অনুপ্রেরণার দুই গল্প

১। অসহায় ভালবাসা এবং অবহেলিত সময়ঃ

একদা সব অনুভূতিরা মিলে ছুটি কাটানোর জন্য, একসাথে একটি উপকূলবর্তী দ্বীপে বেড়াতে গেল । সব অনুভূতিরা তাদের মত করে ছুটি উপভোগ করছিল । এমন সময় হঠাৎ এটা ঘোষণা করা হল যে, একটি ভয়ংকর ঝড় ধেয়ে আসছে উপকূলের দিকে এবং সবাইকে দ্বীপ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয় ।

এই ঘোষণায় চারিদিকে আতংক ছড়িয়ে পড়ল এবং সবাই ছুটে চলল নৌকার দিকে । এমনকি সেখানে যত নস্ট আর ভাঙ্গাচোরা নৌকা ছিল সেগুলোকেও মেরামত করা হল খুব দ্রুত ।

কিন্তু অন্যসব অনুভূতির মত ভালবাসা এত দ্রুত পালিয়ে যেতে চাইছিল না । কারন সেখানে আরও অনেক কিছু দেখার ছিল,করার ছিল । কিন্তু এর মধ্যে আকাশ আরও কাল হয়ে এল,ঝরো হাওয়া বইতে লাগল । ভালবাসা তখন বুঝতে পারল যে এখন যাওয়ার সময় হয়েছে । কিন্তু তখন সেখানে আর কোন নৌকা অবশিষ্ট ছিল না যাওয়ার জন্য । তখন ভালবাসা সাহায্যের জন্য চারিদিকে তাকাতে লাগল ।

তখন ভালবাসা দেখতে পেল যে, সমৃদ্ধি একটা বিলাশবহুল নৌকা নিয়ে যাচ্ছে ভালবাসার সামনে দিয়ে । ভালবাসা তখন চিৎকার করে সমৃদ্ধিকে বলতে লাগল “ সমৃদ্ধি, তুমি কি আমাকে তোমার নৌকায় নিবে”? সমৃদ্ধি বলল, “না”, আমার নৌকা অনেক দামী দামী সোনা,রুপায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে । তাই এখানে তোমাকে নেয়ার মত কোন জায়গা নেই” ।

এর কিছুক্ষন পরেই অহংকার এলো খুব সুন্দর একটা নৌকায় চড়ে । অহংকারকে দেখে ভালবাসা বলল, “অহংকার তুমি কি আমাকে সাহায্য করতে পার”? আমি অসহায় হয়ে পড়েছি এবং আমার সাহায্য প্রয়োজন । দয়া করে আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও” । তখন অহংকার অহমিকার সূরে বলল, “আমি তোমাকে আমার সুন্দর নৌকায় তুলে নিতে পারব না কারন তোমার পায়ের কাঁদা দ্বারা আমার সুন্দর নৌকা নস্ট হয়ে যাবে” ।

কিছুক্ষন পরেই ঐদিক দিয়ে দুঃখ নৌকা নিয়ে যাচ্ছিল । তখন দুঃখকে দেখে ভালবাসা আবারও সাহায্য চাইল । কিন্তু এতেও কোন কাজ হল না । দুঃখ বলল, “ না” আমি তোমাকে আমার সাথে নিতে পারব না । কারন আমি এখন খুব কস্টের মধ্যে আছি । আমি আমার সাথেই একা থাকতে চাই”।

তার কয়েক মিনিট পর সেখান দিয়ে সুখ নৌকা নিয়ে যাচ্ছিল, তখন আবারও ভালবাসা তাকে সাহায্যের জন্য বলল । কিন্তু সুখ এত বেশি সুখি ছিল যে সে চারপাশে কি হচ্ছে তা দেখার প্রয়োজনবোধ করল না, এমনকি কোনকিছুতে সে ততটা মনোযোগও দিতে পারল না ।

যখন ভালবাসা কারও কাছে থেকেই সাহায্য পাচ্ছিল না তখন সে ধীরে ধীরে মনমরা হয়ে যেতে লাগল এবং অস্থিরতা কাজ করতে শুরু করল তার মধ্যে ।

এর মধ্যেই যখন ভালবাসা সমস্ত আশা ছেড়ে দিতে যাচ্ছিল তখনই হঠাৎ সে শুনতে পেল, “ ভালবাসা এদিকে এসো ; আমি তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাব”। যদিও ভালবাসা জানত না যে কে এই মহানুভব যে তাকে এই বিপদের সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ।কিন্তু সে সময় নষ্ট না করে নৌকায় উঠে গেল এবং সে নিরাপদে নিরাপদ যায়গায় পৌঁছে গেল ।

নৌকা থেকে নামার পর,ভালবাসার সাথে জ্ঞানের দেখা হল । অবাক হয়ে ভালবাসা জ্ঞানকে জিজ্ঞাসা করল, “ জ্ঞান তুমি কি তাকে চেন ? যে আমাকে খুব সহানুভূতির সাথে সাহায্য করেছে,যখন কেউ আমাকে সাহায্য করতে চাইছিল না” ।

তখন জ্ঞান হেসে বলল, “ ওহ ! সেটা ছিল সময়, যে তোমাকে সাহায্য করেছিল” ।

তখন ভালবাসা অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করল, “ কেন সময় আমাকে তুলে নিল এবং নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দিল”?

জ্ঞান এবার খুব গম্ভীরভাবে হেসে বলল, “ কারন একমাত্র সময়ই জানে তোমার সত্যিকারের পরিচয় এবং তুমি কি কি করতে সক্ষম । কারন সময় জানে যে, একমাত্র ভালবাসাই পারে পৃথিবীতে শান্তি আর সুখ এনে দিতে” ।

সারমর্মঃ

এই গল্পটি আমাদের জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিককে তুলে ধরেছে । যেমন, যখন আমরা সম্পদ আর সমৃদ্ধির মাঝে থাকি তখন আমরা আমাদের ভালবাসাকে উপেক্ষা করি । যখন আমরা নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি তখন আমরা ভালবাসার কথা ভুলে যাই । এমনকি আমাদের সুখের সময় এবং দুঃখের সময় আমরা আমাদের ভালবাসার কথা ভুলে যাই । একমাত্র সময়ের মাধ্যমেই অর্থাৎ সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথেই আমরা আমাদের ভালবাসাকে উপলব্ধি করতে পারি । একসময় আমরা সম্পদ আর কথিত সুখের মধ্যে থেকেও অনুভব করতে পারি যে, আমাদের জীবনে সব থাকলেও সত্যিকারের ভালবাসা নেই ।

তাই সব থাকলেও আমাদের আশেপাশের সত্যিকারের ভালবাসা এবং আমাদের ভেতরের সত্যিকারের ভালবাসাকে আমাদের মূল্যায়ন করা প্রয়োজন । কারন একসময় হয়ত সব থাকবে কিন্তু সবকিছু অর্জন করতে গিয়ে আমরা যেই ভালবাসাকে অবহেলা করছি সেই অবহেলা পেয়ে হয়ত একসময় ভালবাসা আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাবে । তাই সবকিছুর মত আমাদের ভালবাসাগুলোকেও যত্ন করা প্রয়োজন ।

 

২। এক সংখ্যাটি আসলে কত বড়?

এক শীতের সকালে লী কুয়াশা ভেদ করে সমুদ্রের পাড় ধরে হেঁটে যাচ্ছিল সামনের দিক । কিছু দূর যাবার পর সে দূরে একজন মানুষকে দেখতে পেল যে কিনা একবার ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা উঠিয়ে নিচ্ছে তারপর সেটাকে আবার সমুদ্রের দিকে ছুঁড়ে মারছে ।

লী কৌতুহলী হয়ে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যেতে লাগল । সামনে এগোতেই সে দেখতে পেল যে একজন স্থানীয় লোক কিছু স্টারফিস কুঁড়িয়ে নিচ্ছে যেগুলো ঢেউয়ের সাথে সাথে এসে পাঁড়ে আটকে গিয়ে প্রান হারাচ্ছে । সে সেই স্টারফিসগুলোকে কুঁড়িয়ে কুঁড়িয়ে সমুদ্রে ছুঁড়ে দিচ্ছে । তখন অবাক হয়ে লোকটি সেই স্থানীয় অধিবাসীটিকে বলল, “তুমি কেন এমন করছ”?

স্থানীয় লোকটি উত্তর দিল যে, “আমি আটকে পড়া স্টারফিসগুলোকে আবার সমুদ্রে ফেরত পাঠাচ্ছি”  । লী বলল তা তো দেখতেই পাচ্ছি । কিন্তু কেন তুমি স্টারফিসগুলোকে সমুদ্রে ফেরত পাঠানোর জন্য এত কস্ট করছ? স্থানীয় লোকটি উত্তর দিল, “আমি যদি এদেরকে সাগরে নিক্ষেপ না করি তবে এখানে এরা অক্সিজেনের অভাবে মারা যাবে” ।

লী তখন বলল, এখানে এই সমুদ্র তীরে হাজার হাজার স্টারফিস প্রতিদিন এমন করে ঢেউয়ের সাথে ভেসে আসে । তুমি চাইলেও তো সবগুলোকে সাগরে নিক্ষেপ করতে পারবে না । আর এমন ঘটনা আরও হাজার হাজার সমুদ্র তীরে ঘটছে । তাই তোমার কি মনে হচ্ছে না যে এভাবে কিছু স্টারফিস সমুদ্রে ছুঁড়ে দিয়ে তুমি তেমন কোন পরিবর্তন আনতে পারবে না বা খুব বেশী স্টারফিসের জীবন তুমি বাঁচাতে পারবে না ”?

তখন স্থানীয় লোকটি একটু হাসল, তারপর ঝুঁকে আরেকটি স্টারফিস তুলে নিল এবং সাগরে ছুঁড়ে মেরে বলল, “এই একটা স্টারফিসের জীবনে তো পরিবর্তন আনতে পারলাম এটাই বা কম কি” ?

 

সারকথাঃ

আমরা সবাই আমাদের একার যত্ন এবং দায়িত্ব নিয়ে ভারগ্রস্থ থাকি । এবং এটা ভাবি যে আমরা যেহেতু একা সেহেতু আমরা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের বাইরে কিছু করতে পারব না বা করতে পারলেও তাতে বিশেষ কোন পরিবর্তন আসবে না । আমরা মাঝে মাঝে এটাও ভাবি যে, আমাদের খুব কমই করার আছে পরিবর্তন আনার জন্য ।

কিন্তু আমরা কখনও এটা হয়ত ভাবতে পারি না যে, হয়ত আমরা আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেস্টা বা দায়িত্ব দ্বারা পুরো পৃথিবী পরিবর্তন করে ফেলতে পারব না কিন্তু আমরা চাইলে হয়ত কোন একটা বিষয় বা ঘটনায় বা কোন একজন মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারি । এটাই বা কম কিসে ???

আমরা চাইলেই অন্তত পক্ষে একটা পরিবর্তন ঘটাতেই পারি । শুধু আমাদের ইচ্ছা থাকা দরকার । শুধু এই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা দরকার যে, “আমি একা কোন কিছুই পরিবর্তন করতে পারব না”।  এটা চিন্তা করা দরকার যে, “ হয়ত আমি পুরো পৃথিবী বদলে দিতে পারব না । কিন্তু আমি চাইলে পৃথিবীর কোন একটা ঘটনা, কোন একটা বিষয় বা কোন একজন মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারি”।