বুক রিভিউ- ইয়াস্তেন গার্ডারের সোফির জগৎ

নরওয়েজিয়ান সাহিত্য ।

বই –সোফির জগত

লেখক –ইয়াস্তেন গার্ডার।

অনুবাদক – জি এইচ হাবীব।

Genre

কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করে এই যে এই বইটা আসলে কিসের ভিতরে পড়ে? সত্যি বলতে কি উত্তর দেওয়াটা খুবই কঠিন হয়ে যাবে। এইটা আসলে একের ভিতরে হরেক টাইপ বই। নন ফিকশন ক্যাটাগরিতেও যেমন ফেলে দেওয়া যায় তেমন ফিকশনেও ফেলা যায়। কাঠখোট্টা দর্শনেও যেমন পড়ে যায় তেমনই ভালবাসার গল্প ও বলে ফেলা যায়। তবে এই টুকু গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি আর যাই হোক না কেন বইটা ইনট্রোডাকটরি টূ ফিলোসফি ১০১ টাইপ কিছু না !!।

রিকোমেন্ডেড

বই পড়ার টেস্ট বাড সবার সমান না কিন্তু বইটা বিশেষ ভবে লেখা হয়েছে টিনেজদের জন্য।কিন্তু বইটা সবার অন্তত একবার পড়া উচিত, দর্শনের মত নিরস জিনিসে একটু হলেও সরস ভাবে জানার জন্য।

অনেক তো বক বক করলাম এবার আসুন দেখে আসি বইটা আসলে কি নিয়ে।

প্রিভিউ

সোফি ১৪ বছর বয়সের এক বালিকা। আর সব টিনেজের মতই তার নির্ঝঞ্জাট, নিরুপদ্রব জীবন। স্কুল মেয়ে বন্ধুদের সাথে ঘোরাঘুরি আর ব্যাডমিন্টন। একেবার সাধাসিধে একটা জীবন। সোফির এই চেনা পরিচিত জগত এ ধাক্কা লাগে যখন সে একটা চিঠি পায়। চিঠিতে মাত্র একটা লাইন- “তুমি কে”? আপনি আমি হলে কি হতো জানি না কিন্তু সোফির মনে ধাক্কা দেবার জনয এই একটা প্রশ্নই অনেক কিছু। আসলেই তো সে কে? শুধু “সোফি” এই সামান্য উত্তরটা কি সন্তুষ্ট করার মত? অবশ্যই না। এর পরেই সোফির কাছে আসে ২য় চিঠি –“তুমি কোথা থেকে এসেছো”

এখন সোফির কাছে দুইটা অসাধারন প্রশ্ন যেটার উত্তর মানুষ হাজার বছর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছে । আসলেই তো আমরা কে? আমরা কোথা থেকে আসলাম? কি প্রয়োজন আমাদের?

এই অসাধারণ প্রশ্নের উত্তরে জানার জন্য সোফির সাথে পরিচয় ঘটে চিঠিদাতা এলবার্ট নক্সের। শিক্ষকের ভূমিকায় থাকা নক্স সোফির চেনা পরিচিত জগত এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন দর্শনের এক অসাধারন জগতকে। সোফি অবাক হয়ে দেখে এই সামান্য প্রশ্ন ২টা আজকের না  হাজার বছরের সক্রেটিস থেকে শুরু করে হাল আমলে সার্ত্রে সবাই ২টা প্রশ্ন খুঁজে বেড়িয়েছেন, তাদের প্রজ্ঞা আর বিচক্ষণতা দিয়ে সোফিকে মুগ্ধ করছে সেই সাথে পাঠকেও!।

বইয়ের এই অংশটুকু নন ফিকশন, দর্শন কিংবা হাজার বছরের দর্শনের ইতিহাস বলতে পারেন। এইখানে মেল বন্ধন ঘটেছে ফিকশনের। যে অংশে আছে হিল্ডা ন্যাগ আর তার বাবার ভিতরের রহস্য খুঁজে বের করার এডভেঞ্চার।

পাঠ প্রতিক্রিয়া

বইটার সবচেয়ে বড় ক্রেডিট কি? ফিলোসোফি জিনিসটাকে ৫০০ পেজের ভিতরে তুলে আনা। তার চেয়েও বড় ক্রেডিট হল দর্শনের মত অতি নিরস জিনিসকে টিনেজদের উপযোগী করে পরিবেশন করা!!

প্রাচীন গ্রিসে এক সাধাসিধে মানুষ বাস করত, কুৎসিত কিন্তু মেধায় অনন্য। তিনি কোন থিওরি দেন নি,কোন জ্ঞানগর্ভ কথাও বলে যান নি। কিন্তু তাকে সেই সময়ের ধর্মগুরুরা যমের মত ভয় পেত। কারণ কিছু না করেই শুধু বসে বসে প্রশ্ন করে তিনি সবাইকে প্যাঁচে ফেলে দিতেন । এক নামে তাকে সবাই চিনত গ্যাডফ্লাই অফ এথেন্স নামে। তার সাধাসিধে প্রশ্নের উত্তর দেবার ক্ষমতা কারো ছিল না। আর এই সধাসিধে প্রশ্নের জন্য তাকে হেমলক নামের বিষ দিয়ে, প্রহসনের বিচারে মেরে ফেলা হয়। জ্বি! আমি সক্রেটিসের কথাই বলছি।

এই বইটা ভাল লাগার আরেকটা কারণ হলো বইটা প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে গেছে, যেমনটা করতেন সক্রেটিস।

বইটার অন্য আরেকটা ভাল দিক হল এইটার প্লট। একজন ভাল শিক্ষক আর ছাত্রদের মনযোগ ধরে রাখতে পারেন , যেটা এই বইটার জন্য খুবই দরকার ছিল। লেখকের বলার ধরন এত সুন্দর যে আপনি বইটা ছেড়ে সহজে উঠতে পারবেন না।

এইবার আসুন বলি কি কি ভাল লাগে নি!

আগেই বলেছি বইটার ২টা অংশ। একটা হলো দর্শনের জগত আরেকটা ফিকশনের জগত। পড়ার পর মনে হবে ফিকশনের জগতটা না থাকলেই ভাল হতো। যদিও লেখক ২টা অংশের ভিতরেই মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন তাও শুধুমাত্র দর্শনের বই হলেই বেশি মানাতো।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হল এইটা দর্শনের জন্য স্বয়ং সম্পূর্ণ না। বইটার সবচেয়ে বড় ত্রুটি বোধহয় এইটাই যে বইটা শুধুমাত্র ওয়ের্স্টার্ন ফিলোসোফি নিয়ে। ইস্টার্ন ফিলোসোফি মোটামুটি ভালভাবেই উপেক্ষিত হয়েছে। শুধুমাত্র ফিকশন অংশটুকু বাদ দিয়ে এই জিনিসটা ঢোকালে বইটাকে চোখ বন্ধ করে পুরোপুরি সেরা বলা যেত!!

তিন নাম্বার সমস্যাটা সেই ফিকশন অংশ  নিয়ে যেখানে সোফি হিল্ডা ন্যাগের রসহ্য উদ্ধার করতে নামে। ইয়েস্তান খুব একটা ভাল মিস্ট্রি লেখক না। সাসপেনশন তৈরি করতে চাইলেও তেমন একটা ভাল হয় নি, উল্টো শেষ দিকে কিছুটা জগা খিচুড়ি টাইপই হয়ে গিয়েছে।

অল্প বিস্তর সমস্যা বাদ দিলে বইটা একেবারে সেরা একটা বই দর্শন জানার জন্য। নিজের টেস্ট বাডের উপর ভরসা রেখে যদি বইটা শুরু করতে পারেন রেখে দেওয়া সত্যি মুশকিল হবে। এই বই পড়াটা বিশাল এক প্রান্তরে বসে আকাশ দেখার মত যেটার স্বাদ ইট পাথরের জঞ্জালে ভরা শহরে বসে পাবেন না। বই বইটার পুরোপুরি স্বাদ নিতে চাইলে সেভাবেই মন খোলা রেখে পড়ুন!!বইটা পড়ার সময় একবার ও যদি মনে আসে দূর এই সব কথা শুনে আমার কি হবে তাহলে কিন্তু বইটার আসল স্বাদ একেবারেই পাবেন না।

এবার আসি অনুবাদ প্রসংগে

আমাদের দেশে এখন ও অনুবাদের মান ততটা সেরা না। সবাই অনুবাদ করে কিন্তু সেগুলো হয় নিম্নমানের কিংবা মাঝারি মানের। তাছাড়া অনুবাদে কখন ও আসল বইয়ের স্বাদ পাওয়া যায় না। ইংলিশ বই ছাড়া অন্য ভাষার অনুবাদ ত আরো জটিল কারন তখন একটা বই ২বার অনুবাদ হয়। এই বইটা যিনি অনুবাদ করেছেন (জি.এম।।হাবিব) তিনি এক কথায় সেরা। আমি গত অনেক বছরের ভিতরে এত ভাল অনুবাদ পড়ি নি। তাই ইংলিশ পড়ার থেকে এই বইয়ের অনুবাদ পড়াটা বেশি ভাল হবে। নরও্যেজিয়ান ভাষা থেকে ইংলিশে যেটা অনুবাদ হয়েছে তার থেকে জি.এম.হাবিব এর করা বাংলা ভাষার অনুবাদ কমপক্ষে ১০ ডিগ্রি মান সম্মত।

রেটিং- ৯/১০

লেখিকা সম্পর্কেঃ নু-জাহাত-জাবিন। অনেক ভাষায় নামের অনেক অর্থ আছে বাপ মার ভাল লাগছে তাই জোড়াতালি দিয়ে নাম বানায় ফেলছে। এই জীবনে বই পড়া ছাড়া কিছু করতে পারি নাই অদূর ভবিষ্যৎ এও করে ফেলব তার কোন চান্স নাই। শুধু মাত্র নাক মুখ গুঁজে বই পড়তে পারি। অবশ্যই সেই বই যেটার উপরে কোন এক্সাম দেওয়া লাগবে না। কোন বই বেশি ভাল লাগলে আশেপাশের মানুষজনকে জোর জবরদস্তি করে সেটা পড়তে বাধ্য করতে পারা ছাড়া আর কোন ক্ষতিকারক দিক নাই।