পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়া প্রাণঘাতী কয়েকটি রোগের প্রত্যাবর্তন

ih_140408_rare-diseases_800x600আমরা প্রায়ই কিছু ওষুধের কল্যাণে নিজেরা  অনেক আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি এবং বিশ্বাস করি যেন আমরা সব রোগকে পরাজিত করে ফেলেছি।সাম্প্রতিক প্রাদুর্ভাব ইঙ্গিত করে যে, আমরা যতটা নিরাপদ  মনে করছি নিজেদেরকে আসলে তা নয়,এত নিরাপদ নই আমরা। যখনই ভাবা হয়েছে আমরা সকল রোগকে জিতে নিয়েছি ঠিক তখন থেকেই যেন রোগগুলোর প্রত্যাবর্তন হয়। জেনে নি এমন কয়েকটি প্রাণঘাতী রোগ এর প্রত্যাবর্তন-

কলেরা

কলেরা একরকম মারাত্মক ডায়রিয়া। হাইতি তে ১০০বছরের উপর হবে কলেরার কোন চিহ্ন ও ছিল না এমনকি ২০১০ সালের পূর্ব পর্যন্তও।মেইলি নদীর তীরে ২০১০ সালে এর সংক্রমণ দেখা যায়।৪০০জনের উপরে  জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের বসবাস ছিল এই এলাকায়।তারা অধিকাংশই নেপালের ছিল আর নেপালেই কলেরার জীবাণু বেশি। মেইলি নদী দিয়েই বিভিন্নরকম বর্জ্ প্রবাহিত হতো। এর প্রাদুর্ভাবে জাতিসংঘের অফিসিয়াল ১০০০০নিহত হয়। জাতিসংঘের ৯১ শতাংশ মহামারী কমে যেতে পারে যদি তারা শান্তিরক্ষীদের চিকিৎসা বাবদ কলেরা রোগীদের জন প্রতি $১খরচ করে।হাইতিতে এটি এখনো নিয়ন্ত্রণে নয়। কিন্তু এই রোগ অনুন্নত গ্রীষ্মমন্ডলীয় মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।দক্ষিণ কোরিয়া সম্প্রতি ১৫ বছরের মধ্যে প্রথম গড়ে ওঠা কলেরা সংক্রমণ রিপোর্ট পাওয়া গেছে।১৯শতকে প্রায় ৪০০,০০০ মারা যায় যা জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক।দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকর্তারা বিশ্বাস করে না সাম্প্রতিক প্রাদুর্ভাব একটি মহামারী হতে পারে।

ডেঙ্গু জ্বর

ডেঙ্গু জ্বর একটি মশা বাহিত রোগ। এই মশার দরুন জ্বর,ব্যথা এবং সম্ভবত মৃত্যুও হতে পারে। ২০১৬সালে করাচিতে একটি ১৩ বছর বয়েসী মেয়ে এই ডেঙ্গু জ্বর এ আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ডেঙ্গু জ্বরের  প্রাদুর্ভাবে মেয়েটি চতুর্থ শিকার হয়।

২০১৫ সালে পাকিস্তানে ৪০টি ডেঙ্গু জ্বরের মৃত্যু ছিল। বিশ্বব্যাপী বাৎসরিক মৃতের সংখ্যা ২০০০০ এর কাছাকাছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও এটি থেকে নিরাপদ নয়।হাওয়াই এ এই রোগের বৃহত্তম প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। ২০ বছরের বিভিন্ন উন্নয়নের পর  ডেঙ্গু জ্বর এর টিকা বাজারে আসে। দুর্ভাগ্যবশত, এই টিকাটিও যেন রোগটির মতই মারাত্মক। তাই মানুষকে টিকাটি নেওয়ার পূর্বে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।এটা সবচেয়ে কার্যকর যখন মানুষ যারা ইতিমধ্যে রোগটি দ্বারা আক্রান্ত হয়।

কুষ্ঠ

কুষ্ঠ রোগটি হ্যানসেন এর রোগ নামেও পরিচিত।কুষ্ঠ রোগের ফলে বিকৃতভাব,অন্ধত্ব এবং এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।অনেকে মনে করেন এটি একটি প্রাচীন রোগ। ধারণা করা হয় বিশ্বের প্রত্যন্ত জায়গায় এই রোগটি দেখা দিয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণ করা হয়েছে যে এটি একটি সংক্রামক রোগ।রোগটি যদি প্রথম ধরা পরে তাহলে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা যায়।

প্লেগ

বিউবোনিক প্লেগ একটি ভয়ঙ্কর রোগ। এর উপসর্গ জ্বর, পেটের ব্যথা, লিম্ফ নোড ফোলা এবং বমি বমি ভাব। এটি ১৩ শতকে  ‘ব্ল্যাক ডেথ’ হিসেবে কুখ্যাত ছিল। কারণ ইউরোপীয় জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ নিহত হওয়ার জন্য দায়ী ছিল এ রোগ। আরেকটি ছিল ১৯শতকের যা মহামারী আকারে ধারণ করে  আনুমানিক ১০ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে মাদাগাস্কারে এর প্রাদুর্ভাবে ৩৯জন মারা যায়।এছাড়াও অ্যারিজোনা, কলোরাডো ও নিউ মেক্সিকো এই রোগের জন্য আশংকাজনক।

প্লেগ রোগের ব্যাকটেরিয়া Yersinia pestis যা সফলভাবে এন্টিবায়োটিক দ্বারা চিকিৎসা করা যায়। প্রাথমিক চিকিৎসা দ্বারা ১৬ শতাংশ মৃত্যুর হার হ্রাস করা যায়।এরুপভাবে যদি প্রাথমিক চিকিৎসা না করা হয় তাহলে এর সংক্রামক হার বেড়ে ৯৩শতাংশ হতে পারে।

পোলিও

আমেরিকা, ইউরোপ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সব জায়গাকে পোলিও মুক্ত বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা   ঘোষণা করেছে।এ থেকে বোঝা যায় অনেকটা যে পোলিও অতীতের একটি বিষয়,বর্তমানের নয়।  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে আফ্রিকা পোলিও মুক্ত কিন্তু নাইজেরিয়ায় এটি দেখা যায়। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে এই “বন্য” পোলিও আবির্ভাব হয়। ইউক্রেনের একটি সাম্প্রতিক তথ্য থেকে জানা যায় সেখানেও পোলিও  প্রাদুর্ভাব ছিল।তাদের জনসংখ্যার মাত্র অর্ধেক পোলিও টিকা দেয়।

টাইফয়েড জ্বর 

টাইফয়েড জ্বর একটি মারাত্মক ব্যাকটেরিয়া সংক্রান্ত রোগ যা।প্রতি বছর প্রায় ৬,০০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয় এই টাইফয়েড জ্বর এর কারণে। জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন এর কারণে বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে এটি একটি হুমকিস্বরূপ।টাইফয়েড জ্বর সাধারণত দূষিত পানি পান করার ফলে হয়।এর প্রধান উপসর্গ জ্বর, পেটের ব্যথা, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব।শিশুদের মধ্যে বিশেষ করে তীব্র হয় এবং একটি উচ্চ শিশুমৃত্যুর হার এই টাইফয়েড জ্বর।টাইফয়েড হলে স্যানিটেশন, নিরাপদ পানি, এবং উন্নত স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে মোকাবেলা করা যায়।

টাইফয়েড বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে,এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ।ওকলাহোমাতে সম্প্রতি এর  প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।ধারণা করা হয় এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর বাইরে থেকে এসেছে।ফ্লোরিডাতেও টাইফয়েড বৃদ্ধির হার বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

ডিপথেরিয়া

২০১৫সালে ২৮ বছরে পুনরায় স্পেন এ  ডিপথেরিয়া ধরা পড়ে। ক্যাটালোনিয়া  নামক স্থানে  আট বছর বয়সী এক  ছেলে এর শিকার হয়।স্পেন এ বিনামূল্যে এবং ব্যাপকভাবে  টিকা কর্মসূচির উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও, বাবা-মায়েরা তাদের বাচ্চাদের  টিকা দেওয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিল না।১৬ এবং ১৭ শতকে, ডিপথেরিয়া আইবেরিয়ান উপদ্বীপকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল। ডিপথেরিয়ার এই প্রাদুর্ভাব এর সময়কে  “Year of strangulations” নামে অভিহিত করা হয়।ডিপথেরিয়া সাধারণত তরুণ বাচ্চাদের এবং প্রাপ্তবয়স্কদের যেমন ৬০ বছরের উপরে যাদের বয়স তাদের হয়ে থাকে। এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া বহন করে যা বিষের মত এবং এটি মানুষের শরীরের টিস্যু নষ্ট করে ফেলে।এর ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসের অসুবিধা হয়।অনেক সময় এই বিষ রক্তে প্রবেশ করে অভ্যন্তরীণ অঙ্গ আক্রমণ করে।

হাম

হাম২০১০সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষনা করা হয়  যে হাম দূরীকরণ হয়েছে। কিন্তু ২০১৪ সালে, হামের গুরুতর প্রাদুর্ভাব ক্যালিফোর্নিয়ার ডিজনিল্যান্ডে শুরু হয়।১৪টি রাজ্যের মধ্যে চুরাশি ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছে এর দ্বারা।২০১৬সালে আরিজোনাতে এরকম ২২টি ধরা পড়ে। মার্কিন এ হামের বার্ষিক  সংক্রমণ  হার দ্বিগুণ হয়েছে। মস্তিষ্কপ্রদাহ, অন্ধত্ব, এবং মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে হাম থেকে।এই রোগটি ফিরে আসার পিছনে তারা মনে করে দুইটি কারণ-বিদেশ থেকে সংক্রমণ এবং টিকা। প্রতি বছর সারা  বিশ্বে ২২মিলিয়ন মানুষের মধ্যে হাম সংক্রমিত হয়।১৯৬০ দশকের শুরু থেকে মার্কিনে  একটি ব্যাপক টিকা কর্মসূচির মাধ্যমে  হাম দূর করা হয়। দুঃখজনক ব্যাপার এখনো অনেক মানুষই  সতর্কতা অস্বীকার করছে।আক্রান্ত ব্যক্তি যখন একজন সুস্থ মানুষের কাছে যায় তখন এর ফলাফল বিপর্যয়মূলক হতে পারে।