আপনার কিডনি সুস্থ আছে তো?

কিডনি- মানবদেহের অতি প্রয়োজনীয় একটি অঙ্গ। দেহের রক্ত পরিশোধন করে বর্জ্য ও অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন, অম্ল ও ক্ষারের ভারসাম্য রক্ষা করা, হরমোন উৎপন্ন করা, খাবারের ভাইটামিনস ও মিনারেলসকে দেহের কাজে ব্যবহৃত হওষ়য়ার উপযোগী করে তোলা – এ সকল কাজের ভার আমাদের এক জোড়া কিডনির ওপরই ন্যস্ত থাকে। আর প্রায়শই এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি আমাদেরই অবহেলায় একটু একটু করে অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকে, যা হয়তো নিজেরাই টের পাই না। যখন টের পাই, ততদিনে হয়তো অনেক দেরি হয়ে যায়!

তো আসুন জেনে নিই দৈনন্দিন জীবনের এমন কিছু অভ্যাসের কথা, যা আমাদের অজান্তেই কিডনির ক্ষতি করে চলেছে।

১) প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়া:
●এতে থাকে অতিরিক্ত চিনি, যা স্থূলতার অন্যতম কারণ। আর স্থূলদেহীদের ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। এই দু’টি রোগ কিডনিকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে।
●প্রক্রিয়াজাত খাবারে লবণের পরিমাণও অনেক বেশি থাকে। লবণে আছে সোডিয়াম, যা রক্তচাপ বৃদ্ধি করে; ফলস্বরূপ কিডনির ক্ষতি হয়।

করণীয়:
●প্রক্রিয়াজাত খাবার কেনার আগে প্যাকেটের গায়ে লেখা উপাদানগুলো দেখে কিনুন।
●সফট ড্রিংকস, পরিশোধিত চিনিযুক্ত খাবার পরিহার করুন।
●ঘরে খাবার তৈরি করার সময়ও লবণ ব্যবহারে সতর্ক হোন। পাতে লবণ খাওয়ার অভ্যাস থাকলে তা বাদ দিন।

২) পর্যাপ্ত পানি পান না করা: শরীরের প্রয়োজনের চেয়ে কম পানি পান করলে কিডনি তার কাজ ঠিকভাবে করতে পারে না। শরীরের বিষাক্ত পদার্থগুলো সম্পূর্ণভাবে বের হয়ে যেতে পারে না। কিডনিতে পাথর হওয়ারও ঝুঁকি বেড়ে যায়।
প্রস্রাবের রং স্বচ্ছ বা হালকা হলুদ(খড়ের মত রং) না হয়ে যদি গাঢ় রংয়ের হয় এবং পরিমাণে কম হয়, তার একটি কারণ হতে পারে কম পানি পান করা।

করণীয়:
সুস্থ মানুষের জন্যে ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ১.৫ থেকে ২ লিটার বিশুদ্ধ পানি পান করা জরুরি। গরমের দিনে, কায়িক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করলে আরও বেশি পানি পান করা প্রয়োজন।
তবে যাদের ইতোমধ্যে কিডনির অসুখ আছে, তাদের ক্ষেত্রে পানির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের দরকার হতে পারে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি পান করতে হবে।

৩) দীর্ঘসময় বসে থাকা: যাদের দীর্ঘসময় বসে থেকে কাজ করতে হয়, লম্বা সময় ধরে ড্রাইভ করতে হয় বা যারা কায়িক পরিশ্রমে অভ্যস্ত নন, তাদের মধ্যে স্থূলতার ঝুঁকি অনেক বেশি। আর স্থূলতা থেকে উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং তা থেকে কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও বিরল নয়।

করণীয়:
●নিয়মিত ওজন মাপানো এবং উচ্চতা ও বয়স অনুযায়ী ওজন ঠিক আছে কিনা, তা লক্ষ্য রাখা।
●ওজন বেশি হলে খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ওজন স্বাভাবিকে নিয়ে আসা।

৪) ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবন:
●ধূমপানের ফলে কিডনি ও ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া, রক্তনালী শক্ত হয়ে যাওয়া এবং কায়িক পরিশ্রমের সামর্থ্য কমে যাওয়া সহ নানাবিধ শারীরিক অসুবিধা দেখা দেয়।
●অ্যালকোহল সেবনের ফলে শুধু যে লিভারের ক্ষতি হয়, তা নয় বরং অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন কিডনিকেও নষ্ট করে দিতে পারে।

করণীয়: ধূমপান ও অ্যালকোহল গ্রহণের বদভ্যাস থাকলে দ্রুত তা ত্যাগ করতে সচেষ্ট হোন।

৫) বেশিবেশি ব্যথানাশক ঔষধ সেবন: অনেকের মধ্যে অল্পতেই হুটহাট ব্যথানাশক ঔষধ খেয়ে ফেলার প্রবণতা থাকে। এতে ব্যথার কষ্ট উপশম হয়, সন্দেহ নেই। কিন্তু এসব ঔষধের overdose কিডনির অকল্পনীয় ক্ষতি করে ফেলে।

করণীয়:
●ব্যথানাশক ঔষধের অতিরিক্ত ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।
●চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ সেবন করবেন না।

৬) প্রস্রাব আটকে রাখা: দ্বিধা বোধ, ঝামেলা মনে করা কিংবা পাবলিক টয়লেটের অপ্রতুলতা, যে কারণেই হোক, সময়মত প্রস্রাব না করে তা আটকে রাখার প্রবণতা আমাদের অনেকের মধ্যেই রয়েছে। শরীরের বিষাক্ত পদার্থগুলো সময়মত বের না করে দেওয়ার এই প্রবণতা শরীরের জন্যে খুবই ক্ষতিকারক। এতে অস্বস্তিবোধ আর সংক্রমণ তো বটেই, কিডনির ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে কিডনি বিকল হতেও পারে। এছাড়া পরিণত বয়সে প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারার মত সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

করণীয়: অযথা প্রস্রাব আটকে রাখার অভ্যাস ত্যাগ করুন। আশেপাশে টয়লেট সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তা ব্যবহার না করে নিজের কিডনির ক্ষতি ডেকে আনবেন না।

৭) বেশি পরিমাণে মাংস খাওয়া: মাংসে রয়েছে প্রাণিজ প্রোটিন, যা রক্তে অ্যাসিডের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। ফলে অ্যাসিডোসিস দেখা দিতে পারে। এ অবস্থায় কিডনি দ্রুততার সঙ্গে অ্যাসিড বের করে দিতে পারে না এবং কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

করণীয়: প্রাণিজ প্রোটিন দেহের বৃদ্ধি ও ক্ষয় পূরণের জন্যে দরকারি। সুতরাং রোগবিশেষে চিকিৎসকের নিষেধাজ্ঞা না থাকলে প্রোটিন অবশ্যই খাওয়া উচিত, কিন্তু এর সঙ্গে অন্যান্য খাদ্য উপাদানগুলোরও যথাযথ ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।

৮) খাদ্যতালিকায় ভাইটামিনস ও মিনারেলসের ঘাটতি:
ভাইটামিন বি সিক্স ও ম্যাগনেসিয়াম কিডনির জন্যে উপকারী। ভাইটামিন বি সিক্স ক্যালসিয়াম অক্সালেট তৈরিতে বাধা দেয় এবং ম্যাগনেসিয়াম প্রস্রাবে অক্সালেটের পরিমাণ হ্রাস করে। ফলে কিডনিতে পাথর তৈরি হওয়া প্রতিরোধ হয়।

করণীয়:
●খাবারে ভাইটামিন বি সিক্স ও ম্যাগনেসিয়ামের উপস্থিতি নিশ্চিত করুন।
●ভাইটামিন বি সিক্স পাওয়া যায় মাছ, মুরগির মাংস, আলু, বেগুন, পালংশাক, ব্রকোলি, তরমুজ প্রভৃতি খাবারে।
●বীজ জাতীয় খাবার (তিলের বীজ, কুমড়া বীজ, সূর্যমুখী বীজ), মাছ, ডিম, দই, মিষ্টি আলু, কলা, পেস্তাবাদাম প্রভৃতি খাবার ম্যাগনেসিয়ামের চাহিদা পূরণ করে।
●তবে এদের মধ্যে কোনোটি খাওয়ার ব্যাপারে আপনার চিকিৎসকের নিষেধাজ্ঞা থাকলে, সেটি খাওয়া এড়িয়ে চলবেন।

৯) পর্যাপ্ত না ঘুমানো: মানুষের কিডনির শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ তার ঘুম ও জেগে ওঠার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিচালিত হয়। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে, পর্যাপ্ত ঘুম না হলে এই নিয়ম বিঘ্নিত হয়। ফলে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া ঘুম কম হলে কিডনির কোষ পুনর্গঠন হতেও অসুবিধা হয়।

করণীয়: প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যান এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমোন। খুব বেশি ঘুম এবং খুব কম ঘুম- দু’টোই শরীরের জন্যে ক্ষতিকর।

১০) জীবাণু সংক্রমণ: টনসিলাইটিস ও খোস-পাঁচড়ার জন্যে দায়ী ব্যাকটেরিয়া স্ট্রেপটোকক্কাস, হেপাটাইটিস বি ভাইরাস – এরা কিডনিতেও প্রদাহ করতে পারে। সিফিলিস ও ম্যালেরিয়া রোগ থেকেও কিডনি রোগ হতে পারে।

করণীয়: সাধারণ কোন সংক্রমণ থেকেও কিডনির ক্ষতি হতে পারে। সুতরাং যেকোন সংক্রমণে অবহেলা না করে দ্রুত এর চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন।

শরীরের সার্বিক সুস্থতার জন্যে কিডনি কর্মক্ষম থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। তাই আসুন, নিজেদের কিডনির সুস্থতার জন্যে এই বদভ্যাসগুলো থেকে বিরত থাকি।