রহস্য গল্পঃ বরফে রক্তের দাগ

ঘটনাটি ঘটেছিল আশির দশকের কোন এক সময়ে। অস্ট্রিয়ার নির্জন এক শহরে পাহাড়ের কোলে একটা কলোনিতে বাস করত এক সুখী দম্পতি। সংসার বলতে তারা কেবল দু’জনেই ছিল। তবে তারা দু’জনেই খুব সুখি ছিল। আর কলোনির চারপাশটাও ছিল ভীষণ সুন্দর। প্রতি বসন্তেই তারা বেশ ঘটা করে গোধূলিলগ্নে বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে আড্ডা দিত। পড়ন্ত সূর্যের সোনালী আভায় ক্যামেলিয়ার সোনালি চুল ঝিকমিক করে উঠতো। আর সেই সোনালি চুলের ভিতর আঙুল চালাতো জন। বর্ষার সময়ে তারা দু’জনেই ভিজতে ছাদে চলে যেত। আর শীতের সময় সামনের লনে তারা বড় বড় বরফের পুতুল বানিয়ে রাখত। আর তাদের পরস্পরের গায়ে বরফ ছুড়ে আনন্দ ফুর্তি করত।

তাদের বেশ ভালোই জীবনটা কেটে যাচ্ছিল। ও, ভালো কথা। তাদের পরিচয়ই তো জানানো হয়নি। জন ছিল ছোটখাটো একজন ব্যবসায়ী। বয়স এই ষাট কিংবা পঁয়ষট্টি হবে। চোখে মুখে বয়সের ছাপটা পড়লেও গায়ে গতরে এখনো বেশ যুবক। ক্যামেলিয়ার বয়সও চল্লিশের ঘরে। সে একটি দোকানে সেলসম্যানের কাজ করে। তাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় কুড়ি বছরের মতো। তবে এখনো কোনো ছেলেপুলে হয়নি। আর তার আশাও করে না তারা দুজন। বেশতো কেটে যাচ্ছে।

ঘটনাটি ঘটেছিল একটি শীতের সময়ে। বাসার সামনের লনে আর সিঁড়িতে প্রচুর বরফ পড়েছিল সেবার। ক্যামেলিয়া খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে জন কে বলে গেল,”হ্যা গো শুনছ, সিঁড়িতে প্রচুর বরফ পড়েছে। বের হওয়ার আগে অবশ্যই পরিষ্কার করে যেও।”
জন তখনও ঘুমাচ্ছিল। ঘুমের ঘোরেই বলল,”দেখি।”
“দেখি মানে? অবশ্যই যেন পরিষ্কার করে বের হওয়া চাই।”
“আচ্ছা। ঠিক আছে, ঠিক আছে। সকালের ঘুমে বিরক্ত কর না। যাও।”
“মনে থাকে যেন।” বলেই ক্যামেলিয়া বেরিয়ে পড়ল।

জনের সকালের ঘুমটা মাটি হয়ে গেল। মেজাজটা একটু খারাপই হল ওর। তাই একটু মনে মনে রাগ করেই ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল কাজে। বরফ পরিষ্কার আর করা হল না। সাহেবের মেজাজ মর্জি বলে কথা।

যাইহোক, দুপুরের দিকে জন যখন বাসায় ফিরলো, দরজার সামনে এসে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। একজন ডাকপিয়ন সিঁড়ির উপরে মরে পড়ে রয়েছে। এ তো মহা মুসিবত হল। কাছে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখল যে বেচারা সিঁড়ির উপরের জমা বরফে পা পিছলে পড়ে ঘাড়টা ভেঙে ফেলেছে। এ দৃশ্য দেখে জনের তো মাথা ঘোরার জোগাড়। একে তো ক্যামেলিয়া বলেছিল সকালে বরফ় পরিষ্কার করতে। কিন্তু তা সে করেনি। আবার এর উপরেই যে আরেক ব‍্যাটা মরে পড়ে থাকবে তা কে জানত। ক্যামেলিয়া যদি চলে আসে, তাহলে এই দৃশ্য দেখে খুব একটা খুশি হওয়ার কথা নয়। তার উপরে পুলিশের তো ভেজাল আছেই। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না জন। যাইহোক সাত পাঁচ না ভেবে আগে জন মৃত লোকটার দেহটা কোনরকমে টেনে ঘরের ভিতর সোফায় নিয়ে গেল।

কিন্তু এরপর কি করবে, বুঝতে পারছেনা জন। প্রথমে ভাবল, লাশটাকে টেনে নিয়ে কোন এক ব্রীজের উপর থেকে পানিতে ফেলে দেবে। তাহলে আর তার ঘাড়ে দোষ যাবে না। কিন্তু এতে তো ধরা পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। কারণ পিয়ন লোকটা কলোনির রাস্তা ধরে প্রত্যেক বাড়িতেই চিঠি বিলিয়ে এসেছে। এখন ওকে যদি এখান থেকেই গায়েব করে দেওয়া হয়, তাহলে তো আর পরের বাড়িগুলোতে আর চিঠি যাবে না। ফলে পুলিশ খুব সহজেই তার বাড়িতে সার্চ করতে আসবে। সুতরাং আগে যেটি করা উচিত, প্রত্যেক বাড়িতে চিঠিগুলো ঠিক সময়ে পৌঁছানো দরকার। এতে আর তাকে কেউ সন্দেহ করতে পারবে না, কিংবা তার বাড়িতেও হয়তো পুলিশ আসবে না।

জন বেশ ভয়ে ভয়েই ডাকপিওনের ডাক পিয়নের ইউনিফর্ম খুলে ফেলল। তারপর নিজেই ইউনিফর্মটি পড়ে পরবর্তী বাড়িগুলোতে চিঠি বিলি করতে চলে গেল। ঘরের ভিতরে পড়ে রইল ডাক পিয়নের নগ্ন মৃতদেহ।

বেশ খানিকটা ভয় নিয়েই প্রত্যেকবারই দরজায় নক করতে লাগলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে কেউ তাকে সন্দেহ করলো না। আসলে চিঠি দিতে যেই আসুক না কেন, কেউ তো তার চেহারা খেয়াল করেনা। সুতরাং, খুব সহজেই সে চিঠিগুলো বিলি করে দিয়ে আসতে পারলো। চিঠির বিলি শেষ করে সে মনের আনন্দে বাড়ির পথ ধরল। যাক বাবা, ভালই ভালই একটা ঝামেলা পার হয়ে গেল।

বাড়িতে পৌঁছে তো আরেক বিপত্তি। ঘরের চাবি তো রয়ে গেছে আগের প্যান্টের পকেটে। পিয়নের ইউনিফর্মে তো চাবিটা নিতে মনে নেই। দরজা তো লক হয়ে আছে। এবার কি হবে? বাড়ির চারিদিকে বেশ কিছুটা সময় ঘোরাফেরা করে জন আবিষ্কার করল, রান্নাঘরের উপরে ছোট্ট একটা জানালা খোলা। ‘যাক বাবা কিছু তো একটা পাওয়া গেল।’, মনে মনে ভাবল জন। সেই ছোট্ট জানালা দিয়েই ঘরের ভিতরে ঢুকতে চেষ্টা করল জন। কিন্তু কথায় আছে, যেখানে ভুতের ভয়, সেখানেই রাত্রি হয়। ঠিক সেই সময়ই রাস্তা দিয়ে রুটিন ডিউটিতে যাচ্ছিল একটা পুলিশের টহল গাড়ি। গাড়ীর ভেতর থেকে পুলিশ দেখল, ডাক পিয়নের ইউনিফর্ম পরা একটি লোক বাড়ির ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। আর কোথায় যাবে, খপ করে গিয়ে কলারটা চেপে ধরল জনের।

পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসা করল, “কি ব্যাপার? চিঠি কি আজকাল রান্নাঘর দিয়ে দেওয়া হচ্ছে?”
জনের তো কপাল দিয়ে ঘাম ছুটে গেল। কিন্তু কোনো ব্যাখ্যা তাঁর মুখে আসলো না। কেননা সে যদি নিজেকে বাড়ির মালিক দাবি করে, তাহলে তারা ঘরের ভিতরে ঢুকতে চাইবে। কিন্তু ঘরে তো একটি লাশ পড়ে রয়েছে। আবার তার গায়ে ডাক পিয়নের ইউনিফর্ম। সুতরাং পুলিশ এটি বিশ্বাসও করবে না যে একজন ডাক পিয়নের সামান্য বেতনে এত বড় বাড়ির মালিক হতে পারে। কিন্তু, ডাক পিয়নের পোশাকে সে বাড়ির রান্না ঘর দিয়ে ঢুকতে চেষ্টা কেন করেছিল তারও তো কোনো ব্যাখ্যা হয় না। কোন কিছু না ভেবে পেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো জন। তারপর বিনা বাধায় পুলিশের গাড়িতে চড়ে বসলো। পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে গেল। সেখানে ডাক পিয়ন সমিতির একজন আইনজীবী এসে তাকে জামিনে ছাড়িয়ে নিয়ে গেল। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হলো একজন সরকারি চাকুরিজীবীর কাছ থেকে তারা এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা আশা করেনি। এবং তাকে এও জানিয়ে দেয়া হলো, আগামী সপ্তাহে় তাকে কোর্টে হাজির হতে হবে। এসব কার্যক্রম শেষ হতে প্রায় ঘন্টা চারেক চলে গেল।

পুলিশ জনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরপরই ক্যামেলিয়া বাড়ি ফিরে এলো। দরোজা খুলে ক্যামেলিয়া একজন লোককে নগ্ন অবস্থায় সোফায় শুয়ে থাকতে দেখল। ক্যামেলিয়া এক দেখাতেই লোকটি কে চিনে ফেলল। সে ছিল হোভার, ক্যামেলিয়ার এককালের পরকীয়া প্রেমিক। ডাক পিয়ন হওয়ায় সে প্রায়ই এই বাড়িতে এসে আসতো, যখন ক্যামেলিয়া থাকত সম্পূর্ণ একা। এভাবেই তাদের সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটেছিল। এই মাস ছয়েক হলো তাদের পরকীয়া প্রেমের ব্রেকআপ হয়েছে। ক্যামেলিয়া ভাবল, হয়তো ওর সাথে দেখা করতেই রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাড়িতে ঢুকেছে। এভাবে সে আগেও ঢুকেছে অনেকবার। আর বাড়িতে তাকে না পেয়ে ওকে চমকে দেয়ার জন্য নগ্ন অবস্থায় সোফায় শুয়ে আছে। ক্যামেলিয়ার আজকে আসতে একটু দেরি হয়েছিল বটে, তাই হয়তো শুয়ে থাকতে থাকতে বেচারা ঘুমিয়ে গেছে। ক্যামেলিয়াও তার ঘুম না ভাঙ্গিয়ে বেশ চুপি চুপিই নিজে একটু সাজুগুজু করে নিল। তারপর সে হোভারের কাছে গেল। কিন্তু একি, ও তো মরে পড়ে আছে। পরিক্ষা করে দেখল ঘাড় ভাঙা। এ নিশ্চিত জনের কাজ। হয়তো জন আজকে আগে আগেই চলে এসেছিল। আর ওকে সোফায় নগ্ন অবস্থায় দেখতে পেয়ে মেরে ধরে ঘাড় ভেঙে দিয়েছে। এ কথা ভাবতেই ক্যামেলিয়া বেশ ভড়কে গেল। পাশেই পড়ে থাকা জামা কাপড় গুলো কোন রকমে হোভারের গায়ে জড়িয়ে ওকে টেনে গাড়ির ভিতর তুলল। তারপর ক্যামেলিয়া ওর বাড়ির দিকে ছুটল। যেহেতু ওদের সম্পর্কটা বেশ অনেক দিনেরই ছিল, ও কোথায় থাকতো ক্যামেলিয়া তা জানত। ওর বাড়িতে গিয়ে চুপিসারে ক্যামেলিয়া হোভারকে তার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আবার গাড়িতে চেপে বসলো। জনকে ক্যামেলিয়া বাড়িতে দেখেনি। মনের ভিতর একটা ভয় চেপে গেল। জন কি ওকে মারার জন্য তাহলে পিস্তল কিনতে গেছে? অসম্ভব কিছু নয়। ক্যামেলিয়া জানের ভয়ে সেই শহর ছেড়ে দূরে অন্য আরেকটি শহরে নাম বদলে বসবাস করতে চলে গেল।

জামিন পেয়ে জন বাড়ি ফিরে এল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় মৃতদেহটা সেখানে ছিল না। ওটা কোথায় গেল বুঝতে পারলো না জন। অগ‍্যতা দিশেহারা হয়ে, ডাক পিয়নের পোশাকটা পুড়িয়ে ফেলল।

নির্ধারিত সময়ে যথারীতি আদালতে এলো না ঐ ডাক পিয়ন। পুলিশ তল্লাশি চালানো সেই ডাক পিয়নের বাসায়। সেখানে গিয়ে পুলিশ ডাক পিয়নের মৃতদেহ উদ্ধার করল। ঘাড় ভেঙে মরে গেছে লোকটা। পুলিশ সন্দেহ করলে হয়তো ঘুমের ভেতরেই লোকটার ঘাড় ভেঙে গেছে। আর যেহেতু সে অনেক আগেই মারা গেছে, তার চেহারাতেও বেশ পচন ধরেছে। তাই তারা জনের চেহারা থেকে তার চেহারা আলাদা করতে পারল না। আসলে চেষ্টাই করলো না। অবশেষে পুলিশ তাকে মৃত ঘোষণা করে কেসটি ক্লোজ করে দিল। জনও বেঁচে গেল।

কিন্তু ক্যামেলিয়া কোথায়? দোকানে ফোন করল জন। ক্যামেলিয়া অনেক আগেই সেখান থেকে বেরিয়েছে কিন্তু বাড়ি ফেরেনি। এদিকে পুলিশকে আর নিজের চেহারা দেখাতে চাইলো না জন। তাই তাকে খোঁজার জন্য পুলিশের দ্বারস্থ হবার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল। তারপরে তাকে নিজস্ব উপায়ে খুঁজে না পেয়ে অবশেষে একাএকাই শহর ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিল জন।
(একটি বিদেশি গল্প অবলম্বনে)