রানা, এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন…

আলো থাকলে ঘুমাতেই পারতো না ছেলেটা। লাইট জ্বললে তো নয়ই, বাইরে থেকে খানিকটা আলো চোখে পড়লেও ঘুম টুটে যেত। তাই ঘরের সমস্ত ফাঁকফোকর বন্ধ করে ঘুমাতো ছেলেটা। কিন্তু বন্ধুর স্বভাব উলটো। ঘুমানোর সময় আলো না হলে সে ঘুমুতে পারে না। দুই বিপরীত স্বভাবের দুইজন মানুষ একই রুমে কীভাবে থাকবে? তাই ছেলেটাই বুদ্ধি বের করে, ‘তুই আগে ঘুমাবি। তোর ঘুম এলে সব আলো নিবিয়ে আমি ঘুমাবো।’
বন্ধু মাঝেমাঝে দুষ্টুমি করে। ইচ্ছে করেই না ঘুমিয়ে জেগে থাকে। ওদিকে ছেলেটার ঘুমে চোখ জ্বলে যায়। বন্ধুকে এসে বলে, ‘দোস্ত, তুই এবারে এট্টু ঘুমা। তুই ঘুমালেই তারপরে আমি ঘুমাবো।’

সময় বদলে গেছে। এখন নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ছেলেটা ঘুমিয়েই চলেছে বছরের পর বছর। এখন আর কেউ তার ঘুমে ডিস্টার্ব করতে পারে না। কিন্তু মাঝে মাঝেই বন্ধুর নির্ঘুম রজনী কাটে। কেমন একটা ঘোর ঘোর অনুভূতি হয়। ঘোরের মধ্যেই যেন শোনে, ‘দোস্ত, তুই এবারে এট্টু ঘুমা। তুই ঘুমালেই তারপরে আমি ঘুমাবো।’ বন্ধু চমকে ওঠে, ঘন ঘন নিঃশ্বাস নেয় – রানার গলা না! চিৎকার করে কেঁদে উঠতে চায়, ‘রানা, ভাই আমার!’

বলছিলাম, মাশরাফি বিন মর্তুজার ছোটবেলার বন্ধ মানজারুল ইসলাম রানার কথা। অন্ধকার না হলে যে রানা ঘুমাতে পারতো না।
দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের আত্মজীবনীগ্রন্থ “মাশরাফি” বইয়ের বাদামী রঙ্গের ২০২-২০৩ তম পাতায় এখনো শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুকণার দাগ আছে। বৃত্তাকার জলকনা গুলো অন্যরকম এক ডিজাইনে ভিজিয়ে দিয়েছিল পাতা দুটো। সেই ভেজা অশ্রুকণা শুকিয়ে দাগ পড়ে গেছে।
আমার কান্নার দাগ।
রানার জন্য কান্না।
মানজারুল ইসলাম রানা।

ক্রিকেট খেলা ঠিক কবে দেখতে শুরু করেছিলাম, মনে নাই। আর বেশিরভাগ খেলা দেখতাম না বুঝেই। ক্রিকেটকে বুঝে ক্রিকেটের প্রেমে পড়েছিলাম যে খেলায়, সেটা হল ২০০৭ বিশ্বকাপের সূচনা ম্যাচ। আমার জীবনের অন্যতম এক্সাইটিং রাত ছিল সেই রাত। একেকটা উইকেট পড়েছে তারস্বরে চেঁচিয়ে সারা বাড়ি জাগিয়ে দিয়েছি। একেকটা চারে হাততালিতে সবার কান ঝালাপালা করে দিয়েছি। ওটা ছিল আমার ক্রিকেটপ্রীতির প্রথম রাত। এই ম্যাচটা নিয়ে বড়সড় একটা আর্টিকেল লিখেছিলাম আমি। ক্রিকেট সম্পর্কে প্রায় কিছুই না জানা আমার অনুভূতি ব্যক্ত করেছিলাম ওই আর্টিকেলে।

কিন্তু তখন কি জানতাম, এই ম্যাচ ছিল আমাদের প্লেয়ারদের হাউমাউ করে কান্নার অংশ? তখন কি জানতাম, এই ম্যাচ মাশরাফির ১০৩° জ্বর গায়ে নিয়ে “রানার জন্য খেলতি হবে” প্রতিজ্ঞার ম্যাচ? তখন কি জানতাম, ভারত আসলে সেদিন কোন জাগতিক ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে খেলেনি। খেলেছে ১১ জন রানার বিপক্ষে?

জানতাম না। তাই অতটা মজা করে খেলা দেখতে পেরেছিলাম। আর তাই প্রতিবছর ১৬ই মার্চ এলেই মনে পড়ে রানার কথা। মানুষটাকে চিনতাম না, কখনো তাঁর খেলা দেখিনি, তবুও মনে পড়ে। বুকের এক পাশে কেমন চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয়। ২০০৭ সালের ১৬ই মার্চ খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার বালিয়াখালি ব্রিজের নিকট এক সড়ক দুর্ঘটনায় মাঞ্জারুল ইসলাম রানা এবং তার ক্লাব সতীর্থ সাজ্জাদুল হোসেন সেতু নিহত হন। দুর্ঘটনার সময় রানা নিজেই মোটরসাইকেল ড্রাইভ করছিলেন। দ্রুতগতিতে একটি এম্ব্যুলেন্স এসে ধাক্কা দেয় রানার বাইকে। তারপরই সব শেষ। মৃত্যুকালীন তার বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর ৩১৬ দিন। রানার মৃত্যু আর্চি জ্যাকসনের সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে মৃত্যুর রেকর্ড ভেঙ্গে দেয়, কিন্তু যে রেকর্ড আমরা কেউই চাইনি। ১৯৮৪ সালের ৪ মে খুলনায় জন্মগ্রহন করেন মানজারুল ইসলাম রানা। বেঁচে থাকলে আজ ৩৩ বছরে পা দিতেন তিনি।

২০০৩ সালের ৭ নভেম্বর চট্টগ্রামে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ১৯ বছর বয়সে রানার অভিষেক ঘটে। মোহাম্মদ রফিক এর স্থলাভিষিক্ত হয়ে তিনি তার তৃতীয় বলেই মাইকেল ভনকে আউট করেন। রানাই প্রথম বাংলাদেশী ক্রিকেটার যিনি তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে প্রথম ওভারেই উইকেট নিয়েছেন।

মানজারুল ইসলাম রানা প্রথম বাংলাদেশী ক্রিকেটার যিনি পর পর দুই ম্যাচে ম্যান অব দা ম্যাচ হয়েছিলেন। ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ দলের জিম্বাবুয়ে সফরে ওয়ানডে সিরিজে দুইবার ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন।

রানার খেলা আমি নিজের চোখে লাইভ দেখতে পারিনি। সেই সৌভাগ্য হয়নি আমার। তাই রানার খেলা দেখেছে, এমন একজন বন্ধুর সাহায্য নিতে হলো। তার ভাষ্যমতে,

‘হাল না ছাড়া কোন ক্রিকেটারের কথা ভাবলে প্রথমেই মাশরাফির চেহারা ভাসে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমাদের প্রথম হাল না ছাড়া ক্রিকেটার ছিল রানা। সময়টা ২০০৫। জিম্বাবুয়ের সাথে ওয়ানডে সিরিজ। প্রথমবারের মতো সেবারই আমরা কোন সিরিজে ফেভারিট ছিলাম। কিন্তু সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ হেরে আমাদের সিরিজ জয়ের স্বপ্ন প্রায় শেষই হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ‘রানা’ নামক এক যোদ্ধার কারণে স্বপ্ন সত্যি হয়। টানা দুটো ম্যাচে অসাধারণ পারফর্ম করে সিরিজে বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনে এই রানাই। সত্যি বলতে, তার ঐ দুই ম্যাচের পারফর্ম্যান্সই আমাদেরকে পরের সবগুলো ম্যাচ জয়ের সাহস এনে দেয়। আমাদের তখনকার শক্তিমত্তা অনুযায়ী পাঁচ ম্যাচ সিরিজে প্রথম দুই ম্যাচ হেরেও, পরবর্তী তিন ম্যাচ জিতে সিরিজ জয়ের ভাবনাটাই ছিল অকল্পনীয়। সেই অকল্পনীয় চিন্তাকেই বাস্তব করেছিল রানা। তার হাল না ছাড়া দৃঢ় মনোভাব না থাকলে হয়তো সেই সিরিজটা আমরা হেরে যেতাম। হয়তো বা আমাদের ক্রিকেটীয় উত্থানটাও থমকে যেত। রানা সেটা হতে দেয়নি।’

বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে ৬টি টেস্ট ও ২৫টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিলেন কাজী মানজারুল ইসলাম রানা। দেশের হয়ে সম্মান বয়ে আনা খুলনার এই কৃতি সন্তানের খুলনা স্টেডিয়ামের একটি গ্যালারির নামকরন করা হয়। বাংলাদেশের প্রথম তারকা অলরাউন্ডার হবার সম্ভাবনা নিয়ে যার আগমন হয়েছিলো তার ক্যারিয়ার থেমে গেছে ৬ টেস্ট আর ২৫ ওয়ানডে ম্যাচেই।

বাহাতি স্পিন আর মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান রানা ছিলেন কোচ ডেভ হোয়াটমোরের আবিষ্কার। আর্ম বলের শুরু বাংলাদেশে রানার হাত ধরেই। ক্যারিয়ার মাত্র শুরু হয়েছিলো, মাত্র ২২ বছরেই হয়েছিলেন খুলনা বিভাগের অধিনায়ক। জীবনের শেষ প্রথম শ্রেনীর ম্যাচে বল হাতে দুই ইনিংসে ২৫/৫ এবং ১১৩/৪ ছিলো তার বোলিং ফিগার, খুলনার অধিনায়ক হিসাবে ঢাকা বিভাগের বিপক্ষে জয়ে রেখেছিলেন মূল ভূমিকা, তার আগের দুই ম্যাচেই চট্টগ্রামের বিপক্ষে ১৫১ আর সিলেটের বিপক্ষে করেছিলেন ১২০ রান। শেষ ম্যাচে ৬৩ রানে অপরাজিত থেকেই দলকে জিতিয়েছিলেন খুলনার একটি স্থানীয় ম্যাচে। সেটাই শেষ ম্যাচ ছিলো কে জানতো!

কোচ হোয়াইটমোরের সাথে রানার রুমে রানার মা

গতবছর খুলনা টাইটান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিসিবির পরিচালক কাজী ইনাম আহমেদ ক্রিকেটার রানা ও সেতুকে খুলনা টাইটান্সের আইকন খেলোয়াড় হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। সত্যিই তো! বেঁচে থাকলে নিশ্চিতভাবে তাঁরাই কোনও না কোনও দলের আইকন প্লেয়ার হতেন। দাপিয়ে বেড়াতেন বিপিএল।

খুলনায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বা ঘরোয়া লিগের ক্রিকেট ম্যাচ হলে সাবেক সতীর্থ রানার বাড়িতে রানার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসেন মাশরাফিরা। অবশ্য শুধু খুলনায় খেলা হলেই না, সব সময়ই বন্ধু-জননীর খবরা-খবর নেন মাশরাফি। রানার মা, জামিলা খাতুন এখন আর খেলা দেখেন না। টেলিভিশনে খবর শুনে আর পত্রিকা পড়ে শোনেন যে বাংলাদেশ দলে জিতেছে। গর্বে বুকটা বড় হয় আবার খানিকবাদেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন… “ইশ!! যদি আমার রানাটা থাকতো।”

রানা ও সেতুকে খুলনা টাইটান্সের আইকন ঘোষণা করা হয়

মুজগুন্নীতে রানাদের বাড়িটা দুইতলা। রানার মৃত্যুর পর দুইতলা পূর্ণ হয়েছে। তার মৃত্যুর পর ক্যান্সারের মারা গেছেন রানার বাবাও। বাড়ির উপরের তলার একটা কক্ষের দরজা সবসময় থাকে বন্ধ। এ ঘরটি সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছেন জামিলা খাতুন। রানার ব্যবহৃত সবকিছু আছে ওই রুমে। বিছানা, টেবিল, টেবিলের উপরে পড়ে আছে বিভিন্ন সময়ের ক্রিকেটে পাওয়া পুরস্কার। শো-কেসে সাজানো অসংখ্য ম্যান অব দ্য ম্যাচ এবং সিরিজের পুরস্কার। লাল-সবুজের গর্বিত ৯৬ নম্বর জার্সিটাও ঝুলে আছে হ্যাঙ্গারে। ধুলো থেকে ছেলের জার্সিটা বাঁচাতে তাতে আলাদা পলিথিন প্যাক করেও রেখেছেন মা। সবকিছুই আছে শুধু রানা নেই।

                         

রানার ঘর, তার ব্যবহার্য ক্রিকেট সরঞ্জামাদি

খাটের পাশেই ক্রিকেট কিটসব্যাগ। কালো রঙের ব্যাগের একপাশে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের লোগো আর ওপরে সাদা অক্ষরে লেখা ‘রানা’। যেনো কিছুক্ষণ আগেই মাঠ থেকে ফিরেছে প্রিয় সন্তান। এভাবেই এগুলোকে প্রতিদিন একবার করে দেখেন আর নীরবে চোখের পানি ঝরান জামিলা খাতুন।

১৬ মার্চ ২০০৭, বাংলাদেশের ক্রিকেটের এক অপূরনীয় ক্ষতির দিন। পরের দিনই ছিলো ভারত বাংলাদেশের ম্যাচ। আপাতদৃষ্টিতে সেই অসম লড়াইয়ে মাশরাফি আর তার দল দেখিয়ে দিয়েছে “রানার জন্য ম্যাচ” এ ওরা কী কী করতে পারে! সবারই নিশ্চয়ই তা মনে আছে? বিষ্ময়কর ব্যপার হলো, সেবারের পর থেকে ১৬ মার্চের আশেপাশের বাংলাদেশ যতগুলো আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে তার সবকয়টিতেই জিতেছে!
‘০৮ সালে ১৮ই মার্চ বাংলাদেশ হারিয়েছিল আয়ারল্যান্ডকে।
০৯ & ১০ সালে মার্চে কোনও ম্যাচ ছিল না।
‘১১ তে ইংল্যান্ডকে ১১ই মার্চ এবং নেদারল্যান্ডসকে ১৪ই মার্চ হারিয়েছিল বাংলাদেশ।
‘১২ সালে রানার মৃত্যুবার্ষিকীর দিন এশিয়া কাপে ভারতকে হারিয়েছিল মাশরাফিরা।
‘১৪ তে রানার মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে টি২০ বিশ্বকাপে আফগানিস্তানকে হারিয়েছিল ওরা।
এই বছর ১৬ মার্চ পড়েছিলো শততম টেস্ট ম্যাচের ভেতর। সেই টেস্ট ম্যাচ জিতেছিলাম আমরা!

রানা-রাজ্জাক-মাশরাফি-রাসেলদের দারুণ এক সার্কেল গড়ে উঠেছিল সেসময়ে। খুব মারপিঠ করতো ওরা। হৈহুল্লোড়-দুষ্টুমি করতো। মোটর সাইকেলে শহর দাবড়ে বেড়াতো। কিন্তু এখন আর সেই পাগলামিটা আর নেই। অনেককিছুই হারিয়ে গেছে। শুধু হারায়নি – রানার জন্য লড়াইয়ের জেদ। রানা নিশ্চয়ই ওপার থেকে এসব দেখছে? এসব দেখে কেমন লাগে ওর?

রানার ৯৬ নাম্বার জার্সিটা বিসিবি এর পরে আর ব্যবহার করেনি। আশা করি, বাংলাদেশ ক্রিকেটের ৯৬ নাম্বার জার্সিটা আজীবন রানার জন্য লেখা থাকবে।