প্রাচ্যের ঐতিহ্য সোনারগাঁও

ঢাকা থেকে অদূরেই নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় অবস্থিত পানাম নগর। বেশ কদিন আগে বন্ধু বান্ধব মিলে পানাম ঘুরে এলাম। আসার পথে মনে হল কেবল লাল ইটের ভগ্নপ্রায় দালানের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলাটাই কি পানামের বৈশিষ্ট্য? কারা থাকত এখানে? শত শত বছর আগে এই পথ ধরে কারা হেটে যেত? বাঁকানো সরু সিঁড়ি বেয়ে প্রতিদিন বিকেলবেলা ছাদে উঠে যেসকল নারীরা কলকাকলিতে মেতে উঠত, কি তাদের পরিচয়? তাই একটু খোঁজ খবর নিলাম। পানাম নগর ও সোনারগাঁর ইতিহাস সম্পর্কে। এক বিশাল বিস্তৃত চিত্র ফুটে উঠল চোখের সামনে। পাঠকদের জন্য কিছুটা তুলে ধরবার চেষ্টা করছি।

সোনারগাঁ, আজ বিশ্বাস হতে চাইবে না যে এক সময় এখানে রাজা বাদশা, শাহ সুলতানদের রাজধানী ছিল। পূর্বে লাক্ষা নদী, দক্ষিণে মেঘনা আর পশ্চিমে ইছামতী নদীর তীরভূমি থেকে শুরু করে উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত এই সত্তর মাইল দীর্ঘ অঞ্চলটিতে সোনারগাঁও রাজ্য অবস্থিত ছিল। সেকালে ব্রহ্মপুত্র পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে বয়ে যেত। চারধারে এভাবে দ্বীপের মত বৃহৎ নদীগুলোর দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকার দরুণ প্রতিরক্ষার জন্য এটি যথার্থ উপযোগী ছিল। বাংলার হিন্দু রাজাদের শেষ বংশধরগণ বিজয়ী মুসলমানদের আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে তাই এখানেই পালিয়ে আসেন। লক্ষণ সেনের পৌত্র দনুজ রায়ের আমলেই এ অঞ্চলে হিন্দু শাসনের যবনিকাপাত নেমে আসে। তখন তুগ্রিল খান ছিলেন বাংলা প্রদেশের সুবাদার। তিনি সম্রাট বলবনের একজন তাতারি গোলাম ছিলেন। বুদ্ধি ও যোগ্যতাবলে তিনি উন্নতির শীর্ষে উপনিত হন। ত্রিপুরা জয় করার পর তিনি বিপুল পরিমাণ ধন সম্পদ নিয়ে ফেরত আসেন যেগুলো বহন করতে একশটি হাতির প্রয়োজন হয়েছিল। ফিরে এসেই তিনি সম্রাটের মৃত্যুর খবর রটিয়ে দিলেন এবং নিজেকে স্বাধীন বাংলার সুলতান দাবী করলেন। সম্রাট এ স্বেচ্ছাচারীতায় ক্রোধিত হয়ে উঠলেন এবং তুগ্রীল খাঁ কে শায়েস্তা করার জন্য নিজে সোনারগাঁ অভিমুখে রওনা দিলেন। বাদশাহর আগমন সংবাদে সুবাদার দনুজ রায় অত্যন্ত ভীত হয়ে আত্মসমর্পণ করলেন আর তুগ্রীল খাঁ ওদিকে ফের ত্রিপুরা পলায়ন করল। যদিও পরবর্তীতে তিনি ধরা পড়েন ও কারাগারে বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। তবেঁ সে যাই হোক, সোনারগাঁ এর প্রতি দিল্লীর বাদশাহগণের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় এবং পরবর্তী তিন শতাব্দী এটি বাংলার রাজধানী হিসেবে বলবৎ থাকে। মুসলমানরা নগরীটিকে এমন ভাবে গড়ে তোলে যে হিন্দু জনগোষ্ঠী বসবাসের কেবল কতিপয় নিদর্শন অবশিষ্ট রয়ে যায়। পানাম এর বিধ্বস্ত মন্দির ও শাহী কড়োরী নামক দালান এর মধ্যে পড়ে।

blank
মুসলমান শাসনকালে সোনারগাঁ এর রাজত্ব ছিল অনেকটা হযবরল অবস্থার মত। সম্রাট আলাউদ্দিনের শাসনকালে বাংলাকে দুইভাগে ভাগ করে পূর্বাংশের রাজধানী স্থাপিত হয় সোনারগাঁয়। বাহাদুর খান এ অঞ্চলের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। আলাউদ্দিন এর মৃত্যুর পর মোবারক শাহের সিংহাসনারোহণের ফলে বাহাদুর খান বাদশাহের অধীনতা অস্বীকার করেন, নিজের নামে মুদ্রা প্রস্তুত করেন ও পরবর্তী পঁচিশ বছর নির্বিঘ্নে রাজত্ব করেন। তবেঁ সম্রাট তোগলক খাঁ সিংহাসনে আরোহণের পর বাহাদুর খানকে শায়েস্তা করার জন্য সোনারগাঁ পথে যাত্রা করেন। ফলে তিনি সম্রাটের নিকট বশ্যতা স্বীকার করেন। সোনারগাঁ এর শাসন অবস্থার পট পরিবর্তন ছিল নিয়মিত ঘটনার মত। এর পর আরো শাসক যেমন ব্রাহাম খান, ফখরুদ্দীন, আলী মুবারক, হাজী ইলিয়াস বা শামসুদ্দীন, সেকান্দার শাহ প্রমুখ। বিশ্বাসঘাতকতা ও কুচক্রান্তের মাধ্যমে সিংহাসন লাভই ছিল এ সকল শাসকগণের মূলমন্ত্র। যদিও এঁদের মধ্যে শামসুদ্দীনের কাহিনী বেশ উদ্দীপক। তার বিদ্রোহকালে সম্রাট ফিরোজ শাহ তাকে বশ্যতা স্বীকার করানোর জন্য সোনারগাঁ আসেন কিন্তু চতুর শামসুদ্দীন বানার নদীতীরস্থ একডালা দুর্গ অবরোধ করে বসে রইলেন। এটি ছিল রাজ্যের সর্বেপেক্ষা শক্তিশালী দুর্গ। পাল রাজাদের আমলে নির্মিত এ দুর্গ মুসলিম আক্রমণে পাল শক্তি বিলুপ্ত হবার পর অবহেলিত অবস্থায় পড়ে থাকে। এর সম্মুখভাগে অবস্থিত তিনশত গজ প্রশস্ত এবং চল্লিশ ফুট গভীর নদীটি ছিল একটি মস্তবড় রক্ষাবূহ্য। এখানকার নদীর পাড় ভারতবর্ষের অধিকাংশ নদী থেকে আলাদা ধরণের। পানি থেকে অকস্মাৎ পাড়টি খাড়া হয়ে উপরে উঠে গেছে। নদীতে পানি যখন কম থাকে, তখন পাড়টি ঠিক একটা দেয়ালের মত মনে হয় এবং তা বেয়ে উঠা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এর বহিঃ প্রাকারটি অর্ধ চন্দ্রের মত এবং প্রায় দুই মাইল দীর্ঘ। চারদিকে প্রশস্ত পরিখা, এর মধ্যে দ্বিতীয় রক্ষাবূহ্য, দুর্গ, প্রাচীর এবং গম্বুজের ভগ্নাবশেষ। দূরে জংগলাকীর্ণ উচ্চভূমি ও অসংখ্য সংকীর্ণ পথ। সম্রাট বাহিনী বহুদিন একডালা দুর্গ অবরোধ করে রইলেন কিন্তু সুবিধা করতে পারলেন না। বর্ষা চলে আসলে এ অঞ্চলে আটকা পড়তে হবে ভেবে ফিরোজ শাহ অবরোধ উঠিয়ে নিলেন। ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দে শামসুদ্দীব মৃত্যুবরণ করলে ফিরোজা শাহ ফের সোনারগাঁ অভিমুখে রওনা হলেন কিন্তু শামসুদ্দীনের পুত্র সেকান্দার শাহ পিতার মত একই পদ্ধতি অবলম্বন করে দুর্গমধ্যে প্রবেশ করলেন। ফিরোজ শাহ পুনরায় ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান।

এরপর সামান্য কয়েক বছর দেশে শান্তি ছিল। সেকান্দার শাহ তখন পান্ডুয়ায় রাজধানী স্থাপন করে ব্যস্ত রইলেন। কিন্তু ফের শুরু হল ষড়যন্ত্র। সেকান্দার শাহের দুই পত্নী ছিলেন। প্রথম বেগমের সাত সন্তান ও দ্বিতীয় জনের গর্ভের একমাত্র গিয়াসউদ্দীন জন্মগ্রহণ করেন। সুলতান সকল সন্তানের মধ্যে গিয়াসউদ্দীনকে সবচেয়ে ভালোবাসতেন। বিমাতার ষড়যন্ত্রে গিয়াসউদ্দীন এক পর্যায়ে ভীত হয়ে সোনারগাঁ পলায়ন করেন এবং প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। প্রাণপ্রতিম পুত্রের কৃতঘ্নতায় সুলতান ক্ষীপ্ত হয়ে পুত্রকে শায়েস্তা করতে অগ্রসর হন। গোয়ালপাড়ায় উভয়পক্ষ মুখোমুখি হয় যদিও গিয়াসউদ্দীনের নির্দেশ ছিল তার পিতার কেশাগ্রভাগ ও যাতে স্পর্শ না করা হয়। যুদ্ধের ময়দানে পিতা আহত হলে গিয়াস দ্রুত পিতার শিবিরে ধাবিত হলেন মুমূর্ষু পিতার শয্যার কাছে গিয়ে অনুশোচনায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। অত:পর পিতার মৃত্যূর পর তিনি পান্ডুয়ায় ধাবিত হন এবং সেখানে পৌছেই একটি নৃশংস কাজ করেন তিনি। বৈমাত্রেয় ভাইদের চোখ উৎপাটিত করে রেকাবিতে সাজিয়ে তাদের মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। অথচ এই গিয়াসউদ্দীনই ন্যায়পরায়ণ ও আদর্শ শাসকরুপে ইতিহাসে কীর্তিত। কাব্যোৎসাহী এই গিয়াসউদ্দীনের সাথেই কবি হাফিযের অত্যন্ত সখ্যতা ছিল। সোনারগাঁ তে পানামের উপকণ্ঠে জীর্ণ দশায় আজ ও গিয়াসউদ্দীনের কবর রয়েছে।
তারপরের ঘটনাসমূহের নথীপত্রে তেমন বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায় না। দিল্লীর নসনদে পরাক্রমশালী মোগল শক্তির আগমন, আফগান শক্তির ফের অভ্যুত্থান আবার পতন সব মিলিয়ে বাংলার রাজধানীও প্রভাবিত ছিল। পরবর্তী উল্লেখযোগ্য ও সর্ব পরিচিত ঈসা খাঁ সম্পর্কে লিখিত আছে বিবিধ আকারে। ঈসা খাঁ হিন্দু ধর্মাবলম্বী কালীদাস গজদানীর পুত্র ছিলেন বলে কথিত আছে। কালীদাস গজদানী একজন মুসলিম মনিষীর সাথে ধর্মীয় বিতর্কে পরাজিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। ঈসা খাঁ ছিলেন দুঃসাহসিক, অল্পবয়সেই বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদ রায়ের বিধবা কন্যা সোনার সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করে ফেলে। সোনাকে পাওয়ার পথে ধর্মীয় বাধা ছাড়া আরেকটি ব্যাপার ছিল সোনার বৈধব্য। কিন্তু ঈসা খাঁ শক্তি বলে তাকে জয় করে নিয়ে এলেন কলাগাছিয়া দুর্গে। সোনার ঈসা খাঁর শৌর্য ও বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে মালা বদল করলেন ও স্বামীর ধর্ম গ্রহণ করলেন। ঈসা খাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রী সোনাবিবিই স্বামীর ঐতিহ্যকে অম্লান রাখার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন।
যেসব ঘটনা সোনারগাঁ এর ইতিহাসে যবনিকা টেনে আনে তার মধ্যে সোনাকুণ্ডার পতন অন্যতম। ভবঘুরে পর্তুগীজরা মগদের শিখিয়ে দিল নদীপথে আক্রমণের কলাকৌশল। মগদের আক্রমণের জন্য সোনারগাঁ একটি সুবিধাজনক স্থানে পরিণত হয়েছিল। ক্রমাগত অরাজকতায় বিধ্বস্ত সোনারগাঁ থেকে ইসলাম খাঁ বাংলার রাজধানী বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে সরিয়ে আনলেন।

সোনারগাঁর গৌরবকালে পঞ্চ পীরের মাজারের জন্য এটি স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে ছিল।এখানে জঙ্গলের মধ্যে ছিল পোনাকী দরবেশ এর মাজার। কিংবদন্তী মতে আল্লাহর পথে জীবন যাপনের জন্য তিনি বারো বছর ধ্যানমগ্ন ছিলেন। তার ভক্তগণ বহুদিন তাকে খুঁজে না পেয়ে অবশেষে একদিন দেখতে পায় তার আসনের চারদিকে গলা পর্যন্ত উইপোকার ঢিবি গড়ে উঠেছে। পরে সে ঢিবি ভেঙে তাকে বের করা হয়। আরো আছে পাগলা পীরের কিংবদন্তী। যিনি সকল চোরকে একটি দেয়ালে বেধে তাদের মাথা কেটে ফেলেন, তারপর মুণ্ড গুলোকে মালার মত করে একটি খালে ফেলে দেন। সেই থেকে খালটি মুণ্ডমালা নামে পরিচিত। সোনারগাঁ এর সুবিস্তারিত ইতহাসের মধ্যে এ কয়েকটি ঘটনাই কেবল ইতিহাসে প্রোথিত আছে। তবেঁ চমকপ্রদ রঙ্গমঞ্চের পটভূমি ছিল একদা বাংলার রাজধানী সোনারগাঁ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।blank