সন্তান জন্মপূর্ব বিষণ্ণতা ও দুশ্চিন্তার সাথে মানিয়ে নিতে মায়েদের জন্য ১৭ টিপস

young pregnant woman in forest in fall color; Shutterstock ID 110066945; PO: The Huffington Post; Job: The Huffington Post; Client: The Huffington Post; Other: The Huffington Post
গত পর্বে আমরা জেনেছি জন্মপূর্ব বিষণ্ণতা (Antinatal depression) এর কারণ ও লক্ষণ।

গবেষণায় দেখা গেছে গর্ভাবস্থা বা জন্মপূর্ব বিষণ্ণতা ও দুশ্চিন্তা প্রি-ম্যাচিউর প্রসবের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। যদি এর যথা সময়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তবে তা মা ও বাড়ন্ত শিশুর উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। কিন্তু আমাদের দেশে বেশির ভাগ নারী ও তার পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি সম্পর্কে জানেন না, অনেকে জানলেও উদাসীন থাকেন।

১৭টি টিপস, যা নারীকে সন্তান জন্মপূর্ব বিষণ্ণতা ও দুশ্চিন্তার সাথে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করতে পারে

১। নিজের যত্ন নিন

 আপনার শারীরিক সুস্থতার সাথে মানসিক সুস্থতাও জরুরি। আপনার সুস্থ থাকলেই আপনার শিশুর সুস্থ বিকাশ হবে। নিজের ভাল লাগার কাজগুলো বাড়িয়ে দিন। আরামদায়ক গোসল, নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখা, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ, গান শোনা, ভাল  বই পড়া, প্রার্থনা করা ইত্যাদি আপনার মনে প্রশান্তি এনে দিবে।

২। ব্যায়াম

 গর্ভাবস্থার নির্দিষ্ট ধাপ পরে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে হাটাহাটি বা হালকা ব্যায়াম করতে পারেন। গর্ভাবস্থায় হালকা যোগ ব্যায়াম আপনার শক্তির মাত্রা বৃদ্ধি করে এবং মন ভাল করার ডোপামাইন হরমোনের উৎপাদন বৃদ্ধি করে।

৩। কর্মক্ষেত্রে আপনার গর্ভাবস্থা সম্পর্কে জানিয়ে রাখা

 গর্ভাবস্থায় কাজ মানসিক চাপের মাত্রা বাড়াতে পারে, তাই আপনার গর্ভাবস্থা নিয়ে বসের সাথে এই সময় ফিল্ড ভিজিট,কাজের হালকা চাপ নেয়া ও প্রয়োজন মত যেন বিশ্রাম নিতে পারেন ইত্যাদি সংক্রান্ত খোলামেলা আলোচনা করে নেয়া ভাল।

৪। পর্যাপ্ত ঘুম

গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন হয়, কিন্তু এ সময় অনেকেই অনিদ্রায় ভোগেন। তাই যখন সুযোগ ঘটে দিনের বেলায় হলেও অল্প সময় ঘুমিয়ে নেয়ার চেষ্টা করুন। এতে আপনার এনার্জি লেভেল ঠিক থাকবে।

৫। লিখে রাখুন

 গর্ভাবস্থায় হরমোনাল পরিবর্তনের কারনে অনেক সময় জরুরি বা খুঁটিনাটি বিষয় ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক। তাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো যখন মনে থাকবে তখন সেটা কোথাও লিখে রাখুন। এই ভুলে যাওয়া নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, এটি প্রসব পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যায়।

৬। চিন্তা কেন্দ্রীভূত না রাখা

 একটানা বিশ্রাম আপনার মাথায় বিভিন্ন চিন্তা এনে মনকে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। তাই মাঝে মাঝে সংসারের হালকা কম পরিশ্রমের কাজ করতে পারেন, যেমন- আজকের রান্না কোনটা হবে, কিভাবে রাধতে হবে বলে দিতে পারেন। এতে চিন্তা এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত থাকবে না ।

৭। যেখানেই থাকুন না কেন প্রয়োজনবোধে সাহায্য চান

 এই সাহায্য আপনার সঙ্গি, কলিগ, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশি, প্রেগনেন্সি গ্রুপ, কাউন্সেলর, ডাক্তার থেকে আসতে পারে। সাহায্য চাওয়া কোন দুর্বলতা নয়, বরং এটি আপনাকে সঠিক তথ্য পেতে ও সচেতন হতে সহায়তা করবে। এসময় অসুবিধা হলে তা নিজের কাছে চেপে রাখবেন না।

৮। কথা বলুন

আমাদের সমাজে গর্ভধারণ ও মায়েদের সুস্থতা, সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে কথা বলার চর্চা খুবই কম। এক্ষেত্রে আপনার কাছের বা বিশ্বস্ত কারো কাছে যেমন আপনার স্বামী, শাশুরি, মা, বোন, বন্ধু, অন্য কেউ, এমন কি ডাক্তার আপনার যাবতীয় কথা শেয়ার করতে পারেন। এটি আপনাকে বিষণ্ণতা ও উদ্বেগকে নিয়ন্ত্রন করতে সাহায্য করবে।

৯। গর্ভকালীন সময়টা লেখার মাধ্যমে ধরে রাখতে পারেন

 এতে যেমন সময়টা ভাল কাটবে, আবার কোন কিছু নিয়ে মন খারাপ হলে সেটাও লিখে ফেলার ফলে মনটা হালকা হয়ে যাবে।

১০। ‘না’ বলতে শিখুন

 গর্ভাবস্থায় একজন নারী বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হন। বিষয়টি সম্পর্কে অনেক সময় অন্যরা বেখেয়াল বা উদাসীন থাকতে পারে। তাই আপনার বর্তমান অবস্থা নিয়ে নিজেকে অগ্রাধিকার দিন এবং অন্যদের ‘না’ বলা শুরু করুন। হবু মায়েদের উপর হবু সন্তানের অমঙ্গলের আশঙ্কা দেখিয়ে পরিবার বা প্রতিবেশি থেকে অনেক ক্ষেত্রে খাওয়া দাওয়া, আচার অনুষ্ঠানে পালন করা নিয়ে নানা রকম উপদেশ, বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেয়া হয়। যেটি পালন না করতে পারলে বা অমঙ্গলের আশঙ্কায় হবু মা আরও বেশী মানসিক চাপের সম্মুখীন হন। এক্ষেত্রে ডাক্তারের কাছ থেকে বিধি নিষেধ জেনে নিন, পরিবারের সদস্যদের কারনসহ বুঝিয়ে বলুন।

১১। পরিবারের বাড়তি দায়িত্ব নেয়া থেকে বিরত থাকুন

 কেননা এসময় আপনার দ্রুত ক্লান্তি, মন মেজাজের তারতম্য, ভুলে যাওয়া মনোযোগের অভাব, মানসিক চাপ- ইত্যাদির সাথে খাপ খাওয়ানো নিয়ে নিজেই ব্যস্ত থাকবেন। বাড়তি দায়িত্বটি ঠিকমত পালন না করতে পারলে আপনার মধ্যে বিষণ্ণতা ও উদ্বেগের মাত্রা বেড়ে যাবে।

১২। পরিবারের সদস্যদের সচেতনতা

একজন নারীর গর্ভাবস্থায় তাকে উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা থেকে দূরে রাখতে পরিবারের সদস্যদের বাড়তি সহযোগিতা অনেক প্রয়োজন। এসময় বাড়ির পরিবেশ শান্ত রাখা, তার সামনে এমন কোন পরিস্থিতি বা আলোচনা করা উচিত নয় যা সন্তান সম্ভবা মা-কে বিষণ্ণ করে তুলবে।

১৩। অন্যের কথা শুনে অন্ধভাবে বিশ্বাস করবেন না, অস্থির হবেন না

 প্রত্যেক মা এর মধ্যে দিয়ে গেলেও একেক জনের গর্ভাবস্থার অভিজ্ঞতা একেক রকম। তাই কারো খারাপ অভিজ্ঞতা শুনে বা কারো কোন খাদ্য গ্রহনের পরে, বা কোন কাজের কারনে অসুবিধা হলে সেই রকম অভিজ্ঞতা যে আপনারও হবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। আপনার ডাক্তারই আপনার সমস্যার সঠিক সমাধান দিতে পারবেন, তার নির্দেশমত চলুন, সঠিক তথ্য সংগ্রহ করুন।

১৪। শিথিলকরন বা রিলাক্সেশনের কৌশলগুলো সম্পর্কে জানুন

 যেমন গভীরভাবে নিঃশ্বাস নেয়ার ব্যায়াম। এটি আপনাকে প্রতিদিনকার মানসিক চাপ ও নেতিবাচক অনুভূতি থেকে দূরে রাখতে সহায়তা করবে

১৫। নিজের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হন

 শুধু গুরুদায়িত্বের কথা না ভেবে এই সময়ের নতুন অনুভূতিগুলো উপভোগ করার চেষ্টা করুন অনাগত সন্তানের সাথে সাথে নিজের কথাও ভাবুন। আপনার স্বামীর সাথে আপনার নতুন অনুভূতি, আগামির পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলুন। এতে যেমন দুজনেই করনীয়- বর্জনীয় সম্পর্কে সচেতন হবেন আবার একসাথে সময় ও কাটানো হবে।

১৬। জীবনসঙ্গীর সহযোগিতা ও সমর্থন

 গর্ভাবস্থায় নারীর সবচে ভাল কাছের মানুষটি হয়ে থাকেন তার জীবনসঙ্গী। এসময় স্বামীর উপর প্রত্যাশার পরিমান তুলনামূলক বেড়ে যায়। গর্ভাবস্থার মধ্য দিয়ে যাওয়ার স্ত্রীর বিভিন্ন পরিবর্তনে পাশে থাকা, সুবিধা-অসুবিধার প্রতি যত্নবান হওয়া, তাকে এসময়ের অনুভূতি নিয়ে কথা বলতে উৎসাহিত করা, হবু বাবা হিসেবে তার অনুভূতি শেয়ার করা, কাজ শেয়ারিং, সময় নিয়ে বিস্তারিত কথা বলা, সময়মত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে স্বামী স্ত্রীকে এই সময়ে মানসিক চাপ ও বিষণ্ণতা থেকে মুক্ত রাখতে পারেন। গর্ভাবস্থায় স্ত্রীকে সুস্থ ও হাসিখুশি রেখে তার মধ্যে ইতিবাচক চিন্তার বিকাশ ঘটাতে স্বামী সাহায্য করতে পারেন।

১৭। প্রয়োজনে আপনার ডাক্তারের পরামর্শের পাশাপাশি পেশাদার কাউন্সেলিং সেবা গ্রহণ করতে পারেন

সুস্থ ও সুন্দর গর্ভাবস্থা একটি শিশুর সুস্থ বিকাশের জন্য অনেক প্রয়োজনীয়। জন্মপূর্ব বিষণ্ণতায় ভোগা মায়ের সন্তানের উপর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের একটি বড় অংশের জন্য দায়ী তাদের মায়েদের গর্ভকালীন বিষণ্ণতা। তাই গর্ভাবস্থার প্রথম থেকেই বিষণ্ণতার লক্ষন সনাক্ত করে তার প্রতিকারে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

লেখিকা সম্পর্কেঃ জোহরা আফরিন উপমা। আমি পেশায় একজন কাউন্সেলিং মনোবিজ্ঞানী। গল্প, উপন্যাস পড়তে ভালবাসি। মনোবৈজ্ঞানিক ফিচার লেখার সাথে যুক্ত আছি। প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘুরতে ও গান শুনতে ভাল লাগে।