“গোল্ডেন লিলি ফিট”- এক অদ্ভুত পীড়াদায়ক চৈনিক ফ্যাশন!

অনেকেই বলে থাকেন আধুনিক যুগের ফ্যাশনের কিছু ধারা অদ্ভূত বা কোন কোন ক্ষেত্রে বিপজ্জনকও। কিন্তু আমরা যদি অতীতের ফ্যাশনের ধারার দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখবো সেই সময়কার মানুষেরা ফ্যাশনের চলতি ধারার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে এমনকি নিজের জীবনকেও ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতেন।

ফুট বাইন্ডিং বা পায়ের পাতা বেঁধে রাখার প্রবণতা ছিল তেমনই একটি অতি ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাশন। চীনে দশম থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় ১০০০ বছর পর্যন্ত এই রীতি প্রচলিত ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে সেই দেশে ছোট ও বাঁকানো পায়ের পাতাকে সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হতো। আর তাই চীনা সংস্কৃতিতে পায়ের পাতা বেঁধে রাখার এই রীতি বংশানুক্রমে চলতে থাকে।এই ধরণের পা কে বলা হতো “গোল্ডেন লিলি ফিট” এই অদ্ভূত রীতি মানতে গিয়ে অনেকেই বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হন, এমনকি কারো কারো মৃত্যুও ঘটে।

পায়ের এক্স রে

কীভাবে এই প্রথার চর্চা শুরু হলো, তা নিয়ে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। কথিত আছে যে, ৯৭০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট লি ইউ এর শাসনামলে এই প্রথার সূচনা ঘটে। সম্রাটের সবচেয়ে প্রিয় রক্ষিতা ছিলেন ইয়াও-নিয়াং, যিনি নিজের পায়ের পাতাকে চাঁদের আকৃতিতে বেঁধে পদ্মফুলের ওপরে নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন। আর তাই সম্রাটের অন্যান্য উপপত্নীরাও সম্রাটকে মুগ্ধ করার জন্যে ইয়াও-নিয়াংয়ের অনুকরণ করতে চেষ্টা করতেন।

ফ্যাশনের এই নতুন ধারা অচিরেই চীনের দক্ষিণাঞ্চলের উচ্চবিত্ত মহিলারা গ্রহণ করে নিতে শুরু করেন। ক্রমেই চীনের উত্তরাঞ্চলেও এই ফ্যাশন ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে যদিও এটিকে উচ্চতর সামাজিক অবস্থান ও সম্পদশালীতার প্রতীক হিসেবে ধরা হতো, কিন্তু পরবর্তীতে এটি সকল সামাজিক স্তরের মহিলাদের মধ্যেই বিস্তৃতি লাভ করে।

সাধারণ পা এবং “ফুট বাইন্ডিং” পা

এই পীড়াদায়ক প্রক্রিয়ার শুরুটা হতো চার থেকে নয় বৎসর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে। এ প্রক্রিয়ায় প্রথমে পায়ের পাতার হাড় ভেঙ্গে ফেলা হতো এবং পরে পায়ের পাতাকে খুরের মত আকৃতি দেওয়া হতো। অঞ্চলভেদে পা বাঁধার প্রক্রিয়াও ভিন্ন ভিন্ন ধরণের হতো। যেহেতু গ্রামের কৃষক সম্প্রদায়ের মহিলাদের মাঠে কাজ করার জন্যে পা জোড়া সম্পূর্ণ কর্মক্ষম হওয়া জরুরী, তাই শহরাঞ্চলের মহিলাদের মধ্যেই এই প্রথার প্রচলন ছিল বেশি।

যন্ত্রণাদায়ক এই প্রক্রিয়ার জটিলতাও কম ছিল না। প্রক্রিয়া-পরবর্তী সংক্রমণ, পচন ধরা, আজীবন পঙ্গু্ত্ব ধীরেধীরে মহিলাদেরকে মৃত্যুর মুখেও ঠেলে দিয়েছে।

ফুট বাইন্ডিং খোলার পর

১৯১১ সাল থেকে চীনে ফুট বাইন্ডিং নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও বহু নারী এ প্রথার চর্চা চালিয়ে যেতে থাকে। ১৯৫০ এর দিকে ফুট বাইন্ডিং বিরোধী পরিদর্শক বাড়ি বাড়ি গিয়ে মহিলাদের পায়ের এই বাঁধন জোরপূর্বক খুলে দিতেন এবং ফুট বাইন্ডিং করানো কোন মহিলাকে খুঁজে পেলে জনসমক্ষে তাকে হেনস্তা করতেন। তাই মহিলাদের মধ্যে অনেকে বড় আকৃতির জুতা পরে এবং কাপড় দিয়ে পা ঢেকে রেখে পরিদর্শকদের এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন।

বিশেষভাবে তৈরিকৃত জুতা

এই প্রথা পালন করে পরবর্তীতে অনেক মহিলাই অনুশোচনা বোধ করেছেন। ঝু গুইঝেন নামক এক বৃদ্ধা, যিনি এই প্রথা পালন করেছিলেন, NPR.org কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি নাচতে পারি না। ঠিকভাবে চলতে পারি না। আমার ভীষণ অনুশোচনা হয়। কিন্তু সে সময় যারা পা বাঁধতো না, তাদের বিয়েও হতো না।”

ঠিক কী কারণে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মহিলারা এই ভয়ংকর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতেন, তা হয়তো এ যুগে এসে আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, কিন্তু এটি শুধুই একটি ফ্যাশন নয় বরং তার চেয়েও বেশি কিছু ছিল বলেই হয়তো সে সময় এ প্রথা নিশ্চিহ্ন করা সহজসাধ্য ছিল না।

Source:bound-to-be-beautiful-the-bizarre-practice-of-foot-binding-was-once-a-symbol-of-beauty-in-china/