৭ টি প্রচলিত সাইন বা চিহ্নের পেছনের গল্প

Female hands giving red heart

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক ধরনের চিহ্ন ও প্রতীকের ব্যবহার করে থাকি।এসব চিহ্নের বা প্রতিকের ব্যবহার আমরা সবাই জানি।কিন্তু কোথা থেকে এই চিহ্নের বা প্রতীকের উৎপত্তি তা হয়ত অনেকেই জানি না।জেনে নেই কয়েকটি বহুল প্রচলিত চিহ্নের উৎপত্তি ও প্রথম ব্যবহার।

১। প্রশ্নবোধক চিহ্ন

প্রশ্নবোধক চিহ্ন কিভাবে আসলো তা নিয়ে বেশ কয়েকটি ব্যাখ্যা আছে। অনেকে বলেন ল্যাটিন শব্দ quaestio থেকে এই চিহ্ন এসেছে। এর বাংলা অর্থ হল তদন্ত।অনেকের ধারণা মধ্যযুগীয় বাদ্যযন্ত্রের স্বরলিপি থেকে এই চিহ্ন এসেছে।একটি প্রশ্ন শেষ করে তার পর স্বরভঙ্গি নির্দেশিত নামক প্রশ্ন চিহ্ন ব্যবহার করা হতো।অনেক লোককাহিনীতে আছে এই চিহ্ন এসেছে প্রাচীন মিসর থেকে। তারা বলেন একটি বিড়ালের লেজ থেকে প্রশ্নবোধক চিহ্ন এসেছে।

আবার একদল বিশ্লেষক বলে ইংল্যান্ডের পণ্ডিত এলকুইন প্রথম এই চিহ্ন ব্যবহার করে। তিনি চার্লেমাগনে আদালতে কর্মরত থাকার সময় যতি চিহ্নের ব্যবহার কিভাবে উন্নত  করা যাবে তা নিয়ে কাজ করেন। তার প্রশ্নবোধক চিহ্ন ছিল অনেকটা টিল্ড চিহ্নের মত এবং এটি নবম শতাব্দিতে ব্যাপক ভাবে প্রচলিত হয়েছিল।তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা ২০১১ সালে প্রকাশ করা হয়। পঞ্চম শতাব্দীর সিরিয়াক পাণ্ডুলিপি উপর ভিত্তি করে এই ব্যাখ্যা করা হয়। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এর  ডঃ চিপ কয়েকলি বিশ্বাস করে যে ‘উল্লম্ব ডবল বিন্দু’ বা ‘জাগওয়া এলায়া’ হল প্রশ্নবোধক চিহ্ন।এই চিহ্ন গ্রিক ও ল্যাটিন লিপিতেও  ব্যবহার করা হয়ছিল।এখন পর্যন্ত ‘জাগওয়া এলায়া’ হল ইতিহাসের প্রাচীন প্রশ্নবোধক চিহ্ন।

২। স্টপ সাইন

যুক্তরাষ্ট্রে অটোমোবাইল এর প্রথম দিনের প্রতিযোগিতায় একধরণের চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। একই বছর ১৯১৫  সালে প্রথম স্টপ সাইন ব্যবহার করে মিশিগানে বৈদ্যুতিক ট্রাফিক সিগন্যালে।প্রথম স্টপ সাইন ছিল ২ মিটার লম্বা ধাতুর পাত পিছনে সাদা পটভূমিতে কালো চিহ্ন। ১৯২৩ সালে মিসিসিপি ভ্যালি এসোসিয়েশন হাইওয়ে অধিদপ্তর কয়েক ধরনের নকশা জন্য নির্দেশিকা দেয়। বিপদের মাত্রার উপর ভিত্তি করে এসব চিহ্ন তৈরি করার নির্দেশ দেয়।রেল ক্রসিং এর জন্য ব্যবহৃত হয় বৃত্তাকার এবং অষ্টভুজ দিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্তরের বিপদ বোঝানো হয়।

প্রথম অষ্টভুজ স্টপ সাইনটি সাদা পটভূমিতে ছিল পরবর্তীতে তা হলুদে পরিবর্তন করা হয়। ১৯৩৫ সালে স্টপ সাইনকে রাস্তা ও সড়ক পথের জন্য ইউনিফর্ম ট্রাফিক কন্ট্রোল ডিভাইস একটি হলুদ পটভূমিতে  লাল বা কালো বর্ণ দিয়ে  ০.৬ মিটার (2 ফুট) অষ্টভুজ আকৃতিতে সংজ্ঞায়িত করে। ১৯৫৪ সালে উভয় রেলপথ এবং সড়ক পথের জন্য একটি কালার কোড সিস্টেম উদ্ভুত করা হয়।বিভিন্ন পুনর্বিবেচনার পর ১৯৭৮,১৯৮৮ এবং ২০০০সাল থেকে এখনও এই আকৃতিটি সাধারণভাবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।

৩। তীর চিহ্ন

তীর চিহ্ন প্রথম দিক নির্দেশক হিসেবে ব্যবহার করে প্রাচীন গ্রিকে। ১২ শতকে একটি স্থানীয় পতিতালয়ে দিক বোঝাতে এই চিহ্ন সাথে একটি মহিলার ছবি আঁকা ছিল। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গ্রিকরা মধ্যযুগে প্রথম মুদ্রায় এই চিহ্ন ব্যবহার করা হয়।তবে সেখানে দিক নির্দেশক হিসেবে ব্যবহার করা হয় নি।১৪ ও ১৫ শতকে ইতালিতেও এই চিহ্নের ব্যবহার শুরু হয়।কোন বিশেষ স্থানের দিক বোঝাতে এই চিহ্ন তারা ব্যাবহার করত।তবে ১৮ শতক পর্যন্ত এই চিহ্নের ব্যবহার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি।তীর চিহ্ন প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবহার করা হয় নদীর দিক নির্ণয়ে ১৯ শতকে।তখন থেকেই মানচিত্রে এই তীর চিহ্নের প্রচলন শুরু হয়।পরবর্তীতে গনিত যুক্তিবিদ্যায় তীর চিহ্নের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়।

৪। প্রস্থান চিহ্ন

প্রস্থান চিহ্ন বর্তমান বিশ্বে বহুল প্রচলিত একটি চিহ্ন। প্রস্থান চিহ্ন প্রধানত দুই রঙের হয়। লাল ও সবুজ রঙের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শব্দ,কোলাহলপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় লাল রঙের থাকে এই চিহ্ন ব্যাবহার করে।আর সবুজ রঙেরটা চিহ্ন দিয়ে নিরাপদ জায়গার প্রস্থান বোঝায়।১৯১১ সালে ম্যানহাটানের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে ১৪৬ জন শ্রমিক আগুনে পুড়ে মারা যায়।তখন থেকেই জ্বলন্ত ভবন থেকে বের হওয়ার দিক নিদর্শন সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা হয়।১৯৩০ এর দিকে প্রস্থান চিহ্নের আকৃতি নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা নিরিক্ষা করা হয়।জাতীয় ফায়ার সুরক্ষা এসোসিয়েশন (NFPA) এর বিল্ডিং ফায়ার সুরক্ষা এবং জীবনের নিরাপত্তা বিভাগের রবার্ট সলোমন মতে,১টি স্বীকৃত আন্তর্জাতিক প্রস্থান চিহ্নের প্রয়োজন যাতে সব ভাষাভাষীর লোকেরা বুঝতে পারে।একই সময়ে একটি জাপানি অগ্নি নিরাপত্তা সমিতি  নতুন করে জাতীয় জরুরী বহির্গমন সাইন জন্য একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে।এই প্রতিযোগিতায় ৩৩০০ জন অংশগ্রহণ করে।ডিজাইনার ইউকিয়ো ওটা জয় লাভ করে। বিশ্ব বাণিজ্য এবং জাপানি সরকার নিরীক্ষার জন্য এই নকশা জমা দেন আন্তর্জাতিক মান সংস্থায়।জাপানি নকশার অনুরূপ ছিল সোভিয়েতের নকশা।এই নকশা শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী গৃহীত হয়েছে।বর্তমানে সারা বিশ্বে দরজায় এই চিহ্ন ব্যাবহার হচ্ছে।

 

৫। ডলার চিহ্ন

সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত  ডলার চিহ্ন আসলে স্প্যানিশ পেসোর চিহ্ন ছিল।মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা মধ্যে যখন আকরিক খনির আধিপত্য স্প্যানিশ পেসোকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার “taler” ডাচ ‘daalder’ ও অন্যান্য জার্মানিক শব্দের গঠন প্রভাবিত ডলার শব্দটির উৎপত্তি।স্প্যানিশ পেসো শেষ পর্যন্ত ইউরোপ,আমেরিকা,দূরপ্রাচ্যে ব্যবসায় গৃহীত হয়েছিল।পেসোকে সংক্ষেপে বলা হতো ‘PS’।১৭৭০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই PS কে আরও সংক্ষেপ করে  শুধু ‘$’ এর মত করে নতুনভাবে লিখা শুরু করে তাদের মুদ্রার প্রতীক বানায়।আবার অনেকে দাবি করে রোমান মুদ্রা ছিল ‘HS’ যা থেকে ডলারের প্রতীকটি আসে।ডলার চিহ্ন উৎপত্তি সম্পর্কে অন্যান্য আরও অনেক প্রস্তাবিত তত্ত্ব  আছে।অ্যান রান্ড দাবি করেন এটা অক্ষর ‘U’ এবং “S” হল সমগ্র জাতির জন্য একটি প্রতীক,এটি একটি মুক্ত মন ও মুক্ত অর্থনীতির প্রতীক।আবার অনেকেই বলে প্রাচীন রূপার খনির মালিকরা অনেক আগে থেকেই এই চিহ্ন  মনোগ্রাম হিসেবে ব্যাবহার করতো।

৬। হার্ট সাইন

তুষারযুগের শেষের দিকে ক্রো-ম্যাগনন এ এই প্রতীকটি পাওয়া যায় কিন্তু মধ্যযুগের পূর্ব পর্যন্ত আধুনিক যুগের এই অর্থটি জানা ছিল না।উত্তর আফ্রিকার সিলফিউয়াম নামক একটি  উদ্ভিদ আছে যেটি জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম এবং দেখতে হৃদয় আকৃতির।তাই বিভিন্ন তর্কবিতর্কে জানা যায় প্রতীকটি সিলফিউয়াম উদ্ভিদের সাদৃশ্য।

অন্য একদল মানুষ দাবি করে প্রতীকটি মধ্যযুগে যীশু খ্রিস্টের বলিদানের প্রতিনিধিত্ব করে।১৪ শতাব্দীর আগে, “হৃদয় আকৃতি” “হৃদয়” শব্দের অর্থ সঙ্গে যুক্ত করা হয় নি।ডুমুর পাতা থেকে, এবং মধ্যযুগীয় লোগোতে এবং আইভি ও পদ্ম পাতা থেকে এই চিহ্ন এসেছিলো।১৫৪০ সালে জার্মানিতে তাসের মধ্যে হৃদয় চিহ্ন ব্যাবহার করে।

ঐতিহাসিকদের মতে ১৬০০ শতকের পূর্বে প্রতীকটি পরিচিতি হয় এবং এর ব্যবহার শুরু হয়।আবার অনেকেই বলে মধ্যযুগে মানুষের ভাবাবেগ বুঝতেও এই চিহ্ন ব্যাবহার হত।তখন এই চিহ্নের কাছাকাছি এক ধরনের চিহ্ন এঁকেছিল মধ্যযুগীয় চিত্রকররা। করত।১৭ শতকে ইংল্যান্ডে ভ্যালেন্টাইন্স ডে এর উত্থানের পর থেকে এই চিহ্নের ব্যাপক ব্যাবহার শুরু হয়।১৯ শতাব্দী থেকে এই প্রতীক প্রায়ই রোমান্টিক ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে  ভ্যালেন্টাইন্স ডে কার্ড, ক্যান্ডি বক্স জনপ্রিয় ও ব্যবহৃত হচ্ছে।

৭। গাণিতিক চিহ্ন

১৫ শতকে যোগ ও বিয়োগ চিহ্ন আবির্ভূত হয়।এই চিহ্ন মূলত ল্যাটিন ভাষা থেকে এসেছে।তবে অনেকের মতে ১৪ শতকে ‘+’ এর প্রথম ব্যবহার ব্যবহার করা হয়েছে।জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকল “+” চিহ্ন ব্যাবহার করে।এটি সোমালিয় স্বরলিপি থেকে এসেছে।”-” চিহ্ন ব্যাবহার করা হত জাহাজ থেকে মাল খালাস করে যে চিঠি দিত তাতে।আধুনিক বিভাজন চিহ্ন প্রথমে উত্তর ইউরোপের গণিতবিদদের দ্বারা বিয়োগ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।ইয়োহান  এবং ভেনডার এই দুই গনিতবিদ ১৫  শতেকে এই দুটি চিহ্ন  ব্যবহৃত করে ।১৫৫৭  সালে রবার্ট রিকারডো  ইংরেজি ভাষায় এই চিহ্ন চালু করে।বেশি বুঝাতে “+” ও কম বুঝাতে “-” চিহ্ন ব্যবহার করা হতো।

লেখিকাঃ ফাহমিদা নাসরিন।পেশায় শিক্ষক।ভাল লাগে বই পড়তে আর ঘুরে বেড়াতে।অবসর সময় কাটে ক্রাফটিং করে।