কালো বিড়াল …অশুভ প্রেতাত্মা.. ভৌতিক ঘটনা.. বিশ্বাস..অবিশ্বাস

black-cat-1.pngকালো বিড়াল দেখলেই অনেকের অস্বস্তি হয়।বাড়ির আশেপাশে কোথাও কোনো বিড়াল দেখলে মনে মনে কু ডাকে। তাকে বাড়ি ছাড়া না করা অবধি শান্তি পান না অনেকেই। আমাদের পড়া নানা রূপকথার গল্প, উপকথা যেকোন জায়গাতেই অশুভ আত্মা হিসেবে বা প্রেতাত্মা হিসেবে কালো বিড়ালের উপস্থিতি আমাদের চোখে পড়ে। কিন্তু আদতে এক নিরীহ প্রাণী কিভাবে অশুভ শক্তি হিসেবে সকলের কাছে পরিচিতি লাভ করলো ইতিহাসের পাতা থেকে আসুন জেনে নিই সেসব অজানা কাহিনী।

(১) ডাকিনী বিদ্যার প্রচলন এবং কালো বিড়াল শয়তানের অবতার

৩০০০  খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কথা। প্রাচীন মিশরে কালো বিড়াল ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রাণী। সেসময় মিশরে এমনও নিয়ম ছিল যে কোন বিড়ালকে হত্যা করা মৃত্যুদন্ডের শামিল। এর কয়েক সহস্রাব্দ পরে ইউরোপের কিছু মানুষের মনে এমন ধারণা জন্মালো যে, কালো বিড়াল সম্পর্কে একধরনের ভয় কাজ করতে শুরু করলো। অনেকের মনে  বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করলো যে, কালো বিড়াল হচ্ছে শয়তানের অবতার। মধ্যযুগের সেই সময়টায় ইউরোপে ডাকিনী বিদ্যার বেশ প্রসার ঘটে। ডাকিনী বিদ্যায় দীক্ষিত বয়স্ক মহিলাদের সঙ্গে সবসময় থাকতো কালো বিড়াল। ফলে কালো বিড়াল সম্পর্কে মানুষদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণার জন্ম নেয় এবং সকলের মনে এক ধরনের ভয় কাজ করতে থাকে।

(২)  ক্রিস্টানদের মধ্যে কালো বিড়াল সম্পর্কে অশুভ ধারণা:

এরপর ১২৩৩ খ্রিষ্টাব্দে,নবম পোপ গ্রেগরী একটি কালো বিড়ালকে কফিনে পুরে পেরেক ঠুকে কফিন টি নদীতে ফেলে দেন এবং ঘোষণা দেন, এই কালো বিড়াল হল শয়তানের একটি অবতার।পোপের প্রতি নিষ্ঠা প্রমান করতে উৎসুক খ্রিষ্টানরা কালো বিড়াল ধরার উৎসবে মেতে উঠে এবং গ্রাম্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ধরা পড়া সব কালো বিড়ালকে জীবিত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে মারে। তখন অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে, চতুর্দশ শতকের দিকে ইউরোপের বেশ কিছু অঞ্চলে কালো বিড়াল প্রায় বিলুপ্তই হয়ে গিয়েছিলো।

(৩)  ইংল্যান্ডের লিঙ্কনশায়ারের ঘটনা:

কেন পোড়ো বাড়িতে কালো বিড়াল থাকলে তাকে ভূত-প্রেতের আস্তানা বলা হয়? এর পিছনে একটি অদ্ভুত গল্প আছে। ইংল্যান্ডের লিঙ্কনশায়ারে ঘটে এই অদ্ভুত ঘটনাটি। একদিন অমাবস্যার রাতে এক ভদ্রলোক তার ছেলেকে নিয়ে হেঁটে বাসায় ফিরছিলেন।এমন সময় হঠাৎ একটি কালো বিড়াল তাদের সামনে দিয়ে রাস্তা পার হতে থাকে। ভদ্রলোকটি বিড়ালটিকে তাড়া করেন। তাড়া খেয়ে কালো বিড়ালটি পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। পরদিন ছেলেকে নিয়ে একই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় তারা জানতে পারেন আগের দিন বিড়ালটি যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল সে বাড়ির এক বৃদ্ধা মারা গেছেন। বাড়ির লোকজন  বৃদ্ধার মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ায় সময় তাদের কারো কারো  কথোপকোথন থেকে জানা যায় যে, তারা বৃদ্ধার মৃত্যুর জন্য বাড়িতে প্রবেশ করা সেই কালো বিড়ালকে দায়ী করছে। পরবর্তীতে এ ঘটনা অনেকের মনে রেখাপাত করে।ফলে সকলের মনে কালো বিড়ালকে নিয়ে একধরনের ভয় ভীষণভাবে প্রভাব বিস্তার করে।

(৪) কালো বিড়াল সম্পর্কে আইরশদের বিশ্বাস:

আইরিশদের বিশ্বাস, ভূত-প্রেত কালো বিড়ালের রূপ ধারণ করে এ পৃথিবীতে ঘোরাফেরা করে। পরবর্তীতে এই ধারণা পৃথিবীর অনেক জায়গায় ছড়িয়ে যায়। আইরিশরা মনে করতো যে, যদি চাঁদনি রাতে কোনো ব্যক্তির সামনে দিয়ে কালো বিড়াল হেঁটে যায় তবে মহামারীতে তার মৃত্যু অনিবার্য।

(৫) কালো বিড়াল সম্পর্কে স্পেনের অধিবাসীদের বিশ্বাস:

ষষ্ঠদশ শতকে স্পেনে কালো বিড়ালকে লোকে ডাইনি ও অশুভ আত্মা হিসাবে মানতে শুরু করে। ধীরে ধীরে স্পেনের মানুষের মধ্যে বিশ্বাস জন্মায়, সত্যিই হয়তো কালো বিড়ালের মধ্যে লুকনো অপয়া কোনও শক্তি আছে। স্পেনিশ জলদস্যুরা মনে করত, কালো বিড়াল তাদের দিকে হেঁটে আসাটা তাদের জন্য দুর্ভাগ্যের প্রতীক।

(৬) ফরাসীদের চোখে কালো বিড়াল:

ফরাসিদের কাছে কালো বিড়ালকে দেখা হয় খারাপ লক্ষণ হিসেবে।ডাইনী বা শয়তানের চর। তাদের বিশ্বাস, বিড়াল বহন করা কোনো গাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া অশুভ। আবার অনেক মানুষের বিড়ালের ঝড়ো গতিতে ঘরে প্রবেশ করাকে ঝড় আসার পূর্ব লক্ষণ বলে মনে করা হয়।

(৭)  জুয়াড়িদের বিশ্বাস কালো বিড়াল দুর্ভাগ্যের ইঙ্গিত

পৃথিবীর সকল জুয়াড়িদের কালো বিড়ালের প্রতি এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করে।  তারা বিশ্বাস করে যে, যদি বাড়ি থেকে বেরুবার সময় ক্যাসিনোতে বা আড্ডায় যাওয়ার রাস্তায় কালো বিড়াল দেখা যায় তবে আর ক্যাসিনোতে না গিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়াই উত্তম। আর তা না হলে বিশাল ক্ষতির সম্ভাবনা। বেশির ভাগ জুয়াড়িই মনে করে কালো বিড়াল মানে মন্দ ভাগ্য ।

(৮)  এশিয়া ও গ্রাম বাংলায় কালো বিড়াল সম্পর্কিত কুসংস্কার:

এশিয়াতেও কালো বিড়াল অশুভ বলে ধারণা করা হয়। বিশেষ করে বাঙালীদের কাছেও কালোবিড়াল নিয়ে রহস্যের শেষ নেই। আগেকার দিনে আমাদের গ্রাম দেশে যখন গরুতে গাড়ি টানা হতো, তখন কালো বিড়াল রাস্তা পার করলে গরুদের মধ্যে একটা অস্থির ভাব লক্ষণ করা যেত। সেই সময় গাড়োয়ান গরুদের শান্ত করতে কিছুক্ষণের জন্য গাড়ি থামিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন। পরে সেই রেওয়াজ কুসংস্কারে পরিণত হয়।

অনেক সময় গাড়ির সামনে দিয়ে বিড়াল, বিশেষত কালো বিড়াল চলে গেলে গাড়ি থামিয়ে দেওয়া হয়। অনেকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে আসেন। কেউ আবার গাড়ির কাচে ক্রস চিহ্ন আঁকেন।

আমাদের মুরব্বীদের মধ্যে এমন ধারণা প্রচলিত যে, কোন শুভ কাজে যাত্রা করার সময় যাত্রাপথে কালো বিড়ালের দেখা পেলে তা এক অশুভ ইঙ্গিত।ফলে অনেকে বাড়ি ফিরে যান। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার যাত্রা করেন। তাতে নাকি দোষ ‘কাটা’ যায়। অনেকে কালো বিড়ালকে অতিলৌকিক অস্তিত্বের প্রতিনিধি বলে মনে করেন।

(৯)  গল্প উপন্যাসে কালো বিড়ালকে অশুভ শক্তির প্রতীক হিসেব ব্যবহার:

১৫৬০ সালে  বিভিন্ন ইউরোপের বিভিন্ন লেখকদের উপন্যাস, রূপকথা, ভৌতিক গল্প ও উপকথায় কালো বিড়ালকে অশুভ শক্তির প্রতীক হিসাবে দেখানোর প্রচলন  শুরু হয়। পৃথিবীজুড়েই কালো বিড়ালকে নিয়ে তৈরি হয়েছে অসংখ্য গল্প-কাহিনি। এসব রূপকথার গল্প কাহিনীতে কালো বিড়াল মানুষের রূপ ধারণ করে ডাইনী, শয়তান বা দানবের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করে। বাংলা সাহিত্যে এর প্রচলন শুরু হয় আরো কিছু পরে। বিশেষ করে বাংলা ভৌতিক গল্পে কোলো বিড়াল ভূত প্রেতের আত্মা হিসেবে দেখানো শুরু হয়।

(১০) যারা মনে করেন কালো বিড়াল তাদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে:

অনেক দেশে ও সমাজে কালো বিড়ালকে এখনোও সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

  • স্কটিশরা বিশ্বাস করে যে, ঘরে কালো বিড়ালের আগমন উন্নতির প্রতীক। আরো বিশ্বাস করা হয় যে, যদি কোন মহিলার কালো বিড়াল থাকে, তবে তার অনেক শুভাকাঙ্খী থাকবে।
  • ইংল্যান্ডের মিডল্যান্ড অঞ্চলে বিয়ের উপহার হিসেবে কনেকে কালো বিড়াল উপহার দেয়া হতো। তারা মনে করতো যে, এটা কনের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবে।
  • ইংল্যান্ডের নাবিকরাও এক সময় ভালো আবহাওয়ার প্রত্যাশায় যাত্রা পথে কালো বিড়াল সঙ্গে রাখতো।
  • ইতালিয়ানদের কাছে কালো বিড়ালের নাক দ্বারা সৃষ্ট ঘরঘর শব্দ শোনা ছিল সৌভাগ্যের।
  • টিডলস রয়েল নেভির একটি বিখ্যাত জাহাজ আছে যেখানে কালো বিড়ালের অতি প্রাকৃতিক ক্ষমতাকে সৌভাগ্যের লক্ষণ হিসেবে দেখা হয়। তাই জাহাজে ‘জাহাজ বিড়াল’ রাখা হয়।
  • পশ্চিমা দেশের অনেক জেলের বউরা তাদের বাসায় কালো বিড়াল পোষে তাদের স্বামীর যাতে কোন অমঙ্গল না হয় সেজন্য।
  • কালো বিড়ালকে আঘাত করা বা তাকে মেরে ফেলাকে অশুভ হিসাবে গণ্য করত ইজিপ্সিয়ানরা। বিশ্বাস করত কালো বিড়ালের মধ্যে কিছু আধ্যাত্মিক শক্তি রয়েছে। তারা কালো বিড়ালকে পুজোও করত।

কালো বিড়াল সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, আসলে পুরো বিষয়টি একটা ভ্রান্ত ধারণার উপর গড়ে উঠেছে। বিড়ালের রং কালো হওয়ার সঙ্গে তার অশুভ হওয়ার কোনও সম্পর্কই নেই। সবটুকুই মূলত কুসংস্কার।তবু জানতে ইচ্ছে করে, এতো কিছুর পরও আমরা কি এখনোও কালো বিড়াল সম্পর্কিত অশুভ বিশ্বাস হতে মুক্ত হতে পেরেছি? নিজেকেই জিজ্ঞেস করুন।