আমার পুজোর স্মৃতি

happy-durga-puja-images-photos

 শরতে আজ কোন্‌ অতিথি এল প্রাণের দ্বারে।

আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে॥

নীল আকাশের নীরব কথা শিশির-ভেজা ব্যাকুলতা

বেজে উঠুক আজি তোমার বীণার তারে তারে॥

শষ্যক্ষেতের সোনার গানে যোগ দে রে আজ সমান তানে,

ভাসিয়ে দে সুর ভরা নদীর অমল জলধারে।

যে এসেছে তাহার মুখে দেখ্‌ রে চেয়ে গভীর সুখে,

দুয়ার খুলে তাহার সাথে বাহির হয়ে যা রে॥

 

কবির এই আবেগ আর উচ্ছ্বাসের সাথে আমারা ছোট বড় সকলেই উদ্ভাসিত হয়ে ভেসে যায় দুর্গা পুজোর এই কয়েকটা দিন। সত্যিই তো পুজো মানেই ছুটি, নতুন জামা কাপড়, প্রতিমা দেখা, পুজোর স্পেশাল খাবার দাবার, আরো কত কি? তবে ছোট বেলার পুজোর মত আনন্দ, বয়সের সাথে সাথে ফিকে হয়ে এলেও কিছুটা রেশ কিন্তু থেকেই যায়।

 

পুজোর প্রস্তুতি:

 

বর্ষার মেঘ কেটে শরতের সোনা রোদ দেখা দিতেই অনেকের বাড়িতে শুরু হতো পুজোর প্রস্তুতি। বিভিন্ন পত্রিকার পুজো সংখ্যা আসতে থাকে বাড়িতে। মা বাবা, বড়দের নিয়ে পোশাকের দোকানে দোকানে ঘোরা। পুজো নিয়ে শুরু হয়ে যায় নানা পরিকল্পনা।

আজো হিম হয়ে এলে ছেলে বেলার রোদে ফেলে আসা সেই পুজোকে খুঁজে ফিরি বার বার। ছোটবেলায় আমাদের অনেকেরই হয় পুজো কেটেছে মফস্বল না হয় ধ্যারধ্যারে গ্রামে। সেসময অনেক গ্রামেই আসেনি বিজলি বাতি। অনেক গ্রামেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা কম হলেও  সকলকে  নিয়ে বেশ জাঁকজমক সহকারে দুর্গা পুজো উদযাপিত হতো। পুজোর যে সার্বজনীনতার একটা আমেজ সেসময়ে গ্রাম বাংলায় বেশ চোখে পড়তো। আজ শৈশবে ফেলে আসা এমনই কিছু পুজোর স্মৃতি ,ভালো লাগার কথা জানাবো।

 

 প্রকৃতিতে কাশফুল ও পুজোর ঢাকে আগমনীর আগমন বার্তা

 পুজো এবং শরতের সাথে কাশফুলের যেন রয়েছে এক এক অদ্ভুত সর্ম্পক। যখনই কোথাও কাশফুল ফটে থাকতে দেখলে ছোটবেলার ভাবুক মন বুঝে যেত শরত এসেছে। আর তার সাথে আগমনীর অপেক্ষায় প্রহর গোনা শুরু। চারদিকের এক অদ্ভুত মাদকতা পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে যা এখনকার ইট পাথরের দেয়ালে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রকৃতির মধ্যে শরৎ এসেছে উপলব্ধি করি এবং সাথে সাথে পুজোর ঢাক শুনার প্রহর গুনতে থাকি।

 

পুজোয় ফেলে আসা গ্রাম

তখন পুজোর ছুটিতে সপরিবারে গ্রামে যাওয়া ছিল আমাদের বাধ্যতামূলক। মজাই লাগতো। এই কয়েকটি দিনের জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে সারা বছর অপেক্ষা করতাম। মুসলিম প্রধান এই গ্রামের এক নিভৃত কোনে যখন ঢাক বাদ্যি দিয়ে মায়ের আবাহন জানানো হতো তখন ও দেখতাম দল বেঁধে সব ধর্মের লোকেরা মন্দির চত্বরে এস ভিড় করতো। পুজোর সার্বজনীনতার এক অপরূপ মিলন ক্ষেত্র হতো তখন পুরো গ্রামটি। শৈশবের সেই ভালো লাগা স্মৃতি এখনো চির অম্লান। এখনো প্রতি বছর আমাদের গ্রামের বাড়িতে পুজো হয়। কালে ভদ্রে পুজোর সময় বাড়ি যাই। কিন্তু সেদিনের সেই ভালো লাগা আজকে যেন একটু একটু ফিকে হয়ে যাচ্ছে।

স্থল পদ্ম ও শিউলি ফুলের সেই গাছ

আমাদের মন্দিরের চাতালের পাশেই স্থল পদ্মের একটি ফুলের গাছ ছিল । একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল গাছটিতে। শুধুমাত্র পুজো আসার কিছু দিন আগে থেকে স্থল পদ্মের পুরো গাছটি ফুলে ফুলে ছেয়ে যেতো। গাছটিতে এত ফুল ফুটতো যে পাতার বদলে শুধু গোলাপি রঙের আভা ভোরের সূর্যের সাথে মিশে এক অদ্ভুত মায়াময় পরিবেশ তৈরী করতো।  এই গাছটির একটু দূরেই ছিলো শিউলি ফুলের বিশাল গাছ। ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেতাম শিউলি ফুলে ভরে যেত মন্দিরের চাতাল। যেন কেউ এসে শিউলি ফুলের কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছে। পুজোর সময় পুজোর ফুল জোগাড় করা শৈশবের এক অনাবিল স্মৃতি। ঘুম থেকে উঠেই ছুট দিতাম শিউলি গাছটার নিচে। কি অদ্ভুত যে লাগতো। মনে হত কেউ যেন রাত্রে চুপিচুপি এসে পুরো মন্দিরের চাতালটা শিউলি ফুলের বিছানা পেতে দিয়েছে । তাই এই ফুলটা আমার কাছে এক অন্যরকম ভালো লাগার নাম ।

পুজোর অঞ্জলী ও ভোগ:

পুজোর অঞ্জলী ও ভোগের জন্য পুজোর এই চারদিন তীর্থের কাকের মতো বসে থাকা, ছোটবড় সবাই প্রতিমার সামনে বসে অঞ্জলী দেয়া। মা বলেছেন ঠাকুর মশাই যে মন্ত্রগুলো বলছে তা যেন ঠিকঠাক বলি। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের তা নিয়ে কি হুলুস্থুলু।

পুজোর আরেক বিশেষ আকর্ষন হলো পুজোর ভোগ। একেক দিনে একেক রকম ভোগে পেট পুজো ভুলবার নয়। কখনো বা খিচুড়ী, পায়েশ আবার কখনো লুচি, আলুর দম সহযোগে মিষ্টি কিংবা কখনো নানা ফল । আমাদের বাড়ির পুজোয় সন্ধ্যে আরতি শেষে সবাইকে এক বিশেষ প্রসাদ দেয়া হতো।  সাবু, পাঁচ রকমের ডাল ,নানা ফল ও মিষ্টি দিয়ে তৈরি অদ্ভুতিএক রেসিপির সাথে মিষ্টি, নিমকি যা ছিল সকলের জন্য।

পুজো দেখা ও ধুনুচী নাচ: 

পুজোয় বড় আকর্ষন ছিল ধুনুচি নাচ। ধুনুচি নাচ দেখতে দেখতে কখন মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়তাম মনেই থাকতো না।

পুজোদেখা আর এক বিশেষ আকর্ষণ্ সবাই মিলে দল বেধে পুজো দেখা, ২ টাকা আইসক্রিমে তৃষ্ণা মিটানো সেকি সহজে ভুলা যায়। পুজো দেখতে গেলে প্রচুর হাঁটতে হয়। হাঁটতে হাঁটতে পায়ে নতুন জুতোর ফোস্কা পড়ে যেত। কিন্তু এই চারদিনে যতগুলো সম্ভব এবং সবচেয়ে বেশি পুজো প্যান্ডেল, প্রতিমা দেখতে হবে যে। কষ্টের সাথে চোখে-মুখের উচ্ছ্বাস সবকিছু একাকার হয়ে যেতো।

দশমীর মায়ের বিসর্ন ও রঙ খেলা:

মায়ের তো আর বিসর্জন হয় না। মাকে বিদায় জানানো হয়। মা যেন সামনের বছর আবার আমাদের মাঝে আসেন আর এমনি করে সবাইকে নিয়ে আনন্দ করা যান মায়ের কাছে সে প্রাথর্না থাকে। শৈশবের দশমীতে সবাই মিলে রং খেলা এখনো মনের এক কোনে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা আজো স্মৃতিময়।

সেকাল ও একাল:

সেকালের পুজোতে ছিলো সাবেকি আনা, গাম্ভীর্য, আবেগ আর ভালো লাগা। এসময় বাড়ির বিবাহিত মেয়েদের নায়র আনা হতো। সবাইকে নিয়ে জমজমাট এক পুজো উৎসব। সব আচার অনুষ্ঠান যাতে ঠিকমতো হয় বাড়ির বৃদ্ধরা তা সর্বক্ষণ নজড়ে রাখতেন। একালের পুজোর  চাকচিক্যতা আর থীম পুজোর আড়ালে হারিয়ে গেছে সেই আচার, সেই রীতিনীতি। পুজোয় থিম পুজো আর চাকচিক্যতা দেখতে দেখতে সাবেকি পুজোয় মায়েরে মুখ দেখার কথা অনেক সময় ভুলেই গেছি।

তবু  ‍প্রতিবছর মা আসেন। পুরনো কে ভুলে গিয়ে নতুন আঁকড়ে তো নিতেই হবে। আধুনিকতার ছোয়াকে তো আর অস্বীকিার করার জো নেই।  বিসর্জন দেখতে কারো ভাল লাগে না। বিসর্জনে বাজে বিদায়ের সুর। সে সুর বড় এক ঘেয়ে। হাহাকার ধ্বনি শুনতে কার ভালো লাগে বলুন।

 

দূর্গা পুজো যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি অনুষ্ঠান,তথাপি অনুষ্ঠানকে একটু সরিয়ে রেখে যদি বৃহৎ চিন্তা করি তাহলে এর মতো এটি একটি সার্বজনীন উৎসব, আনন্দময় উৎসব যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ  নিবিশেষে সকলেই অংশগ্রহণ করতে পারেন। এই পুজোর কয়টি দিন সবার ভালো কাটুক। সকলকে শারদীয় শুভেচ্ছা। আর যেতে যেতে বলে যায়-

এই প্রাণ ঢালা উৎসবে বারবার
আলো আশা ভালোবাসা
মিশে একাকার

এই শরত তপনে প্রাণেরও স্বপনে
আনন্দ উৎসবে মিলেমিশে একাকার।

এই মহামিলনের ক্ষণে
সেই চিরনতুনের টানে
এই মঙ্গল গানে গানে
সুর মিলে বারবার ।

এই উজ্জ্বলতার স্রোতে
এই বুকের ভিতর হতে
এই ফুটে উঠা বিশ্বাসে
ফিরে আসে বারবার ।

 লেখকঃ প্রকাশ কুমার নাথ