলা দেখতে বসবো জাঁকিয়ে!

বৃষ্টির কারনে খেলা শুরু হলো দেরিতে। আমার কোনও আপত্তি নেই। হোক না, দেরিতে শুরু, খেলা পুরোটা হলেই হলো। টসে হেরে গেলো মাশরাফি। বাংলাদেশের বোলিং। কিন্তু তাতে কী? টস জিতলেও ম্যাশ বোলিংই নিতো। তারমানে টস তো আমরাও জিতলাম, নাকি?

রান্নাবান্না শেষ হয়নি, তাই টিভির সামনে বসে টানা খেলা দেখতে পারছিলাম না। একটু পর পর উঁকি দিয়ে স্কোর দেখছিলাম কেবল। নিউজিল্যান্ডের রানের চাকা ঘুরছে …
৪৬ রান … তাসকিন যাচ্ছে বোলিং এ …
তাসকিনকে আজকে দেখেই মনে হলো, আজকে কি ও কিছু করে দেখাতে পারবে? খেলার আগে প্র‍্যাক্টিসরত অবস্থায় কী মায়া মায়া দেখাচ্ছিল চেহারাটা, মনে হচ্ছিল যেন,বেচারার কেউ নাই!

যাকগে, ৮ম ওভারের প্রথম বল..
গুড লেন্থ এর বল.. উঠিয়ে দিতে চাইল লং অন অঞ্চল দিয়ে… কিন্তু ব্যর্থ হয়ে মুস্তাফিজ এর হাতে বল তুলে বিদায় নিল রঙ্কি!

ফুপাতো ভাই তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠতেই আমি রান্না রেখেই দৌড় দিলাম। তারপর রিপ্লে তে পুরো আউটটা রসিয়ে রসিয়ে দেখলাম।

খেলা চলছে। লম্বা রান আপ নিয়ে ১৩ তম ওভারের শেষ বল নিয়ে রুবেল আসছে … বল টা ছুটে আসল প্রবল গতিতে… সোজা মার্টিন গাপটিল এর প্যাডে….
তীব্র আবেদন এর বিপরিতে অ্যাম্পায়ার আংগুল তুলে সাজ ঘরের রাস্তা মাপতে বললেন গাপটিলকে।
৬৯ রানে গেল ২ উইকেট।

ততোক্ষণে আমার রান্নাবান্না শেষ। সব গুছিয়ে সুন্দরমতো গিয়ে বসলাম টিভির সামনে। সাথে সেই পুরোনো আহাজারি, উইকেট পড়ে না ক্যান?

টেইলর এর সাথে বড় এক পার্টনাারশিপ উইলিয়ামসনের …
সাকিব এর বল টেইলর ফাইন লেগ এর দিকে পাঠাল…
সৈকত বল তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারল সাকিব এর দিকে… এর মধ্যে ব্যাটসম্যান দের ভুল বোঝাবুঝিতে উইলিয়ামসন ক্রিজের মাঝখানে… প্রাণপণ চেস্টা করল ফিরে আসতে… বেকায়দা অবস্থায় ফিল্ডারের কাছ থেকে বল ক্যাচ করার পরেও সাকিব উইলিমসনে ফিরে আসার আগেই স্টাম্প ভেঙে দিল।
১৫২ তেই ৩য় উইকেট এর পতন।

তাসকিন এর স্লোয়ার বল এর ফাদে পা দিয়ে অভিজ্ঞ দর্জি খ্যাত ব্যাটসম্যান টেইলর এর ব্যাটের কানায় লেগে বল হাওয়ায়… ফাইন লেগ এর দিকে মুস্তাফিজ …. বল হাতের মুঠোয়।
বোলিংয়ে তাসকিন, ক্যাচিংয়ে মুস্তা! এই অদ্ভুত জুটিতে দুই দুইটা উইকেট পড়লো নিউজিল্যান্ডের।

৪র্থ উইকেট এর পতন হল ২০১ রানে…
নীল ব্রুম …
ম্যাশ এর ধুরন্ধর ক্যাপ্টেন্সিতে মোসাদ্দেক কে লাগালো বোলিংএ। ব্রুম চার্জ করতে চেয়েছিল মোসাদ্দেক কে… কিন্তু ব্যর্থ হয়ে তামিম এর হাতে ক্যাচ উঠিয়ে বিদায় নিল।
২২৮/৫

মাত্র এক রান পরেই করি এন্ডারসন মোসাদ্দেক এর দারুন বলে এল বি ডাব্লিউ হয়ে রানের খাতা খোলার আগেই ডাক মেরে বিদায় নিল।
২২৯ রানেই গেল ৬ষ্ঠ উইকেট

আবার ও মোসাদ্দেক কে চার্জ করে খেলার ভুল করেছিল নিসাম…
ডান্সিং ডাউন দ্যা ট্র‍্যাক…
কিন্তু লাগল না ব্যাটে…
মুশি স্টাম্পিং করে বিদায় দিল নিসাম কেও …২৪০/৭


২৫২ রানে চিরচেনা মুস্তাফিজ তার বিধ্বংসী ইউর্কার দিয়ে সাজঘরে ফেরায় এডাম মিলনিকে।
এর পরে আর উইকেট পড়েনি …২৬৫ /৮ এ শেষ করে খেলা নিউজিল্যান্ড।

ফার্স্ট ইনিংস খেলা শেষ হতেই নামাজে দাঁড়ালাম। শেষ কবে নামাজে বাংলাদেশ টিমের জয়ের জন্য দুয়া করেছিলাম, মনে নেই। সম্ভবত ‘১১ এর বিশ্বকাপের সময়। আজ আপনা থেকে মনে মনে বলে উঠলাম, “আল্লাহ! বাংলাদেশ যেন জিতে!”

বাংলাদেশের ব্যাটিং দেখার জন্য টিভি ছাড়তেই দেখি, রানের চাকা সচল হবার আগেই এক উইকেট নেই! কে গেল? নিশ্চয়ই তামিম, সৌম্য হলে তো মিনিমাম এক রান হবে!
হলোও তাই। বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যাটিং স্তম্ভই নেই! কী হবে এবার?

যা হবার, তাইই হলো। বাংলাদেশের টপ ওর্ডার তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়লো। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট পড়ে বাংলাদেশের অবস্থা দাঁড়ালো তেত্রিশ রানে চার উইকেট!

বিমর্ষ মুখে একা একা টিভির সামনে বসে মশার কামড় খেতে খেতে খেলা দেখছি। একলা একলা। মুশফিকের বোল্ড আউটটা যেন একদম কলিজায় এসে লাগলো। মনের ভুলে আঁতকে উঠেছি জোরেই! এবার কী হবে? আর কোন আশায় বুক বাঁধবো? সাকিব-মাহমুদুল্লাহ দুজনেই তো অফ ফর্মে। এবার কী হবে?

কী হলো?
এক কাব্যগাঁথা রচনা হলো। সাম্প্রতিক সময়ের দুই অফ ফর্মের প্লেয়ার বাংলাদেশের খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন! নিশ্চিতভাবে হেরে যাওয়া ম্যাচ জিতিয়ে দিলেন ২২৪ রানের পার্টনারশিপ করে!

নাম্বারের দিক দিয়ে বললে ওডিয়াই এর ৫৫ তম সেরা পার্টনারশিপ।
২য় ইনিংসের ক্ষেত্রে ১৩ তম।
আর ৫ম উইকেটে ২য় সেরা
তবে ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনা করে অনেক ক্রিকেট বোদ্ধার টপ লিস্টে এই পার্টনারশীপ জায়গা করে নিয়েছে।

নইলে,
৩৩-৪ থেকে ২৫৭-৪??
ভাবা যায়?

ওয়ার্ল্ড’স বেস্ট।

শুরুতে আশাহত হয়েছিলাম বলেই এতো বেশি আনন্দ পেয়েছি। নির্মল পবিত্র আনন্দ।

যারা চার উইকেট পড়ার পর খেলা দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন, তাদের জন্য সমবেদনা।

মিস্টার সাইলেন্ট কিলারের ক্লাসি ক্রিকেটে আমি মুগ্ধ। চুপচাপ নীরবেই যথাসময়ে নিজের কাজটা করে গিয়েছেন, অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দিত ক্রিকেট খেলে।
সবাই আজকে হয়তো স্বাভাবিকভাবে সাকিবের প্রশংসাই বেশি করবে। আমি একটু মাহমুদুল্লাহের সম্পর্কে বলি। একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন? সাকিব যখন নিজের ৬০ রানের সময় বারবার ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে এসে ডাউন দা উইকেট খেলতে চাইছিল,
স্যান্টনারের বল স্ট্যাম্প ছেড়ে এগ্রেসিভ খেলার চেষ্টা করছিল।
তখন ই অপর প্রান্ত থেকে রিয়াদ ভাই এসে না করলেন, বোঝালেন, আমাদের অনেকটা পথ যেতে হবে! সত্যিই তো! গিয়েছি আমরা।

আরেকটা ব্যাপার। রিয়াদ ভাইয়ের সেঞ্চুরির জন্য মাত্র দুই রান বাকি। সৈকত স্ট্রাইকে। সে এসে মারলো ঘুরায়া, রিয়াদভাই চাইলেই এক রান নিয়ে স্ট্রাইকে যেতে পারতেন, তা না করে দুই রানই নিয়েছেন, এবং পরে স্বাভাবিকভাবেই স্ট্রাইক পেয়ে চার মেরে সেঞ্চুরিইইইইই!

খেলা শেষে কমেন্টেটরের প্রশ্নের জবাবে মাহমুদুল্লাহ বলেন-
সবচেয়ে ভালো ব্যাপারটা এটা ছিলো যে, আমরা নিজেদের মধ্যে বেশি কথা বলিনি। আমরা শুধু ব্যাট করে গেছি, আর ক্রিজে একজন আরেকজনকে সঙ্গ দিয়েছি। শুরুর দিকে বেশ ধুঁকতে হয়েছে আমাদের। বল সুইং করার সময় শান্ত ছিলাম। সুইং বন্ধ হতেই খেলাটা সহজ হয়ে এসেছে। সাকিব যেভাবে ব্যাট করেছে সেটা প্রশংসারর দাবিদার। তামিম এই টুর্নামেন্টে চমৎকার ব্যাট করেছে। প্রথম ম্যাচে সেঞ্চুরির পর দ্বিতীয় ম্যাচে প্রায় সেঞ্চুরিই করে ফেলেছিলো। শুরুতেই তাকে হারিয়ে কিছুটা চমকে গিয়েছিলাম আমরা। তবে সাকিব-আমি মিলে একটা জুটি গড়েছি। বাজে বলের সন্ধ্যানে ছিলাম, বাজে বল পেলেই মেরেছি, আর সবসময় সিঙ্গেল নিয়ে স্ট্রাইক রোটেট করার চেষ্টা করেছি।

অভিনন্দন আলাইনার বাপ!
ফর্ম ফিরে পাবার জন্য। খারাপ সময়ে দলের হাল ধরার জন্য। এমন একটা অসাধারণ ইনিংস খেলে নিজেকে ফিরে পাবার জন্য।

ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হবার পর সাকিব যা বললেন –
মাহমুদুল্লাহ যেটা বলেছে, আমিও তাইই বলবো। আমরা ক্রিজে বেশি কথা বলিনি। শুধু এটুকুই বলেছি যে ‘কিপ গোয়িং’। টার্গেট নিয়ে ভাবিনি আমরা, শুধু ৪০ টা ওভার ব্যাট করে যেতে চেয়েছিলাম। আর, এখন দেখুন আমরা কোথায় এসে পৌঁছেছি। ভালো ব্যাপারটা হলো যে, আমরা সুইং বলগুলো খুব ভালোভাবে মোকাবেলা করেছি এবং মারার বল পেলে মেরেছি। আইসিসি টুর্নামেন্টে ম্যাচ জেতা অনেক বড় কিছু। গত দুই বছরে অনেক লম্বা একটা পেরিয়ে এসেছি আমরা। এখন এখান থেকে শুধু সামনের দিকেই এগিয়ে যেতে পারবো আমরা।


আমার লাইফে এতো সুন্দর, এতো ক্ল্যাসি ক্রিকেট, পার্টনারশিপ দেখি নি!

তবে কেবল সাকিবকে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ দেওয়ায় খারাপ লেগেছে। মাহমুদুল্লাহের সাথে যৌথভাবে দিলে খুব ভালো হতো। হ্যাঁ, সাকিব ব্যাটিংয়ের সাথে সাথে বোলিংয়েও ভালো করেছে। কিন্তু মাহমুদুল্লাহ তো অপরাজিত ছিল! লোকটা চিরাচরিত নিয়মে নীরবে পিছনেই রয়ে গেলো।

বারো বছর!
বারো বছরের এপার আর ওপারে দুইটা অভাবনীয় জয় এই কার্ডিফে! এই নিয়ে ক্যাপ্টেনের বক্তব্য –

চমৎকার এক অনুভূতি। দুইটা জয়ের সাথেই এখানে ছিলাম আমি। প্রথমে হারালাম অস্ট্রেলিয়াকে, আর এখন নিউজিল্যান্ডকে। সবমিলিয়ে, খুবই সন্তুষ্ট আমরা।
প্রথম ম্যাচের কথা ধরলে, আমরা আমাদের মানমতো খেলতে পারিনি। ৩০৫ করেও আটকাতে পারিনি। তবে, আজকে আমাদের বোলাররা সঠিক জায়গায় বল ফেলেছে। মোসাদ্দেকের তিনটা ওভার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। নিশাম ও কোরিকে আগেও আউট করেছিলো সে, এটাকে বেশ বড় বলে মনে হয়েছে আমার। মাহমুদুল্লাহ আর সাকিব যেভাবে খেলেছে, সেটা দেখে ২০১৫ এর কথা মনে পড়েছে আমার। আমরা জানতাম যে কাজটা কঠিন, তবে সেবার আয়ারল্যান্ডে তাদেরকে হারানোটা বেশ আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছিল আমাদের মধ্যে।

চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে টিকে থাকার জন্য আর কেবল একটা সমীকরণ বাকি। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়­া ম্যাচে ইংল্যান্ডকে জিততে হবে। তবে সেটায় আমাদের কোনও হাত নেই। সেটা পুরোপুরি ভাগ্যের উপরে। তবে আফসোস নেই একটুও। আমরা আমাদের কাজ করে এসেছি। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে এক আনবিলিভেবল ম্যাচ জিতে এসেছি!


সাকিব-রিয়াদের সেঞ্চুরির টেনশন, উইনিং শট দেওয়ার পর সৈকত-রিয়াদের উদযাপন, ক্যাপ্টেন মাশরাফির বাঁধভাঙা উল্লাস – এই সব মিলিয়ে খেলার শেষেপ নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে এসেছে। আর অস্ফুটে বার বার করে বলেছি,

এতো সুন্দর ক্রিকেট!
কী সুন্দর ক্রিকেট!