“চুপকথা” – এক মায়ের গল্প

আলেয়ার একমাত্র আদরের সন্তান আলাল। আলালের ঘরেও দুটি ফুটফুটে পুত্র সন্তান। সুন্দর ছিমছাম পরিপাটি সুখের সংসার ওদের। আলালের দুটি অটো রিকশা আর শহরে আছে বড় একটি মুদি দোকান। যার একাই মালিক আলাল। দূর থেকে দেখেই তৃপ্ত হন বৃদ্ধা আলেয়া। পর্দাহীন জানালায় উঁকি দিয়ে আলালের আসা যাওয়া দেখেন। অনাকাঙ্খিত সামনে যাওয়ার দুঃসাহস করেন না কখনও। ওরা বিরক্ত হয়!

বার্ধ্যক্যে শ্বেত শুভ্র মস্তক অমসৃন কুঁচকানো চামড়ার ভাঁজ ! মাথা উঁচু করে সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। এমনিতেই দু’কদম লাঠি ভর করে চলতে হয় তাঁকে।
নিজ থেকেই অকর্মা অকেজো নিজেকে কখনও ওদের ঘাড়ে বর্তায় না আলেয়া.. কারণ ওরা চায় না!

বয়সের ভারে কত রোগ শরীরে বাসা বাঁধে! যখন দাঁড়াবার একবিন্দুও শক্তি থাকেনা, তখন মেঝেতে একটি শীতল পাটি আর একটি কাঁথা বিছিয়ে নিস্তেজ পরে থাকেন। নাতীদের কাছে ছেলেবউ দু’বেলা বাসি ভাত আর বাসি তরকারী পাঠিয়ে দেয় ওদের নিজেদের খাওয়া শেষে। কারণ অসুস্থ শরীর বয়ে নিজের খাওয়ার খরচ যোগাতে বাইরে যেতে পারেনা আলেয়া। যা দেয় তাই কোনরকম খেয়ে শুয়ে থাকে আর বাহিরে একদৃষ্টিতে আলালের বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করতে থাকেন, আলালকে একনজর দূর থেকে দেখবেন বলে। মাঝে মাঝে নাতিরা খেলতে খেলতে আসে এঘরে, একবার দুবার দাদী বলে ডাকে। এতেই তিনি সন্তুষ্ট, কোন অভিযোগ নেই আলেয়ার।

কোনরকম একটু সুস্থ থাকলেই, সবাই যখন ঘুমের ঘোরে থাকে তখন ফজরের নামাজ শেষে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়েন আলেয়া। এক হাতে লাঠি
অন্য হাতে ভিক্ষার ঝোলা নিয়ে! গঞ্জে যেখানে কেউ চেনেনা আলালকে, সেখানে একটি গাছের ছায়ায় আলেয়া বসে থাকেন আর স্মৃতিচারণ করে কাঁদেন। তাঁর অসহায়ত্ব দেখে না চাইতেই অনেকে কিছু চাল দেয়, কিছু টাকা দেয়। অসহায় বৃদ্ধা আলেয়া তাই গ্রহন করেন তাদের এই দান।

বেলা শেষে এক পাঁ দু পাঁ করে পরিশ্রান্ত শরীরে আলেয়া বাড়ি ফিরলেই, ছেলেবউ ভ্রু কুঁচকে দম্ভ করে প্রশ্ন করে বসে, “সারাদিন কি হুদাই ঘুরলেন? চক্ষু লজ্জাও তো থাকে মাইনষের! খালি হাতেই বুঝি ফিরলেন?”

তখন স্বগর্বে, ফোঁকলা দাঁতে তৃপ্তির একটি শুকনো হাসি হেসে তিনি নাতিদের হাতে কিছু চকলেট পুরে দেন, আর ভিক্ষার ঝোলা ছেলেবউয়ের হাতে তুলে দিয়ে বলেন,”বউমা খুব ক্ষুধা পাইছে, মাছ ভাত দিও খাইতে!” তার আদরের সন্তান আলাল তখনও নির্বাক, নিজের ঘরেই শুয়ে থাকে।

চলতে থাকে এভাবে দিন।

আলাল মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হলে মা বলে একবার ডাকতো নয়তো ডাকতো না ! মনের ভুলে অথবা মন চাইলে মায়ের জানালায় মায়ের তাঁকিয়ে থাকা দেখে হাত নাড়তো ! কিন্তু কখনও মায়ের কুড়ে ঘরে যেত না বউ অশান্তি করবে ভেবে। কিন্তু একদিন খুব অস্থিরতায় সারারাত আলাল ঘুমোতে পারেনি। সকালে দোকানে যাওয়ার সময় আলাল খুব অস্থির হয়ে মায়ের জানালায় বারবার উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু মায়ের জানালা, দরজা বন্ধ দেখে ভাবলো হয়তো ভোরেই বেরিয়ে গেছে মা।

মন সায় না দিলেও আলাল চলে গেলো। সারাটা বেলা অকারণেই আলালের বুক ফাঁটা কান্না পাচ্ছে ! নিজেকে খুব অসহায় বোধ করছে আলাল। কেমন যেন খাঁ খাঁ লাগছে বুকের ভেতরটা ওর। মরিয়া হয়ে হয়ে উঠল বাড়ি ফেরার জন্য। ভাবলো, আজ দুপুরে মায়ের সাথেই খাবে সে! কতদিন মায়ের সাথে ভাগাভাগি করে খায় না।

দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরেই সোজা মায়ের ঘরে গেলো কিন্তু মায়ের ঘর ভেতর থেকে বন্ধ। কেমন যেন ছটফট করছে মন! কতবার আজ মা মা করে ডাকছে, কিন্তু দরজা খুলছে না, জবাবও দিচ্ছে না মা।

একটু জোরে আঘাত করতেই দুর্বল দরজা ভেঙে গেলো। অবাক হয়ে দেখলো মা নিষ্পাপ শিশুর মত ঘুমিয়ে আছে ! বুকে একখানা সাদাকালো ছবি জড়িয়ে আছে। আস্তে করে ছবিখানা হাতে তুলে দেখলো, ছবিতে বাবা, মা আর মাঝে ছোট্ট আলাল। ছবিটা দেখেই চোখের জল টপটপ করে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল ! অস্থির হয়ে মাকে ছুঁয়ে ডাকলো আলাল …কিন্তু নিথর আর নির্বাক হয়ে গেল সে! অপলক বোবা হয়ে মায়ের দিকে তাঁকিয়ে দেখছে মায়ের মুখ, আজ কোন ভাষা নেই আলালের মুখে। মায়ের ঘুমন্ত মিষ্টি মুখখানি দেখছে, কতদিন পর দেখছে মনে নেই আলালের! কিন্তু এতদিন পরে কেন দেখলো ?

মা আজ না বলেই দুঃখের সাগরে আলালকে ভাসিয়ে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন.. বাবার কাছে !

আলাল পাঁজর ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়লো না ঠিকই ! কিন্তু অবুঝ এতিম ছোট্ট শিশুর মত ধুকরে কেঁদে উঠল মায়ের পাশে মাকে জড়িয়ে শুয়ে …!

সেই ছোট্টবেলায় আলালের যখন আট বছর বয়স তখন আলালের বাবা রোড এক্সিডেন্টে মারা যান। তিনি একজন ডাকপিয়ন ছিলেন ! বাবা মারা যাবার পরে এই মা তাঁকে অনেক কষ্টে মানুষ করেছেন। স্বামীর ভিটা ছেড়ে কোনদিন যাননি। কত অভাব কত দুঃখে মা পরম যত্নে আলালকে মানুষ করেছেন..। রোদের তাপ লাগতে দেননি, মাটির ঠান্ডায় রাখেননি বুকে ঠান্ডা জমবে ! তুলতুলে আদরে মায়ের পাখনার নীচে ছায়া দিয়ে বড় করেছেন। রাত জেগে সেলাই কড়াই করে দু পয়সা রোজগার করতেন। নিজে না খেয়েও আলালকে খাইয়েছেন !

হায় !
আজ সেই মা চড়া মূল্য দিয়ে গেলেন মা হওয়ার অপরাধে,
চরম অভিমানে চুপ কথায় বলে গেলেন,
“আমার ঘাট হয়েছে,
আর মায়ের জাত হয়ে জন্ম নেব না পাষাণ দুনিয়াতে…!”