বুক রিভিউ- হুমায়ূন আহমেদের “মন্দ্রসপ্তক”

বইঃ মন্দ্রসপ্তক

ক্যাটগরিঃ উপন্যাস

লেখকঃ হুমায়ূন আহমেদ

প্রকাশকঃ সময় প্রকাশনী

প্রকাশকালঃ ১৯৯৩

পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৭৪

‘মন্দ্রসপ্তক’, এর অর্থ কি? কোন সন্দেহ নেই নামটা একটু অন্যরকম। যদি আভিধানিক অর্থ খুঁজি, তাহলে ‘মন্দ্র’ মানে মুদ্রা। সেটা নাচ বা গানের মুদ্রা হতে পারে; পয়সা বা টাকা কিন্তু বুঝায় না। অন্যদিকে, সপ্তক মানে সাত।  সারেগামার- র ‘সা’ যখন শুরু হয় সেটা উঁচুতে উঠতে থাকে। ‘সা’ শেষ হয় নিচের দিকে এসে। তারপর ‘পা’ শুরু। ‘সা’-র শুরু উপরে হয়ে নিচে এসে শেষ হয় এবং ‘পা’ শুরু হয়। এর মধ্যবর্তী সময়টুকু হল মন্দ্রসপ্তক। এটার অন্য একটা নামও আছে, তারাসপ্তক। এতখানি পড়ে এসে মনে হতে পারে, বই নিয়ে কথা বলতে এসে ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ কেন! বইটা যখন প্রথম আমার হাতে আসে, তখন মাথায় প্রথম যে চিন্তাটা আসে তা হল; মন্দ্রসপ্তক মানে কি? এই জন্য বই নিয়ে কথা শুরু করার আগে নাম নিয়ে একটু আলোকপাত করলাম। যদিও শুরুতেই বলে রাখি, উপন্যাসের কাহিনীর সাথে নামের দৃশ্যতঃ কোন মিল নেই। যদিও হুমায়ূন প্রিয় পাঠক মাত্রই জানবেন যে ওনার বেশিরভাগ উপন্যাসের নামই এমন। হয়তো কোন রবীন্দ্রসংগীতের লাইন বা অন্য কোন শব্দ। তবুও আমাদের তাঁর লেখার প্রতি আকর্ষণ কিন্তু এতটুকু কমে না। বরং আমি তো মনে করি, এটাই হল তার লেখার সৌন্দর্য। অন্যদের হতে একদম এতটাই আলাদা যে বইয়ের নাম দেখেই মনে হয় পড়ে শেষ করে ফেলি! তবুও পাঠক যদি নিগূঢ় চিন্তা ভাবনা করেন তো বই পড়ে উঠে মনে হবে, হ্যাঁ! উপন্যাসের নায়কের জীবনের মাঝামাঝি একটা মুহূর্ত লেখক হয়ত তুলে ধরতে চেয়েছেন।

উপন্যাস লেখকের আর অন্য উপন্যাসগুলোর মতই অত্যন্ত সাবলীল ভংগিমায় লেখা। কোন ভারী কথা নেই, নেই কোন অর্থহীন বা অর্থযুক্ত উপমা যা সাধারণ পাঠকের বোধগম্য নয়। গল্পের শুরু ঢাকা শহরের একটি বাড়ি হতে। যেখানে আছে আমাদের গল্পের নায়ক টুকু যে কি না ‘খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বি এ পাস’ করে এখন একটা ল’ এর ক্লাসে ভর্তি হয়েছে; আছে তার বোন মীরা, নীরা; দর্শন শাস্ত্রে রিটায়ার্ড করা অধ্যাপক বড় চাচা, ব্যাংকে মাঝারী গোছের চাকরি করা বাবা, পুরোদস্তুর গৃহিণী মা, ভিয়েনা থেকে পড়াশোনা করে আসা আই সারজন ছোট চাচা, চিররোগী ছোটচাচীআরেকটা খুব অদ্ভুত ও কিছুটা রহস্যময় চরিত্র হল ভোলাবাবু। যিনি নিজেকে একজন সন্ন্যাসী বলে দাবি করেন এবং কিছুকাল আগ অবধি যিনি নাঙ্গা সন্ন্যাসী হিসেবে ঘুরে বেড়ালেও বর্তমানে গেরুয়া কাপড়, চুলে জট ও গলায় রীতিমতন রূদ্রাক্ষের মালা পরে থাকেন। টুকুর সাথে প্রথম যেদিন দেখা হয় সেদিন সে টুকুকে জিজ্ঞাসা করে তার কাছে দেয়াশলাই কাঠি আছে কি না! কারণ হিসেবে ভোলাবাবু বলেন তিনি কান চুলকাবেন। সন্ন্যাসী টুকুকে ‘ব্রাদার’, বড় চাচাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করে। টুকুর মতে সন্ন্যাসী যদি “ওহে বৎস” বলে ডাকতেন তাহলেই ষোলোকলা পূরণ হতো। সম্বোধন শুনে টুকুর মনে হয়েছে যে তিনি আসল সন্ন্যাসী না। খুব সম্ভবতঃ খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল ঢুকবার মত সন্ন্যাসী পেশায়ও ভেজাল ঢুকে গেছে। গল্পের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ই এই লোককে আমাদের উপন্যাসের অন্যান্য প্রধান চরিত্রের সাথে দেখা যাবে।

পুরো উপন্যাস আবর্তিত হয়েছে টুকুদের এই বাড়ি ঘিরে; খানিকটা লেখকের অন্যান্য কিছু উপন্যাস যেমন- “বহুব্রীহি” বা  তাঁর “আজ রবিবার” নাটকে আমরা যেমন দেখতে পাই উপন্যাসের শুরু হয়েছে এভাবে; সকালে ঘুম থেকে উঠেই টুকু কিছুটা বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে পরে যায়। সে কখনোই বুঝতে পারে না তার নিজের ব্রাশ কোনটা আর বোনেদের ব্রাশ কোনগুলো! নিজের মনে করে প্রায়শই সে তার বোনেদের ব্রাশ নিয়ে ব্রাশ করে। এই নিয়ে টুকুর বক্তব্য , তার বোনেদের একই চিরুনী দিয়ে সে চুল আঁচড়ালে যদি সমস্যা না হয়, তাহলে ব্রাশ হঠাত ভুল হয়ে গেলে এই নিয়ে অশান্তি করবার কোন কারণ থাকা উচিত নয়। ঐদিন সকালটা টুকুর শুরু হয় তার দুঃসম্পর্কের মেজো খালুর মৃত্যু সংবাদ দিয়ে, যে খালুকে আর খালাকে তারা কেউই খুব একটা পছন্দ করে না! বাসায় সবাই যেহেতু খুব ব্যস্ত আর সে ই একমাত্র বেকার, তাই এসব মৃত্যু বাড়ীতে যেয়ে সামাজিকতা রক্ষা করার মত কাজ তারই করতে হবে। টুকুর মতে সে ‘ছাই ফেলতে ভাংগা কুলা’, সেইসাথে লোকজনের মতে খানিকটা বোকা। তবে এই নিয়ে তার কোন মাথাব্যাথাও নেই। রিমি; তার সেই দুঃসম্পর্কের মেজো খালুর মেয়ে যে সেশন জটে পড়ে এখনো বিশ্ববিদ্যাল্যয়ে অনার্স ৩য় বরষে আটকে আছে; সে মনে করে টুকুর এই বোকা বোকা থাকার ব্যাপারটা পুরোটাই ভান। টুকু আর রিমি খানিকটা বন্ধু, খানিকটা বন্ধুর চেয়ে বেশি। টুকুর মতে রিমি এমন একটা মেয়ে যাকে দেখলে মনে হয় গতকালের চেয়ে সে আজ আরেকটু সুন্দর হয়েছে, আরেকটু বেশি স্নিগ্ধতা নিজের মধ্যে ধারণ করেছে। টুকু রিমিকে কি পছন্দ করে! না, রিমি টুকুকে? সেটা পাঠক নিজেই পড়ার পরে বুঝতে পারবেন। এই নিস্তরঙ্গ মধ্যবিত্ত পরিবারে একটা ঢেউ আসে যখন ছোট চাচা হঠাত এটা ঘোষণা করেন যে, তিনি তার স্ত্রীর দেখাশোনা করার জন্য রাখা সমিতা নামের যে নার্স তাকে বিয়ে করবেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই কালো অথচ যার চোখ এতটাই মায়াময় যে দেখলে মনে হয় এর মাঝে কোন পংকিলতা নেই; সেই সমিতা নামের ডিভোর্সি মেয়েটি তার কন্যাকে নিয়ে টুকুদের বাসায় চলে আসেন। কন্যা লোরেটা গোমেজ ক্লাস থ্রীতে পড়ে আর টুকুর সাথে তার খুব বন্ধুত্ব হয়ে যায়। তারা দুজন ছাদের ঘরে বসে গল্প করে, টুকু তাকে ঘুম পারায় আর যখন সে রিমির কথা লোরেটা কে বলে; লোরেটা অবিকল বড় মানুষের মত বলে, “উনি তোমাকে অনেক পছন্দ করেন টুকু।“ এভাবে একটা সাধারণ পরিবারের অনেক ঝামেলা- বিপত্তির আর দৈনন্দিন কথকতার কথা বলতে বলতে উপন্যাস সামনে এগিয়ে যায়। একদিন যেভাবে হুট করে ঝামেলা শুরু হয়েছিল, সেভাবে হুট করে শেষ ও হয়ে যায়।  ঝামেলা একেবারে শেষ করার অংশ হিসেবে, লোরেটা নামের টুকুর ছোট্ট বন্ধুও একদিন তার কাছে হতে চলে যায়। বিদায় মুহূর্তে বন্ধুর খুব মন খারাপ দেখে লোরেটা টুকুকে জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমার কি মন খারাপ!’ টুকু মাথা নাড়তেই হঠাত লরেটা বলে, “আমি যখন বড় হব আমি তোমাকে বিয়ে করব।“ এটাও জানাতে ভোলে না যে টুকুর তাকে খোঁজা লাগবে না; বড় হয়ে সে নিজেই খুঁজে বের করবে টুকুকে। টুকুর মন অসম্ভব খারাপ হয়ে যায়এই বাচ্চামেয়েটা একটা স্বাভাবিক পরিবারে বড় হবার সুযোগ পেল না। আর এই ঘটনার পরেই লেখক তাঁর স্বভাবসুলভ একটা রহস্য তৈরি করেনকাকতালীয় ভাবে ঐদিন আর ঐমূহুরতেই লরেটা চলে যাবার পরপরই টুকুর ভোলাবাবুর সাথে দেখা হয়ে যায়সন্ন্যাসী একটা ভবিষ্যৎবাণী করে ফেলেন। টুকুকে সে বলে, তার জীবন খুব কষ্টে কাটবে আর সতেরো বছর পর তার বিবাহ হবে। তবে এরপরে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে। যে কন্যার সহিত টুকুর বিবাহ হবে সে কম করে হলেও বিশ বছরের ছোট  হবে তার থেকে। টুকু এতদিন সন্ন্যাসীর একটা কথায় কান না দিলেও ঐ পরিস্থিতিতে একথা সে শুনে চমকে যায়! মেয়েটা কে হবে! লোরেটা! নাকি অন্য কেউ!

মন্দ্রসপ্তক উপন্যাস আসলে কিসের গল্প! পারিবারিক? দুজন সমবয়সী ছেলেমেয়ের খানিকটা ধোঁয়াশা ভালোলাগার কাহিনী? নাকি, একটা অসম সম্পর্কের ইংগিত? পাঠক হয়ত প্রিয় লেখকের পরবর্তী জীবনের ছায়া খুঁজে পাবার প্রচেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু, সবমিলে এটা খুব সুন্দর একটা উপন্যাস যা আপনি এক নিঃশ্বাসে পড়ে উঠতে পারবেন। শীতের বিকেলে এককাপ ধোঁয়া ওঠা গরম কফি বা গভীর রাতে লেপ এর নিচে শুয়ে পড়তে মন্দ লাগবে না আশা করি। প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ স্যারের রসবোধ, সহজিয়া লেখনী, কাহিনীর সাবলীল ভংগিমা আপনাকে আরেকবার মুগ্ধ করবেই। পড়ে না থাকলে আর এজাতীয় উপন্যাস পছন্দ করলে দ্রুত পড়ে ফেলুন সময় করে।  

লেখিকা সম্পর্কেঃ নাহিদ জাহান মুনা । ডাক্তারি পড়তে গিয়ে পলিটিক্স পড়তে চলে এসেছি এবং অত্যন্ত সৌভাগ্যের সাথে ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক’ নামক একটা ভয়াবহ রসকষহীন সাবজেক্ট থেকে পোস্টগ্রাজুয়েশন শেষ করে ফেলেছি। বই পড়া, মুভি দেখা, ঘুরাঘুরি করা ভাল লাগে। বই পড়তে পড়তে বাসায় একটা ছোটখাটো লাইব্রেরি বানিয়ে ফেলেছি। লেখার অভ্যাস কখনোই ছিল না। তারপরও শুরু করে ফেলেছি সাহস করে।