বাংলাহাব ভ্রমণ- হুমায়ূন আহমেদের নন্দনকাননে আমরা কজন…

মাসখানেক আগ থেকে প্ল্যান হচ্ছিল বেড়াতে যাবার। তখন কুয়াকাটা যাবার কথা চলছিল। দূরত্বসহ বিভিন্ন কারণে সেটা ক্যান্সেল হয়ে গিয়েছিল। যেকোন ভ্রমণ পরিকল্পনায় আমার উৎসাহ থাকে সবচেয়ে বেশি। কুয়াকাটা যাবার পরিকল্পনায় সবার উৎসাহে ভাটা পড়ে যাওয়ায় প্রচন্ড মন খারাপ হয়ে যায় আমার। আমাকে স্বান্তনা দেবার জন্যই হয়তো জাকির ভাই গাজিপুর যাবার প্রস্তাব তুললেন। আমি আবারো লাফিয়ে উঠলাম।
প্রচন্ড গরমে ঘামতে ঘামতে যাবার আগের দিন ঢাকায় এসে উপস্থিত হলাম। নিয়মমতো ধানমন্ডি ছাব্বিশে আড্ডা মেরে বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত দশটা। পরদিন খুব ভোরে উঠতে হবে ভেবেও সাড়ে বারোটার আগে বিছানায় যেতে পারলাম না। ভেবেছিলাম, ঠিক সময়ে উঠতেই পারব না। হলো উল্টোটা। উত্তেজনায় ঘুমই হলো না। ঠিক পাঁচটায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। রেডি হয়ে চলে গেলাম যথাস্থানে। গিয়ে দেখি তাসমিয়া দাঁড়িয়ে রয়েছে। যতোই মেয়েদের ঢিলেমির ব্যাপারে অভিযোগ করা হোক না কেন, ঘুরে ফিরে সেই মেয়েরাই যেন সময় মেনে চলে!
মেঘলা আকাশ। সুন্দর আবহাওয়া। ঘুরে বেড়াবার জন্য যথোপযোগী পরিবেশ। আমাদের ভাড়া করা মাইক্রোবাস ছুটে চলছে গন্তব্যে। ইভা ছাড়া আমাদের কেউই এর আগে আর কখনো নুহাশ পল্লী যায়নি। ওর দেখিয়ে দেওয়া পথে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। যদিও রাস্তা ভুল হচ্ছিল বারবার। তবুও আমরা দশটার মধ্যেই হুমায়ূন স্যারের নন্দনকাননে পৌঁছে গেলাম। টিকিট কেটে ভ্যাপসা একটা গরম সাথে নিয়ে নুহাশ পল্লীর গেটের ভিতর পা রাখলাম।

প্রথমেই চোখে পড়ল, মার্বেল পাথরে বানানো স্যারের অবয়ব। কাছে গিয়ে দেখলাম। ছবি তোলা হল। পাশেই ছোটখাটো একটা সুইমিংপুল। সুইমিংপুলের পানি সরবরাহের সিস্টেমটা বেশ মজার। শ্বেত বর্ণের প্রকান্ড এক মানব খুলির মুখই এর পানির উৎস। ওখান থেকেই দেখলাম, এক মা তার ছেলের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। না, না! রক্তমাংসের মাতা-পুত্র নয়। পাথরের তৈরি। কোন নাম ছিল না সামনে। মূর্তি দুটি দেখে খুব জানতে ইচ্ছে করছিল, এঁরা কারা? কাদের প্রতিকৃতিকে নুহাশ পল্লীর শুরুতেই স্থাপন করেছেন প্রিয় লেখক? আমার কেন যেন খুব ভাবতে ইচ্ছে করছিল, এরা গুলতেকিন ম্যাম আর নুহাশ।

 

কয়েক কদম পরই ছিমছাম একতলা একটা বাড়ি। তারপরই স্যারের বিখ্যাত বৃষ্টিবিলাস। তবে বৃষ্টিবিলাস দেখে একটু যেন হতাশাই এসে গেল। বারান্দায় সারি করে বিছিয়ে রাখা চেয়ার, আর রেলিংয়ে শুকাতে দেওয়া কাপড় – এই দুটিই এর সৌন্দর্য ম্লান করে দিয়েছে। এখান থেকেই স্যারের নন্দনকাননে তাঁর অনুপস্থিতির ছাপ দেখা যাচ্ছিল।

পুরো জায়গা জুড়েই অনেক অনেক গাছ। বাহারি ফুল গাছ, ফল গাছ, ঔষধি গাছ। বৃষ্টি বিলাসের সামনে বিশাল খোলা মাঠ। পুরু ঘাসের কার্পেটে ঢাকা। ঠিক মাঝখানে একটা লিচু গাছের উপর ট্রি-হাউজ বা “গাছ বাড়ি”। ঠিক করলাম, পুরো নুহাশ পল্লী ঘুরে এসে গাছবাড়িতে উঠব।

ইট বিছানো পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছি। কর্দমাক্ত পথের কাদায় স্যান্ডেল ভারি হয়ে যাচ্ছে। স্লিপ কাটছে। কল্পনা করছি, বছর পাঁচেক আগেও নিশ্চয়ই লাল ইটের এই রাস্তাটুকু খুবই সুন্দর দেখাত। স্যার বেঁচে থাকতে নিশ্চয়ই এই পথ ঝকঝকে তকতকে থাকতো! এমন মেটে কিংবা শেওলা রংয়ের হয়ে থাকতো না নিশ্চয়ই?

আমরা হাতের ডান পাশের জায়গাগুলি দেখতে দেখতে এগুচ্ছি। ফেরার সময় বাম দিকের জায়গা দেখব। হাঁটতে হাঁটতেই দেখলাম, ছোটখাটো একটা টিলার উপর বিশাল এক দানব দুই হাত দুদিকে ছড়িয়ে বিকট মুখভঙ্গি করে রেখেছে। তার বিকটদর্শন চেহারা দেখে মোটেও ভয় পেলাম না। বেচারার বিশাল বিশাল আঙ্গুলের বেশ কয়েকটা ভেঙ্গে গেছে কী করে যেন। টিলার ঠিক সামনেই ছোট্ট একটা পুকুর। পুকুরের ঠিক মাঝখানে শ্বেতী এক মৎসকুমারী বসে। সারা শরীর সাদা হলেও লেজের যে অংশটা পানি সংলগ্ন, সে অংশ শেওলা জমে কালচে হয়ে গেছে।

আরেকটু এগুতেই দেখি বিভিন্ন প্রজাতির ডায়নোসর। মাংসাশী ডায়নোসর, পিঠে কাঁটা-ওয়ালা ডায়নোসর, তৃণভোজী ডায়নোসর। ডায়নোসরের কাছেই একখানা প্রতিমূর্তি। প্রতিমূর্তির নিচের লেখা পড়ে বুঝলাম স্যারের কোন এক জন্মদিনে অন্যপ্রকাশ এই প্রতিমূর্তি স্যারকে গিফট করেছিল। দুঃখের ব্যাপার হল, প্রতিমূর্তিটা মোটেও স্যারের মত দেখতে হয়নি।

তৃণভোজী ডায়নোসর গুলি লম্বা গলা উঁচিয়ে সামনে থাকা গাছের ডালের দিকে হা করে রয়েছে। ডায়নোসরের ডিমও দেখলাম। একটা আবার ফুটে বেরুবে, এমন অবস্থায় রয়েছে। শাড়ি পরেও তাসমিয়া গেছো বাদরের মত কাঁটাওয়ালা ডায়নোসরের কাঁটা তরতর করে বেয়ে ওটার ঘাড়ে গিয়ে বসল। কী আশ্চর্য! ভয়ঙ্কর এই মাংসাশী ডায়নোসর টু শব্দটি করেও প্রতিবাদ জানালো না!

তারপরেই দীঘি লীলাবতী। দীঘি লীলাবতীর নাম স্তম্ভে লেখা,“নয়ন তোমারে দেখিতে পায় না, রয়েছ নয়নে নয়নে… “
শান বাঁধানো ঘাটটা আবার টাইলস করা। কেন যেন টাইলস করা ঘাট, দীঘির সাথে ঠিক মানাচ্ছে না। এই ঘাট দেখেই কী যেন মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ছে না। দীঘিতে একটা দ্বীপও আছে। পাড় থেকে দ্বীপে যাওয়ার জন্য রয়েছে কাঠের নড়বড়ে সেতু। আমরা সবাই মিলে সেতু পেরিয়ে দ্বীপে গেলাম। বসার জন্য বেঞ্চও আছে। ওখানে বসলাম গিয়ে।

কাঠের সেতুর ঠিক সামনেই ভূতবিলাস। দুটো পাকা দালানের ঠিক মাঝখানে লাগোয়া লাল টালির ঘর। টালিগুলি কেমন শেওলা পড়ে গেছে। ভাবছি, রাত হলে এখানে ভয় লাগবে? লাগবে মনে হয়। কারণ এই বাড়ির ধারেকাছে আর কোন ঘর নেই। গাছপালা আর দীঘি মিলিয়ে ভালোই ভৌতিক আবহ তৈরি হবে। সেই সাথে নিশির ডাক তো থাকবেই!

ভূতবিলাসের পাশ দিয়ে চওড়া ঘাসের পথ। দুইধারে নানা জাতের গাছ লাগানো। একে রাস্তা না বলে দীঘির পাড় বলা যায়। দীঘির মাথার কাছে যেতেই এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল। প্রচন্ড ভ্যাপসা গরমে এই বাতাসটুকু যেন শান্তির পরশ বুলিয়ে দিয়ে গেল।

দীঘির ঠিক ওপারে গিয়ে দেখি মাটির ঢিবির উপরে ঝোলানো দোলনা। তার পাশেই বিশাল বড় এক কাঠ গোলাপের গাছ। সাদা কাঠগোলাপ। গাছ ভর্তি থোকা থোকা ফুল। গাছের নিচে কিছু ঝরা ফুল বিছিয়ে রয়েছে। কাঠগোলাপের সামনেই আরেকটা শেওলা ধরা শান বাঁধানো ঘাট। বিশাল এক বট গাছের নিচে। ঘাটটা ভেঙ্গে গেছে। টাইলসের ঘাট দেখে যেটা মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ছিল না, এখন তা মনে পড়ল। প্রথম আলো পত্রিকায় স্যারের শেষ সাক্ষাতকারটা লীলাবতীর ঘাটে বসে দিয়েছিলেন। বেশ কিছু ছবি ছিল ওই প্রতিবেদনে। ছবিতে আমি বটের ছায়ায় এই ঘাটেই স্যারকে বসে থাকতে দেখেছিলাম।

কেন যেন প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। এই ঘাটটা যে পরিত্যক্ত, খুব করে বোঝা যাচ্ছে। মাটির স্তর পড়ে রয়েছে সিঁড়ি আর ঘাটে বসার জায়গার সামনে। সম্ভবত মাটির ঢিবি থেকে বৃষ্টির পানিতেই এই মাটি এসে জমা হয়। সাদা টাইলসের ওই হাইফাই ঘাটের চেয়ে ভাঙ্গা আর পরিত্যক্ত এই ঘাটটাই আমার বেশি ভালো লেগেছে। দীঘির পাড় ঘুরে ফিরে আসছে। বিড়বিড় করে বলছি, ‘ইসসস! এমন একটা বাড়ি যদি আমার থাকতো!’ লেখালেখি করার জন্য নুহাশ পল্লী একদম পারফেক্ট একটা জায়গা।

যাওয়ার সময় ডানপাশের সবকিছু দেখেছি। ফেরার পথে বাম পাশটা দেখতে দেখতে এগোচ্ছি। একটা মাটির ঘর। উপরে টিনের চালা। তার পাশেই কী একটা গাছে তরতর করে একটা ছোট্ট কাঠবিড়ালি উঠে গেল। টিনের ঘরও আছে। এগুলি সম্ভবত শুটিংয়ের জন্য ব্যবহৃত হত। বিশাল বড় এক গ্যারেজ দেখলাম। তার পাশেই কবুতরের খোপ। একসময় কবুতর ছিল হয়তো।

পুরা নুহাশ পল্লী জুড়ে প্রচুর গাছ, আগেই বলেছি। এপাশে একটা বিশাল জায়গা জুড়ে ঔষধিগাছ। বেশিরভাগ গাছেই নেমপ্লেট লাগানো। কিন্তু কতগুলির নেমপ্লেট নেই। আবার কতগুলির নেমপ্লেট আছে, গাছই নেই। একজায়গায় দেখলাম, একটা স্তম্ভ দাঁড়িয়ে। তাতে লেখা, “রাশেদ হুমায়ূন ঔষধি উদ্যান, আমার ছোট্ট বাবাকে মনে করছি।”

সবশেষে গেলাম, স্যারের কবর দেখতে। এপিটাফে বড় করে স্যারের সাইন দেওয়া। তার নিচে লেখা-

‘কল্পনায় দেখছি নুহাশ পল্লীর সবুজের মাঝে ধবধবে শ্বেতপাথরের কবর। তার গায়ে লেখা,
“চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে
নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে।”‘

ধীর পায়ে বেরিয়ে এলাম নুহাশ পল্লী থেকে। এত সুন্দর একটা জায়গা, কিন্তু মালিকের অনুপস্থিতিতে সব জায়গায় কেমন যেন অযত্নের ছাপ প্রকট ভাবে দেখা দিয়েছে। কত যত্ন, কত মায়া আর ভালোবাসা নিয়ে সাজিয়েছিলেন এই বিশাল স্বপ্নবাড়ি। কেন যেন খুব খারাপ লাগছে…