ডিপ্রেশন জয় করা মেয়েটির সত্য গল্প ( পর্ব-১)

ছবি কৃতজ্ঞতা- রিমি শারমিন

আমার কীসের দুঃখ??? হ্যাঁ তাইতো। কীসের দুঃখ আমার মাথার ওপর ছাদ আছে।সাপোর্টিং ফ্যামিলি আছে। চাইলেই সব পেয়ে যাচ্ছি।তবুও কেন এত ডিপ্রেশনে থাকি আমি?……. “ধুর,ওসব ডিপ্রেশন ফিপ্রেশন কিচ্ছু নাহ।বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে তো। সবই অ্যাটেনশন পাওয়ার ধান্দা। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মায়ের ১০০% অ্যাটেনশন নিয়ে বড় হয়েছে। তাই সবার থেকেই ওইরকম অ্যাটেনশন আর আহ্লাদ আশা করে। সেজন্যেই এরকম একটা দুখী দুখী ভাব ফুটিয়ে রাখে সবসময়।সব স্রেফ দুঃখবিলাস।………. বিড়াল পোষে দুইটা। একটা আবার বিদেশী।ওর আবার কীসের কষ্ট?রাস্তায় কত মানুষ না খেয়ে আছে।পরনের কাপড় নেই।আর সে বিড়ালের পেছনে হাজার হাজার টাকা মাসে খরচ করছে।সে বলে তার কিনা অনেক কষ্ট।এসব ঢঙের মানে কি আমরা বুঝিনা???”

…….. আমি বলি আমার কষ্টটা ঠিক কোথায়। শারীরিকভাবে আমি সুস্থ।কিন্তু মানুষের মনেও যে অসুখ বাসা বাঁধে,”শরীরটা কেমন যেন লাগছে”র মত মনটাও ‘কেমন’ যেন লাগে এটা আমরা বুঝতে চাইনা কেন?আর সেই কেমন যেন লাগাটাই ডিপ্রেশন।এই ভাল তো এই খারাপ।অবশ্য বাংলাদেশের মত একটা দেশে যেখানে নুন আনতে মানুষের পান্তা ফুরায় সেখানে মনের অসুখ হওয়াটা একটা বিলাসিতা।কিন্তু নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দেশে মানুষ কি শুধুই শরীর নিয়ে জন্মায়????

ডিপ্রেশন অনেক কারণেই হতে পারে।হরমোনাল কারণে,চাওয়ার সাথে পাওয়ার হিসাবে ক্রমাগত গড়মিল হতে থাকলে,কিংবা ফ্যামিলির অবস্থা নড়বড়ে হলে।অস্বচ্ছল পরিবারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দরকারগুলো মেটাতেই সবাই ব্যস্ত থাকে,সেগুলো মেটেনা বলেই মনের দুঃখের শেষ নেই।তাই তারা ডিপ্রেশনে পড়লেও ব্যাপারটা আলাদাভাবে চোখে পড়েনা।স্বচ্ছল পরিবারের কেউ ডিপ্রেশনে পড়লে সেটাকে চালিয়ে দেয়া হয় ‘দুঃখবিলাস’ হিসেবে।আর গ্রামাঞ্চলে হলে ‘ভূতে ধরছে’,’জ্বীনে ধরছে’।মোটকথা,কোনভাবেই আমরা মেনে নিতে পারিনা যে মনেরও অসুখ হয়।সঠিক শিক্ষার অভাব। ডিপ্রেশনে পড়ে দুই দুইটা মানুষকে আমি আত্নহত্যা করতে দেখেছি।সাথে দেখেছি তাদের মৃত্যুর পর মানুষ কীভাবে তাদের ‘জাহান্নামী’ ট্যাগ দেয়।এমনকি এক ডাক্তারকেও বলতে শুনেছি,”এগুলা আজাইরা ঢং”।যে মানুষটার মন তার নিজের নিয়ন্ত্রণেই নেই,সেজন্যে সে ডাক্তার দেখাচ্ছে,ওষুধ খাচ্ছে,তার নেওয়া এতবড় সিদ্ধান্তকে আমরা এক নিমিষেই পাপের খাতায় ফেলে দেই।যেখানে কিনা নিজের জীবনই মানুষের সবচাইতে প্রিয়।আমরা বুঝতে চেষ্টা করিনা কোন অবস্থায় পড়লে সেই প্রিয় জিনিসটাকেই কেউ খরচ করে ফেলে।বড্ড বেশি কঠিন আমরা।

আমি নিজে একজন depression survivor।এখনো পুরোপুরি সেরে উঠিনি যদিও,তবু আগের চাইতে অনেক ভাল আছি।আমি হয়তো পেরেছি কারণ আমার পরিবার অনেক সাপোর্টিভ।আমার খারাপ দিনগুলোতে বাবা-মা আশেপাশের নেগেটিভ পরিবেশ থেকে আমাকে আগলে রেখেছে।কিন্তু কয়জন আমার মত ভাগ্যবান হয়?অনেকের বাবা-মাই বুঝতে চায়না এসব।কোথায় যাবে তখন সেই মানুষটা?একটু বোঝা উচিত সবার।সাহায্যের হাত না বাড়ালেও অন্তত কটুকথা শোনানো থেকে বিরত থাকা উচিত।

ডিপ্রেশন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আসে ফ্রাস্টেশনের সাথে।অনেকদিনের ব্যর্থতা,পারিবারিক অশান্তি এসব কারণ থেকেই ফ্রাস্টেশন বা হতাশার শুরু।নিজের অভিজ্ঞতায় যা মনে হয়েছে,এসব ক্ষেত্রে ওষুধের চাইতে কাউন্সেলিং ভাল কাজ করে।আর কাউন্সেলিং মানেই যে সবসমত প্রফেশনাল কারো কাছে যেতে হবে তা নয়।পরিবারের সদস্যরাই পারে অনেকখানি ভূমিকা রাখতে।আর বিপরীতভাবে,মানুষজনের বাঁকা কথাও ঠিক ততটাই মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। এরকম পরিস্থিতিতে মানুষের মন এমনিতেই অনেক সেনসিটিভ হয়ে যায়।তার উপর একটু ভালবাসা বা একটু খারাপ ব্যবহার দুটোই যাদুর মত কাজ করে।একটা ভাল যাদু।একটা কালোযাদু।এখন আপনারাই ঠিক করুন একটা মানুষের জীবনে সুয়োরানী হয়ে আসবেন নাকি দুয়োরানী হয়ে। আমি যেসব দিন পার করে এসেছি সেসব মনে পড়লে নিজেই শিউরে উঠি।আমি কখনো ভাবতেই পারিনি এতটা সুস্থ হয়ে উঠবো।

আমাকে আবারো স্বাভাবিক জীবনে আনার পেছনে সবচাইতে বড় ভূমিকা ছিল আমার মেডিকেল কলেজের একজন প্রাক্তন প্রফেসরের।ম্যাডামকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই।তিনি তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিলে আমি আজ এই লেখাগুলো লেখার জন্য বেঁচে থাকতাম কিনা জানিনা।জ্বী হ্যাঁ আমি একজন suicide attempt survivor ও। আমি জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো বয়সের বেশ আগেই অর্জন করে ফেলেছি।মানুষের ভালমানুষির মুখোশের আড়ালে আসল চেহারাটাও দেখা হয়ে গিয়েছে এই সুবাদে।একটা প্রবাদ আছে বাংলায়,”শিখেছো কোথায়?ঠেকেছি যেথায়’।হয়তো খুব বেশি শিখিনি তবে আগের মত জীবন সম্পর্কে একেবারে বকলমও রয়ে যাইনি।এই ডিপ্রেশন একদিক দিয়ে আমার কাছে একটা আশির্বাদ।নিজেকে ভেঙেচুড়ে নতুনভাবে গড়ার একটা প্রক্রিয়ার মত যেখানে এককালের ননীর পুতুল এই আমি জীবনের কঠিন বাস্তবতা দেখেছি।

লেখিকাঃ মেরিনা তানজিল। একজন ডিপ্রেশন সারভাইভার।মেডিকেল শিক্ষার্থী।শখের বশে টুকটাক লেখালেখি,আঁকাআঁকি আর এক্সপেরিমেন্টাল রান্নাবান্না চলে।ইচ্ছা ছিল পাইলট হবার।কিন্তু নানান কারণে আকাশে না উড়ে আজ তিনি মর্ত্যের মানুষের সেবায় আত্মোনিয়োগে নিজেকে তৈরি করতে ব্যস্ত।কুকুর-বিড়ালের প্রতি ভয়াবহ অবসেসড।ছোটবেলা থেকেই টেক্সট বুক বাদ দিয়ে অন্য বই পড়ার নেশাটাও মারাত্নক।বিশেষ করে মহাকাশ সংক্রান্ত।মাঝেমধ্যে ডাক্তারি বাদ দিয়ে মেকআপ আর্টিস্ট হবারও শখ জাগে।অথবা স্পেস সায়েন্টিস্ট হবার।