লরেন্স অফ এরাবিয়া : জানুন কিংবদন্তীর আড়ালে লুকিয়ে থাকা সত্য ঘটনা!

থমাস এডওয়ার্ড লরেন্স, আধুনিক মিলিটারী ইতিহাসের সবচেয়ে বাড়িয়ে বলা চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম।একজন সাংবাদিকের তাকে নিয়ে লেখা বায়োগ্রাফি,লরেন্সের নিজের কিছু লেখা এবং তার সামরিক জীবন নিয়ে বানানো একটি সিনেমা এই ধারনাটিকে আরো পাকাপোক্ত করে দেয়।তবে কিছুটা বাড়িয়ে বলা হলেও তার সামরিক জীবন সত্যিই বর্ণাঢ্য ছিল।তিনি ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্রীড়ানকদের মধ্যে অন্যতম এবং একজন অসাধারণ দলনেতা।

১৯৮৮ সালে পারিবারিক চাকরকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করা একজন এংলো-আইরিশ ব্যারোনেটের সন্তান হলেন থমাস এডওয়ার্ড লরেন্স।নিজের হাইস্কুল শেষে লরেন্স অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন।সেখানে মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে লরেন্স এতই মুগ্ধ হন যে থিসিস হিসেবে ক্রুসেডের প্রাসাদগুলিকে বেছে নেন এবং সাথে আরবীয় ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পরকেও প্রচুর জ্ঞানলাভ করেন।নিজের ডিগ্রী সমাপ্ত করে লরেন্স মধ্যপ্রাচ্যে চলে যান এবং সেখানে তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন খননে অংশ নেন।মধ্যপ্রাচ্যের সে সময়কার অরাজকতার মধ্যে লরেন্সের এই কাজ তার সাহসেরই প্রমাণ দেয়,এবং এই দুঃসাহসই ছিল তার অন্যতম পরিচায়ক।

কায়রো

১৯১৪ সালে কায়রো জার্মানি এবং অস্ট্রিয়ার মিত্র রাষ্ট্র অটোমান তুরস্কদের অধিকারে ছিল,তাদের কাছ থেকে ব্রিটিশ ইন্টিলিজেন্সদের কার্যক্রমকে আড়াল করার জন্য সেবছর গ্রীষ্মে সিনাইতে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কর্মসূচি আরম্ভ হয়।লরেন্স ঐ প্রত্নতাত্ত্বিক খননের একজন সদস্য ছিলেন।

যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়,তখন লরেন্স আর্মিতে যোগ দেন এবং তাকে কায়রোর ইন্টেলিজেন্স বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেখানে তার স্থানীয় ভাষা এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে পূর্বের অভিজ্ঞতাগুলো অনেক কাজে আসে।

আরব ব্যুরো এবং ইরাক

বুদ্ধিমান ব্রিটিশরা বুঝতে পারে যে তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মত পর্যাপ্ত সম্পদ তাদের কাছে নেই।তখন তারা তুরস্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করারা জন্য আরব ব্যুরো স্থাপনের পরিকল্পনা করে।গুজব ছড়ায় যে আরবদের স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্রিটিশদের সমর্থন রয়েছে,এই সংবাদে আরবদের ভক্ত লরেন্স খুশি হয়ে উঠেন।

লরেন্সকে প্রথমে ব্রিটিশ সৈন্যদল নিয়ে কূট শহরে পাঠানো হয় সেখানকার  ইরাকি বিদ্রোহীদের আরবদের বিরুদ্ধে উস্কে দেওয়ার জন্য।যদিও ব্রিটিশ ঊর্ধ্বতনরা ইরাকিদের বিদ্রোহের সামর্থ্যের উপর ভরসা করতেন,কিন্তু লরেন্স সেখানে গিয়ে দেখেন ভিন্ন অবস্থা।তবে ১৯১৬ সালের আগস্টে যখন মেক্কার শেখ হুসেন এর সাথে লরেন্স এর দেখা হয়,তখন পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়।শেখ হুসেন ইতিপূর্বে তুরস্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন,হুসেন এবং তার ছেলে ফয়সালের সাথে লরেন্সের ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়।যদিও বাইরের সাহায্য ছাড়া হুসেনের তুরস্কের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়া অসম্ভব ছিল কিন্তু ব্রিটিশরা সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে অন্যদিকে নিজের সাহায্য পাঠায়।

আরবদের সাথে ঘনিষ্ঠতা

জেদ্দার ব্রিটিশ ফিল্ডের প্রধান কার্যালয়ে লরেন্স এর সাথে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নানা বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দেয়।তার দুঃসাহসিক মনোভাবের জন্য প্রধান কলোনেল লরেন্সকে অপছন্দ করতেন।অপরদিকে লরেন্সের বন্ধুত্বপূর্ণ এবং আরবীয় সংস্ক্রিতির প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ মনোভাবের জন্য তাকে আরবরা খুবই পছন্দ করতেন।

আরবী সেনাদের বিদ্রোহে সাহায্য করার জন্য লরেন্সের ব্রিটেনকে তদবির করা আরবদেরকে প্রীত করেছিল এবং ব্রিটিশদের পাঠানো অস্ত্র,প্লেন এবং অন্যান্য সহায়তা আরবদের যুদ্ধে খুব সাহায্য করে।শিঘ্রই শেখ হুসেনের সৈন্যদল তুরস্কের সেনাবাহিনীকে পিছু হটাতে শুরু করে।

থমাস এডওয়ার্ড লরেন্স

রেলপথে আক্রমণ

তুরস্ক এবং আরবদের যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বুদ্ধিমান লরেন্স একটি নতুন পরিকল্পনা করেন।তুরস্কের বেশিরভাগ রসদই রেলপথে যেত,তাই লরেন্স মালামাল বহনকারী ট্রেনগুলোকে আক্রমন করা শুরু করেন।ফলে তুরস্কে বিভিন্ন দ্রব্যের ঘাটতি দেখা দেয় এবং তাদের অভ্যন্তরীণ কাঠামো দুর্বল হতে শুরু করে।এতে প্যালেস্টাইনে অবস্থানকারী ব্রিটিশ ফিল্ড অধিনায়ক এডমণ্ড এলেনবাই এবং তার অধিনস্ত সৈন্যরা তুরস্কের উপর আরো চাপ প্রয়োগ করার সুযোগ পায়।

নিজেদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখা

শেখ হুসেনের ছেলে ফয়সাল ধীরে ধীরে এই দীর্ঘসময় ধরে চলাকালীন যুদ্ধ নিয়ে হতাশ হয়ে পড়ছিল।আরব সৈন্যরা কোনো অঞ্চল দখল করার পরে সেখানে আধিপত্য বজায় রাখার চেয়ে বরং মালামাল লুট করায় ব্যাস্ত থাকত।ফলে আরব গেরিলারা নানা সমালোচনার সম্মুকহতে শুরু করে।লরেন্স আরব যোদ্ধাদের ইমেজকে ভালো দেখানোর প্রাণপণ চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন।

বিশ্বস্ততায় ভাঙন

১৯১৮ সালের দিকে ব্রিটিশ এবং অস্ট্রেলিয়ানদের সহায়তায় আরবরা তুর্কীদের পিছনে হটিয়ে দিতে সমর্থ হয়।কিন্তু আরবদের নিজের দায়িত্ব পালনে অনীহা এবং লুটেরা মনোভাবের জন্য ব্রিটিশ ও অস্ট্রেলিয়ানরা তাদের তুর্কীদের চেয়েও কম সম্মান করত।

দিনে দিনে সমস্যা আরো বাড়তে থাকে এবং গুজব রটে যে নতুন সৃষ্টি হওয়া আরবদেশকে ব্রিটিশ এবং ফ্রেঞ্চরা ভাগাভাগি করে নেবে।মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিদের জন্য নতুন রাষ্ট্র গঠনে ব্রিটিশদের সহায়তার ঘোষণা এই গুজবকে আরো উস্কে দেয়।

দামাস্কাস শহরকে জয় করার পরে লরেন্স যখন আরব সৈন্য এবং ফয়সালকে নিয়ে আনন্দমিছিল করতে চান তখন ব্রিটিশ ফিল্ড প্রধান এলেনবি তাতে বাঁধা দেন এবং এতে বিরোধ তুঙ্গে উঠে।পরবর্তীতে ভারসালি কনফারেন্সে লরেন্স ফয়সালের জন্য নিজের প্রভাবকে কাজে লাগালেও তা কাজে আসেনি।একদিকে ব্রিটিশদের প্রতি নিজের আনুগত্য এবং অপরদিকে আরবদের প্রতি নিজের ভালোবাস,এই দুইয়ের টানাপোড়নে লরেন্স মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যান।

আমির ফয়সালের সঙ্গে লরেন্স

হতাশা

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে লরেন্স নিজেকে বিভক্ত অবস্থায় আবিষ্কার করেন এবং দেশে ফিরে আসেন।তিনি যুদ্ধে নিজের অবদানের কথা এবং আরবদের কথা মানুষকে বলার জন্য উন্মুখ থাকলেও কারো কাছ থেকে সাড়া পাননি।পরে বেনামে বিভিন্ন সংস্থার হয়ে কাজ করেন এবং নিজেকে নিভৃতচারী বানিয়ে ফেলেন।১৯৩৫ সালের মে মাসে ডরসেটে নিজের বাড়ির পাশে একটি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় লরেন্স গুরুতর আঘাত পান।

এই অসীমসাহসী মানুষটি ব্রিটিশ এবং আরব উভয়ের সাথেই বীরত্বপূর্ণ ভাবে কাজ করেছিলেন।কিন্তু দুইপক্ষের বিশ্বাসঘাতকতা তার পরবর্তী জীবনকে তিক্ত করে তুলেছিল।তার জীবনীর উপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় যাতে থমাস এডওয়ার্ড লরেন্স এর ভূমিকায় অভিনয় করেন বিখ্যাত হলিউড অভিনেতা পিটার ও টুল।

সূত্রঃ warhistoryonline.com