জানুন সময় পরিমাপক ঘড়ি নিয়ে ০৯টি তথ্য

watchঘড়ি এমন একটি অলঙ্কার যা প্রতিদিন, প্রত্যেকটা মানুষের হাতের তথা কবজি তথা বাহ্যিক অবয়বকে অন্য রকম শোভা দান করে। এটি একদিকে যেমন স্টাইলিশ অন্য দিকে আড়ম্বরপূর্ণ। তেমনি প্রায় সকল ধরণের পোশাকী সাজসজ্জার সাথে মানিয়ে যায়। ফ্যাশনের জগতে এটিকে সর্ব্ব্যাপী বিবেচনা করা হয়।

মজার বিষয়, ঘড়ি দোকানে গেলে দেখা যায় সারি সারি সুন্দর করে সাজানো ঘড়ি গুলোতে “ten minutes past ten o’clock অথবা ” ten minutes to two o’clock” সেট করা থাকে। এটাকে হ্যাপী টাইম মনে করা হয়। ধারনাটা এমন, এই সময়ের উপর চোখ পড়লে তা ব্যক্তির মুড পরিবর্তন হতে সাহায্য করে অর্থাৎ হ্যাপী মুড বানায়। যা ঘড়ি ক্রয় করার মানসিকতা তৈরী করে থাকে।

এই লিখায় আমরা জানবো ইতিহাসে অনুসন্ধান করে বের করে আনা এটির সম্পর্কে মজার কিছু তথ্য যা আমাদের হয়তো অজানা।

০১) গোড়ার কথন

মানুষের সময় বলতে পারার গোড়ার দিকের উদাহরণ প্রাচীন মিশরে পাওয়া যেতে পারে। সেই সময়ের সময় পরিমাপের সাথে বর্তমানের ষাট মিনিট ভিত্তিক সিষ্টেম সম্পর্কযুক্ত। মিশরীয়রা দিনকে ১২ ঘণ্টার দুটি চক্রে বিভক্ত করতো । দিনের সময়ের জন্য সূর্যঘড়ি আর রাতের সময়ের জন্য জল-ঘড়ি ব্যবহার করতো। বিস্ময়কর ভাবে সত্য যে “সূর্যঘড়ি” পদ্বতির সাহায্যে সঠিক সময় জানা যায়। এই পদ্বতিতে দিনের বিভিন্ন সময় সূর্যঘড়ির উপর পতিত ছায়া পথ অনুসরণ করে সময়টা উদ্বার করা হয়। তারপর প্রাচীন গ্রীকরা বালু ঘড়ির ব্যবহার শুরু করে। যেখানে বালি এক পাত্র থেকে অন্য পাত্রে অতিক্রমের মাধ্যমে সময় পরিমাপ করা হয়। ধীরে ধীরে প্রত্যেক সংস্কৃতিতে বা ভৌগলিক পর্যায়ে বিভিন্ন সিস্টেম ও ডিভাইস উদ্ভাবন শুরু হয় সময় পরিমাপের জন্য।

০২) পকেট ঘড়ি

পনের শতকে পকেট ঘড়ির পরিচিতি শুরু হলেও জনপ্রিয় হয়েছিল টিউডর সময়ে, বিশেষ করে রাজা অষ্টম হেনরির রাজত্বকালে, যিনি ইংরেজ ইতিহাসে জনপ্রিয় রাজা এবং টিউডর রাজবংশের দ্বিতীয় সম্রাট। ছয়জন স্ত্রী থাকায় বিশেষ পরিচিতিও ছিল। সেই সময়ের ঘড়ি ছিল অনেক বড় এবং পরণে কষ্টকর ছিল বলে মানুষ প্রায় গলায় পড়তো।

০৩) হাত ঘড়ি

প্যাটেক ফিলিপ নামে একজন ব্যক্তি প্রথম হাতে পরার ঘড়ি আবিষ্কার করে ১৮৬৮ সালে। তার “Platinum Perpetual Calendar Wristwatch’ নামের এই ঘড়ি ২০০৮ সালে মে মাসে ৩.১ মিলিয়ন ডলার বিক্রি হয়। ২০১০ পুনরায় আরেকবার নিলামে তার তৈরী নকশার ঘড়ি সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ৫.৭ মিলিয়ন ডলার।

আধুনিক হাত ঘড়ি যেমন পুরুষদের জন্য তৈরী সিনোলা ঘড়ি , যা এখন সহজপ্রাপ্য , সেগুলো প্রথম বিশ্ব যুদ্বের সময় পর্যন্ত জনপ্রিয় ছিল না। এর আগে এটি নেহায়েত মেয়েলি অলংকারের একটি টুকরা বিবেচনা করা হতো। ইতিহাসে প্রথমবারের মত, সৈনিকরা গলার পরিবর্তে হাতে ঘড়ি পড়া শুরু করেছিল। এই পরিবর্তনের ভেতরের দিয়ে এটি এখন পুরুষের হাতের শোভা বর্ধন করে যাচ্ছে।

০৪) ডিজিটাল ঘড়ি

ঘড়ির ডিজিটাল রুপ তৈরীর স্বীকৃতি দেওয়া হয় ডিমিট্রফ পেট্রোফ নামক ব্যক্তিকে। যিনি নাসাতে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

০৫) কোয়ার্টজ ঘড়ি

কোয়ার্টজ ঘড়ি ইলেকট্রনিক্যালি কাজ করে। যা মেকানিক্যাল ঘড়ির বিপরীত। ১৯৫০ সালের গোড়ার দিকে আমেরিকান এল্গিন ওয়াচ এবং লিপ অফ ফ্রান্স কোয়ার্টজ ঘড়ি তৈরী করার যৌথ উদ্যোগ নেয়। যদিও তারা শুধুমাত্র ব্যাটারী চালিত একটি নমুনা ঘড়ি বানিয়ে ছিল, ১৯৫৭ প্রথম ব্যাটারী চালিত ঘড়ি হ্যামিলটন ৫০০। ১৯৬২ সালে সেন্টার ইলেট্রোনিক হরলুজার(সি ই এইচ) একটি সুইচ-মেড কোয়ার্টজ হাত ঘড়ি তৈরী করে। একই সময় আবার জাপান ইলেকট্রিক ওয়াচ এবং কোয়ার্টজ ওয়াচের উপর কাজ করছিল।

০৬) মেকানিক্যাল ঘড়ি

মেকানিক্যাল ঘড়ি হল যা যান্ত্রিক পদ্বতিতে (অর্থাৎ যন্ত্রের কার্যকরী গঠন সম্পন্ন) সময় পরিমাপ করে। সবচেয়ে জটিল মেকানিক্যাল ঘড়ি তৈরী করেন vacheron Constantin , যার মডেল ৫৭২৬০। আশ্চর্যজনকভাবে, মেকানিক্যাল ঘড়ি যেগুলো কোয়ার্টজ কম্পন সম্পন্ন না , সেগুলো কোয়ার্টজ কম্পন সম্পন্নগুলোর চেয়ে কম সঠিক। আর আধুনিক হালেরটা প্রথম সামনে আসে ১৯৬৯ সালে। বেশিরভাগ এনালগ ঘড়িতে এই কোয়ার্টজ কম্পন আছে , এটি ডিজিটাল ডিস্প্লের সাথেও থাকে যা সংখ্যার সাথে সময় দেখায়।

০৭) রোলেক্স

ঘড়ির জগতে সবচেয়ে ঈপ্সিত ব্র্যান্ড হচ্ছে “রোলেক্স”। যা যেকোন চরম অবস্থার সাথে মানান সই। স্যার এডমন্ড হিলারী ১৯৫৩ সালে ব্রিটিশ হিমালয় অভিযানের সময় প্রথম এ্যাভারেষ্ট শৃঙ্গে পৌছানোর সময় হাতে রোলেক্স পড়েছিলেন। সাত বছর পর ১৯৬০ সালে ইউ এস নৌবাহিনী একটি সাবমেরিন প্রেরণ করেন যা ছিল সমুদ্রতল ৩৭,৭৯৮ ফিট নিচে, কৌতুহলবশত তারা জাহাজের বাইরের দিকের পাত্রে একটি রোলেক্স ঘড়ি বেঁধে দেয়। অবিশ্বাস্যভাবে দেখা যায় এটি সঠিক সময়ের সাথে অক্ষত থাকে।

০৮) ক্রোনোমিটার ঘড়ি

জন হ্যারিসন(১৬৯৩-১৭৭৬)ছিলেন একজন স্ব-শিক্ষিত কাঠমিস্ত্রি এবং ঘড়ির কারিগর। যিনি সমুদ্র যাত্রায় সময় নিরুপন যন্ত্র সামুদ্রিক ক্রোনোমিটার আবিষ্কার করেন। যার সাহায্যে সমুদ্রে দ্রাঘিমাংশ নিরুপন সমস্যা সমাধান পাওয়া যায়। এটি ব্যবহারের নেভিগেশনে যেমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে তেমনি এর ফলে দূর যাত্রায় নিরাপত্তাও বৃদ্ধি পেয়েছে।

০৯) ক্যালকুলেটর ও সৌর ঘড়ি

ক্যালকুলেটর ঘড়ি প্রথম চালু হয় ১৯৭০ সালে এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্র্যান্ড ছিল ক্যাসিও ডাটা ব্যাংক সিরিজ। তাছাড়া টাইমেক্স নির্মিত ঘড়িও জনপ্রিয় ছিল। Seiko Astron বিশ্বের প্রথম জি পি এস সৌর চালিত ঘড়ি। এটির ফিচার এমন যে সময় জোন জি পি এস নিয়ন্ত্রিত, ৩৯টি সময় জোন এবং ক্যালেন্ডার চিনতে পারে। এর সবচেয়ে উল্লেখ্যোগ্য দিক হল স্যাটেলাইট ভিত্তিক অটোমিক টাইম সিংক্রোনাইজেশন, সেই সাথে এটিতে এয়ারপ্লেন মুড চালু আছে, যাতে উড়ন্ত অবস্থায় অটমেটিক সিংক্রোনাইজেশন বন্ধ করে দেওয়া যায়।

এছাড়া রয়েছে জলযাত্রা ঘড়ি। এদেরকে ইয়ট টাইমারও বলা হয়। এগুলো সেইলিং রেইসের জন্য বিশেষভাবে তৈরী। ইয়ট প্রতিযোগিতা শুরু জন্য ১০ মিনিট কাউণ্টডাউন ফিচারে এগুলো চলে। কোন কোনটাতে শেষ পাঁচ মিনিটে রঙ পরিবর্তনও হয়।

পরিশেষ, এই লিখা পড়ার পর থেকে সবসময় মনে পড়বে, যে ঘড়ি আজকে আপনার / আমার হাতে কিংবা পকেটে তা অসংখ্য মানুষের চেষ্টা ও গবেষণার ফসল। আপনি ঘড়ি ব্যবহার করুন আর নাই করুন, আজ থেকে ঘড়ি পড়ার সময় কিংবা সামনে পড়লেই অন্যরকম এক দৃষ্টি দিয়ে তাকাবেন নিঃসন্দেহে। মনে পড়বে জানা ইতিহাসের কিছুটা অংশবিশেষও।

লেখকঃ এনি মাসুদ