বাংলাহাবে এক সময় মানুষ ‘উদ্ভট’ ক্যাটাগরির লেখা বেশি খোঁজ করত। পাঠকদের চাহিদা মেটাতেই বিশ্বব্যাপী ঘটে যাওয়া নানা কাকতালীয় ঘটনা নিয়ে তিন পর্বের ‘কাকতাল সিরিজটি সাজাই। প্রথম দুই পর্বে আপনাদের ব্যাপক সাড়া পাওয়ায় আজ সিরিজের সর্বশেষ কিস্তিটি নিয়ে হাজির হলাম। আশা করি আগের দুই পর্বের মত এই পর্বটিও আপনাদের ভাল লাগবে।

নামের কেরামতি!

কথায় বলে- নামে কি আসে যায়! আসলেই কি কিছু আসে যায় না? চলুন দেখি তো!
প্রথম ঘটনাটি ১৬৬০ সালের। ডিসেম্বরের ৫ তারিখ ডুবো পাহাড়ের সাথে ধাক্কা লেগে একটি জাহাজ ডুবে যায়। এতে করে এক জন বাদে জাহাজটির আর সব যাত্রী মারা যায়। বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিটির নাম হাগ উইলিয়ামস
পরের ঘটনাটি ঘটে ১৭৬৭ সালের ডিসেম্বরের ৫ তারিখে। এবারও একই জায়গায় একটি জাহাজ ডুবে যায়। জাহাজে থাকা যাত্রী আর ক্রু মিলেয়ে ১২৮ জন মানুষের ভেতরে ১২৭ জনই প্রাণ হারায়। বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিটির নাম হাগ উইলিয়ামস!
১৮২০ সালের ৮ ই আগস্ট লন্ডনের থেমস নদীতে ডুবে আরেকটি জাহাজ। বরাবরের মত এইবারও কেবল মাত্র একজন যাত্রীই বেঁচে থাকে এবং বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিটির নাম যথারীতি হাগ উইলিয়ামস!
সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটে ১৯৪০ সালের ১০ই জুলাই। জার্মান গোলার আঘাতে এক ব্রিটিশ ট্রলার ধ্বংস হয়ে যায়। এই ঘটনায় ট্রলারের মাত্র দুজন মানুষ বেঁচে গিয়েছিলেন। গেস হোয়াট, তাদের দুজনেরই নাম ছিল হাগ উইলিয়ামস!
তাহলে দেখা যাচ্ছে, নামে অনেক কিছু আসে যায়! সৌভাগ্যবান একটা নাম আপনাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারে!

রাজার ছায়া

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকের ঘটনা। ইটালীর মনজা অঞ্চলের রাজা “উম্বারটো” একদিন তার দলবল নিয়ে এক রেঁস্তোরায় খেতে আসলেন। রাজাকে দেখে রেঁস্তোরার মালিক নিজেই অর্ডার নিতে আসেন। মালিককে দেখে রাজা অবাক হয়ে খেয়াল করলেন যে লোকটির চেহারা, শারীরিক গঠন, কন্ঠস্বর এই সবকিছুই প্রায়ই রাজার মতন। আগ্রহী হয়ে রাজা তার আরো খোঁজ নিলেন। এতে বেরিয়ে আসল অবিশ্বাস্য তথ্য। রাজা ও রেঁস্তোরার মালিক দুজনের জন্মই একই দিন – ১৪ই মার্চ ১৮৪৪। দুজনেই একই শহরে জন্মেছিলেন। দুজনেরই স্ত্রীর নাম ছিল মার্গারেট। রাজা যেদিন ক্ষমতালাভ করেন, সেই দিনই রেঁস্তোরাটি উদ্বোধন করা হয়েছিল। সবশেষে ২৯ জুলাই ১৯০০ সালে, রহস্যজনকভাবে গুলিতে নিহত হন রেঁস্তোরার মালিক। একই দিন এই খবর শুনে দুঃখ প্রকাশ করার সময় জনতার ভীড়ের মাঝে এক আততায়ীর ছোঁড়া তীরের আঘাতে রাজারও মৃত্যু হয়!

অলক্ষুণে দম্পতি!

বলছিলাম বার্মিংহামের জেসন ও জেনি কেয়ার্নস লরেন্স দম্পতির কথা। তারা যেখানেই বেড়াতে যান না কেন, বিপদ তাদের পিছু পিছু সেখানে পৌঁছে যায়! ইতিহাসের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তিন তিনটি সহিংস ঘটনার সাক্ষী তারা। তাদের চোখের সামনেই ঘটেছে ২০০১-এর ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা। পর পর দুটি বিমান আছড়ে পড়ে টুইন টাওয়ারে আর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে ভবন দুটি। মিশে যায় মাটির সাথে। আর এই পুরো ঘটনাটাই চাক্ষুস করেন সেখানে বেড়াতে আসা দম্পতি জেসন ও জেনি। টুইন টাওয়ারে ঐ সহিংস হামলার ঘটনায় মারা যান প্রায় ৪ হাজার মানুষ। এর মাত্র কয়েক বছর পর ২০০৫-এর জুলাইতে লন্ডনে ঘটে চাঞ্চল্যকর সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা। তিনটি টিউব ট্রেন ও একটি বাসে আত্মঘাতী সেই বোমা হামলাগুলোতে ৫২ জনের মৃত্যু হয়। সে ঘটনারও জীবন্ত সাক্ষী জেসন ও জেনি। এরপর ২০০৮-এর নভেম্বরে তারা ভারতে বেড়াতে আসেন আর মুম্বাইতে প্রত্যক্ষ করেন তাজ হোটেলে জঙ্গিদের নৃশংস হামলার ঘটনা। সেদিন জঙ্গীদের আক্রমণে মারা যান ১৬৪ জন, আহত হন প্রায় তিন শতাধিক।

জেসন ও জেনি কেয়ার্নস লরেন্স

পুনঃজন্ম!?

ফেরারী গাড়ি কোম্পানীর ফাউন্ডার এঞ্জো ফেরারী ১৯৮৮ সালের ১৪ই আগষ্ট মারা যান। এর ঠিক এক মাস পর অক্টবরের ১৫ তারিখ জন্ম নেন বর্তমান জার্মান ফুটবল দলের প্রাণ ভোমরা মেসুত ওজিল। দুজনের পাশাপাশি ছবি মিলিয়ে দেখুন। কি বলবেন একে? পুনঃজন্ম নাকি শুধুই কাকতালীয়?

বামপাশে এঞ্জো ফেরারী, ডানপাশে মেসুত ওজিল

মৃত্যুর পরেও নেই ছাড়!

এই লোকের কাহিনী যেন ঠিক দ্য কিউরিয়াস কেস অব বেঞ্জামিন বাটন মুভির সেই বুড়োটার মত যে কারো পায়ের আওয়াজ পেলেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিত- Did I ever tell you that I was struck by lightning for seven times?
মেজর সামারফোর্ড, ছিলেন ব্রিটিশ আর্মিতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বজ্রপাতের আঘাতে আহত হন, এক পা সাময়িক প্যারালাইজড হয়ে যায়। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে তল্পি-তল্পা গুটিয়ে কানাডায় চলে আসেন, এখানেই স্থায়ী হন। এক বসন্তে লেকে মাছ ধরার সময় আবার বজ্রপাত আঘাত হানে তার উপর। শরীরের ডান পাশ প্রায় অবশ হয়ে যায়। সুস্থ হতে সময় লাগে প্রায় দুই বছর। এক গ্রীষ্মের দুপুরে পার্কে হাঁটছিলেন তিনি। বলা নেই কওয়া নেই, হুট করেই আবার বজ্রপাত হল তার উপর! এবারের আঘাতটা মোটামুটি মারাত্মক ছিল। পুরো শরীরই তার প্যারালাইজড হয়ে যায়। ধুঁকে ধুঁকে আরো দুই বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। দুই বছর পর মারা যান। কিন্তু মৃত্যুর পরেও বজ্রপাত তাকে ছাড় দেয় নি! মৃত্যুর চার বছর পর তার সমাধির উপর আবার বজ্রপাত হয়, এতে সমাধির ফলক পুড়ে যায়!

 ঠিক এডগার এলান পো-র বইয়ের মত!

সাহিত্য ভালোবাসেন কিন্তু এডগার এলান পো-র নাম শুনেন নি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মার্কিন এই সাহিত্যিক ১৮৩৮ একটি বই লিখেন The Narrative of Arthur Gordon Pym of Nantucket নামে। উত্তাল সমুদ্রের বুকে চার নাবিকের বেঁচে থাকার সংগ্রাম নিয়ে ছিল বইটি। ঝড়ে পড়ে তাদের জাহাজ ডুবে যায়। একটা নৌকায় অল্প কিছু খাদ্য আর পানি নিয়ে তাদের টিকে থাকার সংগ্রাম শুরু হয়। কিন্তু এক সময় পানি আর খাদ্য সব শেষ হয়ে যায়। ক্ষিধের জ্বালায় টিকতে না পেরে এক সময় তারা বাধ্য হয়ে তাদের কেবিন বয়কে খুন করে তার মাংস খেয়ে বেঁচে থাকে। গল্পে অভাগা সেই কেবিন বয়ের নাম ছিল রিচার্ড পার্কার
এই বই প্রকাশের প্রায় ৪৬ বছর পর, ১৮৮৪ সালে ঠিক এইরকম একটি ঘটনা বাস্তবেও ঘটেছিল। Mignonette নামের একটি ডুবে যাওয়া জাহাজের চার নাবিক ছোট্ট একটি নৌকায় বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত হয়। অনেক দিন পার হয়ে যায়, কোন জাহাজ বা তীর- কিছুরই দেখা পায় না তারা। খাদ্যাভাবে প্রাণ ওষ্ঠাগত, ঠিক তখন সিনিয়র তিন নাবিক মিলে তাদের কেবিন বয়কে হত্যা করে তার মাংস খেয়ে নিজেদের প্রাণ বাঁচায়। গেস হোয়াট! বাস্তবেও সে অভাগা কেবিন বয়ের নাম ছিল রিচার্ড পার্কার!
রিচার্ড পার্কার নামের লোকেরা কি আসলেই দূর্ভাগা হয় নাকি এগডার এলান পো কোনভাবে ভবিষ্যত দেখতে পেয়েছিলেন!

টি২০ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ?

তবে কি ২০১৮ সালে সাউথ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিতব্য টি২০ বিশ্বকাপের ৫ম আসরের চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ? বাস্তবতা কি বলে জানি না, কিন্তু সংখ্যাতত্ত্ব তো এটাই বলে। সেই ২০০৯ সালে টি২০ বিশ্বকাপ শুরু হবার পর থেকেই এর প্রতিটি আসর অদ্ভুত এক প্যাটার্ন মেনে চলছে। আগের আসরের হোস্ট দলই পরের আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়। এখনো পর্যন্ত একবারও এই নিয়মের ব্যর্তয় ঘটেনি।
প্রথম আসর মানে ২০০৯ সালে হোস্ট ছিল ইংল্যান্ড। ২০১০ সালের দ্বিতীয় আসরে (ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপে) তারা চ্যাম্পিয়ন হয় এবং এখন পর্যন্ত এটাই ইংল্যান্ড দলের একমাত্র আইসিসি ট্রফি। তৃতীয় আসর মানে ২০১২ সালের শ্রীলঙ্কা বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় আগের আসরের হোস্ট ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২০১৪ সালের চতুর্থ আসরের (বাংলাদেশ বিশ্বকাপে) চ্যাম্পিয়ন যথারীতি আগের আসরের হোস্ট শ্রীলঙ্কা! তো হিসাব মতে ২০১৮ সালের সাউথ আফ্রিকা বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন তো ২০১৪ আসরের হোস্ট বাংলাদেশেরই হওয়ার কথা, তাই না?

পরবর্তী টি২০ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ!?

এই ছিল এইবারের পর্বের আয়োজন। তবে বিশ্বব্যাপী ঘটে চলা কাকতালীয় ঘটনার তালিকা কিন্তু মোটেও এত ছোট নয়, বরং বলা চলে দিনকে দিন তা আরো লম্বাই হচ্ছে! যদিও সিরিজটি এখানেই শেষ, কিন্তু তারপরেও কোন এক সময় হঠাৎ করেই উদ্ভট ঘটনার ঢালি সাজিয়ে আবারও হাজির হয়ে যেতে পারি!
শেষ করবো কাকতাল নিয়ে দুই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলে। আইনাষ্টাইন অদৃষ্টের কথা বলে গেছেন। বলেছেন- কাকতালের মাধ্যমেই স্রষ্টা নিজের অস্তিত্বের কথা জানান দেন। কিন্তু জন মেয়ার বলেছেন ভিন্ন কথা। বলেছেন- একদিন সব ঘটনারই ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। তার আগ পর্যন্ত না হয় হাসুন, কাঁদুন, মজা নিন আর মনে মনে আওড়ান ‘বিনা কারণে কিছুই ঘটে না’। আপনি কোনটা বিশ্বাস করবেন, সে সিদ্ধান্তটা না হয় আপনার জন্যই তোলা থাক!

প্রথম পর্বের লিংক, দ্বিতীয় পর্বের লিংক