অন্যের কথা যখন হয় নিজের মানসিক বোঝার কারণ, মুক্তির উপায় কি?

বয়স যাই হোক না কেন, আপনি কিভাবে দেখছেন এবং অন্যারা কিভাবে দেখছে, তা নিয়ে কোনোভাবে বয়সকে দোষ না দিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে ফেলুন।হুট করে একটা কথা বলে ফেলার জন্য ছেলে হোক বা মেয়ে হোক বয়স পনের-বিশ হলেই পরিবার থেকেই প্রথম শোনা যায়, ‘তুমি এখন যথেষ্ট বড় হয়েছ, বাচ্চাদের মতো বোকা বোকা কথা বলো না, বাচ্চাদের মতো আচরণ করো না, জ্ঞান-বুদ্ধি এখনো বাচ্চাদের মতো ইত্যাদি।

আবার বয়স পঁচিশ-তিরিশ হলে অনেকের ক্ষেত্রে শোনা যায় ‘এখন শেখার বয়স নেই, শেখানোর বয়স, এ সময় কোনো ভুল করা যাবে না, ভুল করার বয়স পার হয়ে এসেছ, এখন তোমার চাকরি করার বয়স, বিয়ের বয়স, দায়িত্ব পালনের বয়স তাই নিজেকে সেভাবে যোগ্য করে গড়ে তোলো, বড়দের মতো হতে শিখো, আচরণ বদলে ফেলতে হবে, না জানি আরও কত কি বানী আছে! পরিবার শুধু আপনাকে আপনার সমস্যাগুলো দেখিয়ে দেবে, বাহিরের মানুষ সমস্যাগুলো নিয়ে হাসি-তামাশা ও নানান রকম কথা বলবে। এ নিয়ে মন খারাপ কিংবা হতাশ হওয়ার কোনো মানেই হয় না। তাই অন্যকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই নিজের সমস্যা সমাধান করুন আর আত্মবিশ্বাসী হোন এবং আশপাশের মানুষগুলোকে তাদের ভুলগুলো বুঝতে দিন। স্থান ভেদে বাকস্বাধীনতা, প্রাইভেসি রেখেই লজিস্টিক কথা বলুন। আপনি যা বোঝাতে চাইছেন তা সময় নিয়ে সহজ বাক্যে বলুন। প্রয়োজনে ভেবে দ্বিতীয়বার বলুন। তারপরও কেউ যদি আপনাকে বলে, বাচ্চাদের মতো করো না, বলো না তখন তর্কে না জড়িয়ে নিজের মনকে বলুন- বাচ্চাদের মতো আচরণ তাদের কাছ থেকেই আশা করা যায় যাদের মন পরিষ্কার। আমার লেখাটি মূলত তাদের উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর জন্য, যারা উপরোক্ত কথাগুলো বলে থাকেন আর যারা শুনে থাকেন।

কথা হচ্ছে, বয়স যাই হোক না কেন- সরলতা, ভদ্রতা ফুটে উঠবে ব্যক্তির আচরণে, বয়সে নয়। তাই বয়সের সাথে সাথে আপনার আচার-আচরন, চলন-বলন পাল্টে ফেলা জরুরী নয়। এটা কোনো বইতেও লিপিবদ্ধ নেই। যদি ভুল করার বিষয় আসে তাহলে অবশ্যই প্রত্যেক মানুষকে মনে রাখতে হবে ‘মানুষ মাত্রই ভুল’।শিশু থেকে বৃদ্ধ প্রত্যেকেরই ছোটো থেকে বড় ভুল হতে পারে। একজন বয়স্ক লোক যে ভুল করবেন তা পনের বছরের একজন শিশুও করতে পারে। ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হয়। অপরাধ শুরু হয় ছোটো ছোটো ভুল দিয়ে তাই অঙ্কুরেই শুধরে নিলে অপরাধের আশংকা কমানো যায়। এটা মানসিকতার ব্যাপার।

অনেকেই ভাবেন এবং কাউকে নিচু করার জন্য কথায় কথায় বলে বসেন, শিশুরাই শুধু বোকার মতো কাজ করে বা কথা বলে। কিন্তু এ কথার ভিত্তি নেই কারণ একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষও বোকামি করে ফেলতে পারেন। তৎক্ষণাৎ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না বলে কেউ কেউ প্রয়োজনের সময় পদক্ষেপ নিতে পারেন না। তাই বলা যাবে না যে, বাচ্চাদের মতো বোকামি করো না। বোকার মতো কথা বা কাজ তারাই করে যারা কোনো প্যাঁচ বোঝেন না, মনের মধ্যেও এমন জাতীয় ভাবনা আনেন না।

প্রসঙ্গ যখন চাকুরির। ছেলেমেয়ে একটু বড় হলেই অনেকেই বলে বসেন, তোমাদের বয়সে আমরা অমুক পাশ, তমুক পাশ করেই চাকুরির জন্য ছুটেছি। তাই তোমাদের সময় নষ্ট করা যাবে না। কথাটা আপনি মাথায় রাখুন কিন্তু ভালো-মন্দ, সুযোগ-সুবিধা যাচাই-বাছাই না করে তাড়াহুড়ো করে কোনো চাকরিতে জয়েন করবেন না। এতে আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। আপনি হয়তো চাকরির জন্য চেষ্টা করছেন সেটা আপনার পরিবারকে জানিয়ে রাখুন। তাহলে তারাও আপনার চাকরির বয়স নিয়ে চিন্তিত হবেন না বরং আপনি তাদের বিশ্বাস যোগ্যতা অর্জন করবেন। বিজনেজ করতে চাইলে তাদেরকে পাশে রাখুন কারণ তাদের অভিজ্ঞতা আপনার প্রয়োজনে পরামর্শ নিতে সাহায্য করবে।

জন্ম থেকে সবাই সব কিছু শিখে আসে না। অনেক সময় বলতে শোনা যায়, ‘এতো বড় হয়েছ এখনো এটা পারো না?’ লোকে আপনার কর্ম নিয়ে দুটো কথা শোনাবেই। তাই এসব কথায় কান না দিয়ে ওই দুটো কথার বিনিময়ে কাজটি শিখে নেওয়ার চেষ্টা করুন। শেখার জন্য কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শেখার বয়স। তবুও মাস্টার্স কমপ্লিট করা একজন ছেলে বা মেয়ে ফ্যাশন ডিজাইনিং বা বিজনেজ সম্পর্কে কিছু শিখতে চাইলে অনেকেই বলে বসেন এখন শেখার বয়স নেই। একটি ঘটনা বলি – আমার পরিচিত একজন ডক্টর এর ব্যক্তিগত তথ্য দিচ্ছি যেন এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা যায়। তিনি এমবিবিএস পরীক্ষার সময় অসুস্থ থাকার ফলে পরীক্ষায় ফেল করেন, পরবর্তী বছরে আবার পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। আরও ডিগ্রী নেওয়ার জন্য এমসিপিএস পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন ,সেসময়ও ওনার আর্থিক সমস্যার ফলে পারিবারিক কোনো এক সমস্যার ফলে আবার পিছিয়ে যান। তখন তার কো-স্টাফ তাকে তার বাড়তি বয়স নিয়ে কটূক্তি করেছিলেন, বলেছিলেন আপনার বয়স দেখেন? এই বয়সের ভারে আপনি আর এগোতে পারবেন না। এর চেয়ে এমবিবিএস দিয়েই চেম্বারে যেমন আছেন তেমনি থাকুন। সাময়িকভাবে আপ্সেট হলেও তারপরও তিনি দমে যান নি। পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করে এমসিপিএস পাশ করলেন। এখন তিনি এনআইডিসিএইচ এর সহকারী অধ্যাপক। তাই আপনি ইচ্ছে করলে বয়সকে বাধা না মনে করে নতুন করে এগিয়ে যেতে পারেন।

এবার আসছি বিয়ের কথায়। ছেলে বলুন আর মেয়ে বলুন বয়স পঁচিশ-তিরিশ হলেই বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন বিয়ের কথা বলে একজন ছেলে বা মেয়েকে অপ্রস্তুত করে তোলেন। মেয়ে হলে অনেকের কাছে শুনতে হয়, বয়স বেশি হলে বাচ্চা নিতে সমস্যা হবে। আর ছেলে হলে শোনা যায় কবে বাচ্চা-কাচ্চা পালন করবা? অথচ তারা বুঝবেন না আপনি কি বিয়ের জন্য প্রস্তুত কিনা? বিয়ের আগে আপনি ক্যারিয়ার নিয়ে কোনো প্ল্যান করছেন কি না? তারা আপনার পরিবারকে উস্কে দিয়েই দায়িত্ব শেষ মনে করেন। তাই আপনার মন যা চাইবে তাই করা উচিত। আবার, বন্ধু-বান্ধবদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আর আপনিই শুধু সিঙ্গেল থাকছেন এটা নিয়ে চিন্তিত বা আপ্সেট হবার কিছু নেই। বন্ধু-বান্ধবদের বিয়ে যাচ্ছে বলে হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত না নেওয়াই ভালো। বরং এ সময়টাকে আপনার উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের জন্য কাজে লাগান, নিজের ব্যাংক ব্যাল্যান্স বাড়ান, ধীরে ধীরে দায়িত্ব নিতে শিখুন, ইচ্ছেমতো ঘুরতে যান, গান শুনুন, বাড়িতে থাকা মুরব্বিদের কাজে সাহায্য করুন, পাশাপাশি নিজেকে বিয়ের জন্য প্রস্তুত করুন।আবার দেখা ৫০-৬০ বছরের বিপত্নীক বয়স্ক অসুস্থ পুরুষ নিজের কথা ভেবে যদি পুনরায় বিয়ে করতে চান তখনও আত্মীয়-স্বজন বলে বসেন- যে বয়সে ছেলে-মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কথা সে বয়সে বাবাই বিয়ে করতে যাচ্ছেন! কিন্তু তারা একবারও ভেবে দেখছেন না যে, এতো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনের বড় কারণগুলো। তাই পরামর্শ রইলো, নিজেই নিজের জন্য পছন্দমত সঙ্গী নির্বাচন করুন। আপনার বিয়ের সিদ্ধান্ত আপনার ওপর। অন্যের কথায় প্ররোচিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলে জীবনে পস্তাতে হতে পারে।

নিজেকে এবং নিজের কাজকে মূল্যায়ন করতে শিখুন। আজ যারা প্রতি পদে বাঁধা হচ্ছে তাদের কথা মনে রেখে নিজের অবস্থান ধরে রাখুন, মনকে শক্ত রাখুন, আপনি যা করছেন তার ওপর বিশ্বাস রাখুন। ভুল হলে স্বীকার করুন। বাঁধাগুলোকে ধুলোর মতো উড়িয়ে দিন। আশা করি, আপনারা ভালো থাকবেন।