বুক রিভিউঃ দ্য বুক থিফ, সেরিওজা এবং দ্য পার্ল

বই, যা একইসাথে আদি বা পুরাতন, নব্য বা উদ্দীপন, কখনো আমাদের শেকড়ের সাথে আবদ্ধ করে নিবিড় আচ্ছাদনে, কখনো বা আত্মার সাথে আলঙ্কারিক মেলবন্ধন ঘটায়। একটি সুন্দর বই হতে পারে সারাজীবনের আরাধ্য সম্পদ। মানুষের রুপকল্পনাকে স্থান করে দিতে গিয়ে বইয়ের প্রাসঙ্গিক দিক থেকে এসেছে বহু পরিবর্তন। কেউ রহস্যময়, কেউবা অতিপ্রাকৃত, কেউ আবার ভিন্ন জগতের এলিয়েনসদৃশ কাহিনী পড়তে পছন্দ করেন। বিশ্বে তুমুল আলোড়ন জাগানো তিনটি কথাসাহিত্য নিয়ে আজকের আমাদের এই রিভিউ পর্ব।

 

 

দ্য বুক থিফঃ মারকাস জুজাক

দ্য বুক থিফ বইটির মূল কাহিনী আবর্তিত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মান নাগরিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট ঘিরে। বইয়ের প্রধান চরিত্র লিজেল মেমিঙার ও তার ছোট ভাইকে দত্তক দেয়ার জন্য তাদের মা দু ভাইবোনকে ফস্টার কেয়ার কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করার উদ্দেশ্যে নিয়ে যায়। কিন্তু পথিমধ্যে লিজেল এর ছোটভাই অভুক্ত ও প্রচণ্ড শীতে মারা পড়ে, মাত্র এগারো বছর বয়সী ছোট্ট লিজেল কে যা প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে যায়। ভাইয়ের শেষ স্মৃতি হিসেবে সে বেছে নেয় একটি বই, যা কবর খোড়ার সময় একজন খননকারীর হাত থেকে পড়ে গিয়ে ঘটনাক্রমে লিজেল এর কাছে চলে আসে। এভাবে ঘটে তার প্রথম বই চুরির ঘটনা। যদিও লিজেল তখন লিখতে পড়তে জানত না, তবে “দ্য গ্রেভডিগারস হ্যাণ্ডবুক” ছিল তার কাছে অমূল্য। লিজেলের পড়াশনার হাতেখড়ি হয় তার পালক পিতা হ্যানস হুবারম্যান এর কাছে, পরম যত্নে রাতের পর রাত জেগে তিনি লিজেলকে পড়তে শেখান। বেসমেন্ট এর দেয়ালে ডিকশনারি আঁকার মাধ্যমে লিজেল নিত্য নতুন শব্দের সাথে পরিচিত হতে থাকে। কালক্রমে বই এর প্রতি তার লোভ ও পড়ার প্রতি ভালোবাসা থেকে লিজেল আরো বেশ কয়েকবার বই চুরির কাজে লিপ্ত হয়। বইটির পটভূমিতে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন মেয়রপত্নী ইলসা যিনি কিনা তার বিশাল ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে লিজেলকে বই পড়বার সুযোগ করে দেন। আরো একটি বিশেষ ভূমিকা পালণ করে ম্যাক্স নামক এক ইহুদী যুবক, ইহুদী নিধন শুরু হলে লিজেল এর পালক পিতা হ্যানস তার মৃত বন্ধুর অনুরোধ রক্ষার্থে বন্ধুপুত্র ম্যাক্স কে তাদের বেসমেন্টে লুকিয়ে থাকার সুযোগ করে দেন। হিটলার, নাৎসি, কমিউনিজম এসব ধারণার সাথে লিজেলের পরিচিতি ঘটে। সে জানতে পারে জার্মান সৈ্ন্যরা তার পিতা মাতাকে কমিউনিস্ট দাবী করে ধরে নিয়ে গেছে। বই ও চারপাশের মানুষ লিজেলকে ভাবতে শেখায় একটি শব্দ কতটা ক্ষমতাবান হতে পারে, শব্দ একই সাথে কুৎসিত ও সুন্দর হতে পারে। দ্যা বুক থিফ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনকে মনুষত্ব ও চেতনাসম্পন্ন জার্মান দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবার সুযোগ করে দেয়। লিজেলের সার্বক্ষণিক সঙ্গী বন্ধু রুডি স্টাইনার এর চরিত্রটি পাঠকের মনে ভালবাসা জাগিয়ে দেয়। বইয়ের শেষ কয়েক পাতার কাহিনী অত্যন্ত মর্মান্তিক যা পাঠককে অশ্রুসিক্ত হতে বাধ্য করে। সমগ্র বইটির বিবরণী ঘটেছে মৃত্যুর নিজস্ব জবানীতে। কালোপযোগী ও যে কোন বয়সের পাঠকের জন্য দ্যা বুক থিফ অবশ্যই সুপারিশযোগ্য।

২।সেরিওজাঃ ভেরা পানোভা

“সেরিওজা” একটি মন ভোলানো কাহিনী যাতে চিত্রায়িত হয়েছে একজন পিতা ও তার পুত্রের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। সেরিওজা, অল্প বয়সে বাবাকে হারানো একটি ছেলে যে তার নিত্যনৈমত্তিক শৈশব জীবনের হাসি উল্লাস নিয়ে ব্যস্ত। মা, মাসি, নানা, নানী ও পাড়ার কতিপয় সমবয়সী বন্ধুদের নিয়ে তার পৃথিবী। এই ছোট্ট পৃথিবীতে হঠাৎ আগমন করে করোস্তলিওভ, সেরিওজার সৎ পিতা। করোস্তলিওভের আগমনে সেরিওজার জগত আরো সুন্দর হয়ে উঠে, পিতার অভাব পূর্ণ হয়। প্রতিদিনের নানান শিশুসুলভ এডভেঞ্চারের মধ্য দিয়ে বইটি এগোতে থাকে। মূলত পাঁচ বছরের একটি বাচ্চার দৃষ্টিতে আমাদের চেনা পৃথিবী কেমন দেখাতে পারে “সেরিওজা” তে এর রুপায়ন ঘটেছে। তবে করোস্তলিওভ ও সেরিওজার মায়ের সংসারে প্রথম সন্তানের জন্ম হলে ঘটনাপ্রবাহ আস্তে আস্তে মোড় নিতে থাকে। এক পর্যায়ে দেখা যায় নতুন জায়গায় চাকরির খোঁজে করোস্তলিওভ ও সেরিওজার মা তাদের সদ্য জন্মানো মেয়েকে নিয়ে সাইবেরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন। তবে সেরিওজার শারীরিক অবস্থা বিশেষ ভালো না হওয়ায় তারা ওকে সেখানেই রেখে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেরিওজার মনে তা গভীরভাবে রেখাপাত করে। নিজের মায়ের চাইতে বেশি সেরিওজা করোস্তলিওভের উপর ভরসা করে থাকে। শেষ পর্যন্ত গাড়ি ছেড়ে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে করোস্তলিওভ বুঝতে পারে সেরিওজার জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তার বাবা মায়ের সঙ্গে থাকা। সেরিওজাকে করোস্তলিওভ গাড়িতে তুলে নেয়।

বইটির রচয়িতা ভেরা পানোভা, একজন রাশিয়ান লেখিকা। গ্রেট পেট্রিওটিক যুদ্ধের সময় এমন অসংখ্য অনাথ নিগৃহিত শিশু তিনি লক্ষ্য করেছেন যার অভিজ্ঞতা থেকে সেরিওজা বইটি লিখা। চাইল্ড সাইকোলজির বই হিসেবে অবশ্য পাঠ্য এবং সাহিত্যিক রসবোধের দিক থেকেও বইটি গুরুত্ব বহন করে। নিঃসন্দেহে সেরিওজা পাঠককে আপন ছোটবেলার স্মৃতিময় চিলেকোঠা থেকে ঘুরিয়ে আনে।

৩।দ্য পার্লঃ জন স্টাইনবাখ

“দ্য পার্ল” বইটির প্রাক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন ধাঁচের। একজন দরিদ্র মুক্তো শিকারী কিনো, তার পরিবার ও পরিবারকে ঘিরে থাকা স্বপ্ন ও সমাজের লোভী শাসকশ্রেণীর চক্রান্তের কাহিনী দ্য পার্ল। একদা কিনো ও জুয়ানার একমাত্র সন্তান শিশুপুত্র কয়োটিটো এক বিষাক্ত বিছের দ্বারা দংশিত হয়। শোকে দিশেহারা হয়ে কিনো ও জুয়ানা কয়োটিটোকে টাউনের একমাত্র ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু সাদা চামড়ার লোভী ডাক্তার নেটিভ ইন্ডিয়ান্দের চিকিৎসায় অস্বীকৃতি জানায়, যদিনা কিনো তাকে মুল্যবান কিছু উপহার দিতে পারে। কিনো মুক্তো শিকারী, অসহায় হয়ে তাই সে তখন মুক্তোর খোঁজে সমুদ্রে নামে এবং তখনই অনেকটা দৈবিক ভাবে সামুদ্রিক ভেষজ এর সাহায্যে কয়োটিটোর জখম ভালো হতে থাকে। তবে কিনো এবার খুঁজে পায় পৃথিবীর সবচাইতে বড় ও সুন্দর মুক্তোটি ও এভাবেই তার জীবনের উত্থান পতনের সূচনা ঘটে। কিনো জানে এই মুক্তোটিকে বিক্রি করে সে তার পরিবারের অসহায়ত্ব দূর করতে পারবে। সে তিনটি স্বপ্ন দেখে, প্রথমটি হচ্ছে তার পরিবারের জন্য ভালো কাপড় ক্রয় করা। দ্বিতীয় স্বপ্নটি হচ্ছে গির্জায় বিধিসম্মত উপায়ে জুয়ানাকে বিয়ে করা, এবং তৃতীয় স্বপ্নটি হচ্ছে কয়োটিটোকে স্কুলে ভর্তি করানো যাতে সে লিখতে ও পড়তে জানে। কয়োটিটো শিক্ষিত হলে ধূর্ত মুক্তো ব্যবসায়ীরা আর অশিক্ষিত মুক্তো শিকারীদের ঠকাতে পারবে না। বাধ সাধে সমাজপতিরা, যথার্থ মূল্যের চাইতে অনেক কম দামে সকলেই কিনোর মুক্তোটি কিনে নিতে চায়। প্রাণ বাঁচাতে কিনো তার পরিবারকে নিয়ে পালিয়ে আসে। তবে সেখানেও লোক ধাওয়া করে তাদের। কিনো প্রত্যয়ী হয়ে যে কোন ভাবেই হোক মুক্তোটিকে সে ফেলে দিবে না, নিজের ভবিষ্যতের জন্য দেখা স্বপ্নগুলো সে পূরণ করেই ছাড়বে। পরিবারের সুরক্ষার চাইতে কিনো মুক্তোটিকে সুরক্ষিত করতে অধিক প্রাধান্য দেয়। কিনো ভুলে যায় তার আসল সম্পদ তার পরিবার, তার পুত্র। ধাওয়াকারীদের সাথে ধস্তাধস্তির এক পর্যা‍য়ে নিহত হয় কয়োটিটো। কিনোর সকল আশা ধুলোয় মিশে যায়।

দ্য পার্ল বইটি অনাকাঙ্খিত সম্পদ, পরিবার, লোভ, ও মানুষের স্বপ্নের পরিণতি গুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য দেখায়। পাঠকের জন্য একটি রোমাঞ্চকর এবং শিক্ষণীয় অনুভূতি এনে দেয় দ্যা পার্ল।