হরর-কমেডি গল্প “কুলফি” ও বাবার অতৃপ্ত আত্মা

ঐ-তো কুলফি-ওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে।

ভীষণ রোদ, ছাতি ফেটে যাবার মত অবস্থা। এসময় একটা কুলফি খাওয়াই যায়। শশাঙ্কের মনে এই ভাবনা এসেও পরক্ষণেই উবে গেল।

অনেক দূর থেকে হেঁটে আসছে সে, সেই নতুন গঞ্জ। মানুষ যেখানে ভ্যানে আসে, সে আসছে হেঁটে। ভীষণ ঘামছে সে, ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় একটা ঠাণ্ডা কুলফি খাওয়ার লোভ দোষের কিছু নয়, বরং সাধারণের জন্য তাই স্বাভাবিক।

কিন্তু শশাঙ্ক সাধারণের মধ্যে পড়ে না। কৃপণতার জন্য তাদের বণিক পরিবার শুধু এ গাঁয়ে নয়, আশেপাশের দশ গাঁয়েও সুপরিচিত। আর শশাঙ্ক হল সেই পরিবারের বর্তমান কর্তা যোগেশ্বর বণিকের একমাত্র সন্তান। অর্থাৎ, বণিক পরিবারের ভবিষ্যৎ কর্তা। তাই একটি দু’পয়সা দামের কুলফি খাওয়ার ইচ্ছে তার জন্য নিষিদ্ধই বটে, এমনকি এই অভিপ্রায়ের কারণে তার পরিবার হতে বিতাড়নেরও যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে।

তাই ইচ্ছেটা দমনের জন্য কয়েকবার হাঁটার গতি বাড়িয়ে চলার চেষ্টা করল শশাঙ্ক। কিন্তু পা যে চলছেই না! তারপরও কুলফি-ওয়ালাকে পেরিয়েই যাচ্ছিল প্রায়, কিন্তু যাওয়ার সময় বুকটা কেমন জানি হাহাকার করতে লাগল। শেষমেশ আর ইচ্ছেটাকে দমন করতে পারল না শশাঙ্ক।

‘দাদা, কুলফি কত করে?’ অমায়িক কণ্ঠে বলল শশাঙ্ক।
‘দু’পয়সা গো।’ কুলফি-ওয়ালা উত্তর দিল।

‘দাদা, এক পয়সায় দাও না। দেখছ না, কেমন নুয়ে পড়েছি। সেই নতুন গঞ্জ থেকে পায়ে হেঁটে আসছি। বুক যেন ফেটে চৌচির। কুলফি পেলে বেশ হয়। দয়া কর, দাদা। এক পয়সাতেই দাও।’ মিনতি করল শশাঙ্ক।

লোকটাকে এতক্ষণ চেনা চেনা লাগলেও ঠিক চিনতে পারছিলনা কুলফি-ওয়ালা। এই আব্দার শুনে সে বুঝতে পারল, এ বণিক-বাড়ির ছেলে না হয়ে যায়ই না!

টাকাপয়সার ব্যাপারে বণিক-বাড়ির সতর্কতা সম্বন্ধে এই কুলফি-ওয়ালাও বিলক্ষণ পরিচিত ছিল। ভীষণ গরমে শরীর জুড়োতে একটা কুলফি খাওয়া যে এই পরিবারের কাছে ব্রাহ্মণদের কুলীন ছোঁয়ার মতই নিষিদ্ধ, সেটাও সে জানত। তাই আজ যদি সেই পরিবারের কাছে এক খানা কুলফি গছাতে পারে, তাহলে সাত গাঁয়ে তার কুলফির নাম নিশ্চিতভাবেই ছড়িয়ে যাবে। সেই আশাতেই কুলফি-ওয়ালা এক পয়সাতেই রাজি হয়ে গেল।

এক পয়সাতে কুলফি কিনেও কিন্তু শশাঙ্ক খুশি হতে পারলনা। সে এই প্রথম দরাদরি করে কেনার স্বাদ হতে বঞ্চিত হল। তার সন্দেহ হতে লাগল, কুলফি কিনতে গিয়ে সে ঠকে গেল না তো? কুলফি-ওয়ালা সাথে সাথে এক পয়সায় রাজি হয়ে গেল, এ যে ভয়ঙ্কর ব্যাপার! শেষমেশ কি তাহলে একটা বাজে কুলফি গছিয়ে দিল তাকে?

এমন খচখচানি নিয়ে কুলফি খেতে মোটেও ভাল লাগে না। তাই শশাঙ্কের মনে হল, কুলফি খেতে কেমন যেন পানসে লাগছে।

বিমর্ষ মনে কুলফি খেতে খেতে পথ চলছিল শশাঙ্ক। হঠাৎ সামনে দেখল হরিকাকা আসছে। হরিকাকা তাদের বাড়ির একমাত্র ভৃত্য। হরিকাকাকে কেমন যেন বিষণ্ণ মনে হচ্ছে। চোখজোড়া যেন কাঁদতে কাঁদতে লাল হয়ে আছে। কোন একটা বিপদ হয়েছে বলে শশাঙ্কের আশঙ্কা হল।

‘কি হয়েছে, হরিকাকা?’ শুকনো কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল সে।
‘বড়বাবু আর নেইকো, ছোটবাবু,’ ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল হরিকাকা। ‘তোমাকে খবর দিতেই যে দাঁড়িয়ে আছি…’

এ কথা শুনে হাতের আধ-খাওয়া কুলফি ফেলে বাড়ির দিকে ছুটতে লাগল শশাঙ্ক। পথে গরম ধূলা উড়তে লাগল তার দৌড়ে।

২।।

বালিশে মাথা রাখা মাত্র চোখদুটো বুঁজে এল শশাঙ্কের। সকালে নতুন গঞ্জ থেকে হেঁটে আসার ক্লান্তির সাথে যোগ হয়েছে পিতার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ঝামেলা।

তাই বাবার কথা ভাবতে ভাবতেই অতল ঘুমে ডুব দিল শশাঙ্ক।

গভীর রাতে হঠাৎ এক শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল শশাঙ্কের। শশাঙ্কের মনে হল কেউ যেন বিলাপ করছে। শশাঙ্ক ভাবল, হরিকাকা হবে বোধহয়। তাই সে চেঁচিয়ে বলল, ‘এই রাত দুপুরে ফের কী শুরু করলে, কাকা?’

‘ওরে মর্কট, আমি তোর বাবা!’ উত্তর এলো।

আরে, এতো সত্যি তার পিতার গলা! শশাঙ্কের ঘুম ছুটে গেল মুহূর্তেই। ধড়মড় করে উঠে বসল সে। মেঝের দিক তাকিয়ে একেবারে থ হয়ে গেল সে।

মেঝেতে বসে কপাল চাপড়াচ্ছেন আদি ও অকৃত্রিম যোগেশ্বর বণিক স্বয়ং! সেই টিংটিঙে রোগা দেহ, খাড়া নাকের নিচে চিকন গোঁফ। পরনে সেই জরাজীর্ণ মলিন ফতুয়া, কমসে কম বিশ-তিরিশটা রিফু পাওয়া যাবে এই ফতুয়ায়। যোগেশবাবুর নিজের হাতে করা এই রিফুগুলো গত বিশ বছরের সাক্ষী। সবকিছু দিনের আলোর মত স্পষ্ট দেখছে শশাঙ্ক।

যে বাবার চিতায় আগুন সে নিজেই আগুন দিয়েছে, তাকে চোখের সামনে দেখে ভীষণ ভিরমি খেল শশাঙ্ক।

অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বলল, ‘বা-বা-বাবা, আপনি মারা যাননি?’

‘মরে যাই,এটাই তো চেয়েছিলি না! হারামজাদা, মরেও তো শান্তি পেলাম না। এজন্য অতৃপ্ত আত্মা হয়ে ঘুরছি। তোরা তো মুক্তিই দিলি না।’ আক্ষেপ করে বললেন যোগেশবাবু।

‘কেন বাবা?’

‘ওরে মর্কট, তোকে নিয়ে অনেক আশা করেছিলুম। ভেবেছিলুম তোর হাতে সংসারের দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে দেহত্যাগ করব। তা তুই হতে দিলি কই? তুই কিনা বেইমানের মত বেহিসাবি খরচ করছিস, অর্থ নাশ করছিস? সাতরাজার ধন পেয়েছিস? আমার রক্ত জল করে উপার্জন করা টাকায় ফুর্তি করছিস, অ্যাঁ?’ ক্রমাগত চেঁচাতে লাগলেন যোগেশবাবু।

পিতার এই অগ্নিমূর্তি দেখে প্রচণ্ড ভয় পেল শশাঙ্ক। ‘কে-কে-কেন বাবা, আমি কি করেছি?’

যোগেশবাবু যেন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, ‘খবর্দার, আমায় বাবা ডাকবিনে, এই আমি বলে দিলুম। তুই আমার কুলাঙ্গার সন্তান!’

শশাঙ্ক প্রায় কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘দোহাই আপনার বাবা, শুধু একবার বলুন আমি কী এমন করছি যে আপনি অসন্তুষ্ট হলেন। আমি তো কখনো আপনার অবাধ্য হইনি।’

‘কি আমার বাধ্য পুত্ররে! বাধ্যতার এই নমুনা দেখাচ্ছিস তুই?’ ব্যঙ্গ করলেন যোগেশবাবু।

গর্জে উঠলেন যোগেশবাবু, ‘মনে আছে, বলেছিলুম অযথা খরচ করবিনে, অপচয় করবিনে? মনে আছে, উল্লুক?’

‘আছে,’ মিনমিন করে বলল শশাঙ্ক।

‘কচু মনে আছে, শুয়োর। নইলে মা লক্ষ্মীর কৃপায় তিলে তিলে যে সম্পদ গড়লুম, তা একদিনে উড়িয়ে দিস! বংশের কথা একবারও ভাবলিনা, লম্পট!’

‘চাবকে তোমার পাছার ছাল ছিলে নেব, বদমাশ!’ যেন হুঙ্কার দিলেন যোগেশবাবু।

শশাঙ্ক প্রায় হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমায় ক্ষমা করুন বাবা। তবু একবার বলুন কি করেছি!’

যোগেশবাবু শ্লেষভরা কণ্ঠে বললেন, ‘লাটসাহেবের বাচ্চা হয়েছ? এক পয়সায় কুলফি কিনে অর্ধেকটা আবার ফেলে আসা হয়েছে, অ্যাঁ? পাঁঠা কোথাকার!’