অনুপম প্রাচীন ভারতীয় নিদর্শনঃ কৈলাসের তীর্থ মন্দির

কৈলাসের তীর্থ মন্দির প্রাচীন ভারতের অন্যতম নিদর্শন। মহারাষ্ট্রের ইলোরায় অবস্থিত এই বিশাল মন্দিরের পুরোটাই পাহাড় কেটে বানানো। তাই একে Monolithic বা একটি মাত্র পাথরে তৈরি বানানো মন্দিরও বলা হয়ে থাকে। এটাই পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মনোলিথিক মন্দির। অসামান্য স্থাপত্যরীতি ও নকশার কারণে এই মন্দিরটি বর্তমানে যুগের স্থপতি, বিশেষজ্ঞ, ঐতিহাসিকদের কাছে একটি বিস্ময়। বলা হয়ে থাকে এই মন্দির বানানোর পর মন্দিরের নির্মাতা নিজেই নিজের কাজে বিস্মিত হন। যার উদ্দেশ্যে এই মন্দির নির্মিত এই দেবতা শিপ পর্যন্ত বিস্মিত হন।

মন্দির তৈরির ইতিহাস নিয়ে মহারাষ্ট্রের অধিবাসী মারাঠিদের মধ্যে যে লোককাহিনী প্রচলিত আছে তা থেকে জানা যায় রাজা প্রথম কৃষ্ণ একবার খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন রানী রাজার সুস্থতার জন্য তাদের দেবতা ঘ্রিশনেশ্বেরের (শিব) কাছে করজোড়ে প্রার্থনা করতে থাকেন। স্বামী সুস্থ হয়ে গেলে তিনি একটি শিবমন্দির বানানোর প্রতিজ্ঞা করেন। এমনকি মন্দিরের চূড়া দেখার আগ পর্যন্ত উপবাস থাকতেও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। শিবদেব রানীর প্রার্থনা শোনেন এবং অচিরেই রাজা কৃষ্ণ সুস্থ হয়ে উঠেন।

রাণী তখন তার প্রতিজ্ঞাপালনে সচেষ্ট হন।তিনি রাজা কৃষ্ণকে বলেন তার প্রতিজ্ঞার কথা। রাজা কৃষ্ণের আদেশ তৎকালীন স্থপতিদের খবর দেয়া হল। সব শুনে স্থপতি গন এই আদেশ পালনে তাদের অপারগতা প্রকাশ করল। কারণ তারা জানত এই ধরনের মন্দির বানানো অনেক সময়ের ব্যাপার। আর এত সময় ধরে রানীর উপবাস থাকা সম্ভব হবে না। তাই তারা এই কাজে হাত দিতে সাহস করেনি। কিন্তু কোকাসা নামে এক মন্দির নির্মাতা রাজাকে আশ্বস্ত করেন যে, এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি মন্দিরের চূড়া দেখিয়ে দেবেন।

কৈলাসের মন্দির

বর্তমান যুগের স্থপতিরা অবশ্য “সাতদিনের” গালগল্প বিশ্বাস করেন না। বিশেষজ্ঞরা ধারনা করেন পাহাড়টিকে মন্দিরে পরিণত করতে ১৫-২০ লক্ষ টন কঠিন পাথর চেঁছে ফেলতে হয়েছে। অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদ বলেন পাহাড় থেকে ৩ লক্ষ টন পাথর কেটে ফেলতে হয়েছে। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দির বানানো হয়। তখন তো বটেই বর্তমান যুগেও সাতদিনে এই পাথর কাটা এবং কাটা পাথর সরিয়ে ফেলে এককথায় অসম্ভব। কোন কোন ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন পাহাড়ের গায়ে এই তীর্থ মন্দিরটি খোদাই করতে ১৮ বছর সময় লেগেছে। এর স্থাপত্যশৈলী প্রমাণ করে খোদাই কাজ শুরু করার পূর্বেই সমস্ত পরিকল্পনা সুচারুরূপে সম্পন্ন করা হয়েছিল।

ঐতিহাসিকদের মতে বর্তমানের কৈলাস মন্দিরের সাথে প্রথমবার নির্মিত মন্দিরের অনেক অমিল রয়েছে। মূলত এই মন্দিরের কাজ রাজা কৃষ্ণর আমলে শুরু হলেও দক্ষিণাত্যের পরবর্তী রাজাগন এতে নামা পরিবর্তন-পরিবর্ধন করেছেন।

কৈলাসের শিব মূর্তি

মূলত দেবতা শিবের জন্য নির্মিত হলেও এই তীর্থ মন্দিরের মোট ৩৪ টি মন্দির ও মঠ রয়েছে। এর মধ্যে ১৭ টি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের, ১২ টি বৌদ্ধদের এবং ৫ টি জৈনদের। মূল শিবমন্দিরটি কৈলাস পর্বতের নামানুসারে কৈলাসানাথা নামে পরিচিত। মূল শিবের মন্দিরের উঠোনে শিব দেবের বাহন ষাঁড় “নন্দী”র মূর্তি রয়েছে। পাহাড়ের পাদদেশে হাতির প্রতিকৃতি এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে, দেখলে মনে হবে পুরো মন্দিরটা হাতির পিঠে ভর করে আছে।

মন্দিরের পাদদেশের হাতি

এম.কে. ধাবালিকরের মতে প্রধান তীর্থ মন্দির, এর সংলগ্ন রাস্তা, নন্দী মণ্ডপ, নিচের সিঁড়ি সমূহ, হাতি-সিংহের মূর্তি, পাদদেশের হাতির অংশ এবং বিজয় স্তম্ভের কাজ রাজা প্রথম কৃষ্ণের আমলেই সম্পন্ন হয়েছিল। তিনি এটাও মেনে নেন যে মূল মন্দিরের কাজ শেষ হবার পর রাবণের অংশটুকু বানানো হয়। অপর সকল মন্দির এবং তার অংশবিশেষ পরবর্তী রাজাদের আমলে ধাপে ধাপে গড়ে তোলা হয়।

মন্দিরের দেয়ালে খোদাই করা এবং রঙ দিয়ে আঁকা যেসব ছবি দেখা যায় সেগুলোতে রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এমন একটি ছবি আছে যেখানে দেখানো হয়েছে লংকার রাজা রাবণ চেষ্টা করছেন কৈলাস পর্বত উপড়ে ফেলতে। এই মন্দিরের বাইরে আরও কয়েকটি তীর্থ মন্দির রয়েছে যাদের মধ্যে তিনটি হল হিন্দুদের নদীর দেবী যমুনা, সরস্বতী ও গঙ্গার।

তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট