মনস্তাত্ত্বিক গল্পঃ সাইক্রিয়াটিস্ট

পেশাগতভাবে সাইকিয়াট্রিস্ট হওয়ায় জীবনে বহুধরণের অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক সমস্যাওয়ালা মানুষকে দেখেছি আমি। তার মধ্যে একটা বেশ অদ্ভুত ছিলো। একটু বেশিই অদ্ভুত।

তিনজনের একটা পরিবার থাকতো আমার পাশের বাসায়। বিবাহিত যুগলের দুইজনেরই বয়সই ছিলো ষাটের কোঠায়, আর তাদের ছেলের বয়স ছিলো ত্রিশ। তাদের ছেলেটা বেশ অদ্ভুত ছিলো। আমাদের দেশ জাপানে এই ধরণের মানুষকে ‘হিকিকোমরি’ বলা হয়।
আমরা কেউই কখনো তার ছেলেকে দেখিনি। হিকিকোমরিরা সাধারণত নিজেদেরকে ঘরবন্দী করে রাখে। সমাজের অন্যদের এড়িয়ে চলে। নির্জনতা পছন্দ করে। আত্মকেন্দ্রিক হয়। অবশ্য ছেলের এই অবস্থার কথাটা কখনো সরাসরি বৃদ্ধ দম্পতির মুখ থেকে শুনিনি আমি। আমার ধারণা, তারা হয়তো এটা নিয়ে বাইরের কারোর সাথে কথা বলতে চায়নি। জাপানে এটা নিয়ে সবাই খুব সতর্ক থাকে। লজ্জাজনক মনে করে।

অনেকদিন পেরিয়ে যাওয়ার পরও আমরা কেউ তাদের ছেলেকে দেখতে পাইনি। সত্যি বলতে, ছেলেটা কখনো বাসা থেকে বেরই হয়নি। প্রতিরাতেই আমি ছেলেটার বেডরুম থেকে তার মায়ের ক্ষীপ্ত চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পেতাম। বেচারি মহিলার সাথে দেখা হলে তিনি সবসময়ই হাসিমুখে শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন আমার সাথে। কিন্তু সবসময়ই উনার মুখে একটা ক্লান্তির ছাপ লেগে থাকতো।

এভাবেই প্রায় ছয় বছর পেরিয়ে গেল। এই লম্বা সময়ে কেউই তাদের ছেলেকে দেখতে পায়নি। একদিন, ছেলের বাবা আমার দরজায় টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমি একটু উনাদের বাসায় যেতে পারবো কিনা। তিনি জানতেন যে আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। যেহেতু প্রতিবেশি, তাই আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম যে – যথাসাধ্য উনাদেরকে সাহায্য করবো।
ভদ্রলোকের বাসায় পৌঁছাতেই দেখি ছেলের মা আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। আমি ভিতরে ঢুকতেই আমাকে নিয়ে ছেলের রুমের দিকে পা বাড়ালেন বৃদ্ধা।
রুমের সামনে পৌঁছে দরজায় জোরে করাঘাত করে বললেন, ‘আমরা আসছি ভিতরে!’
তারপর ঝট করে রুমে ঢুকে খেকিয়ে উঠলেন, ‘তুই কি সারাজীবনই ঘুমিয়ে থাকবি নাকি? উঠ, অলস অকর্মা ছেলে কোথাকার!’
আমি কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই মহিলা একটা গলফ ক্লাব তুলে সমানে পিটাতে শুরু করলেন কম্বলে ঢেকে থাকা মানুষটাকে। মুহূর্তের জন্য পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। আর ওদিকে একের পর এক আঘাত করেই যাচ্ছিলেন মহিলা। তারপর ঝট করে মহিলার হাত থেকে গলফ ক্লাবটা কেড়ে নিলাম আমি। মহিলাকে রুম থেকে বের করার জন্য রীতিমতো লড়াই হয়েছে আমাকে।

ছেলেটা কেমন আহত হয়েছে দেখার জন্য তাড়াতাড়ি করে আবার রুমে ঢুকলাম আমি। কিন্তু কম্বলটা টেনে সরাতেই যা দেখলাম… নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। একটা মমিকৃত লাশ ছিলো কম্বলের নিচে।
হতভম্ব হয়ে শুকিয়ে যাওয়ার চামড়া ও হাড়ের স্তুপের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি।
ছেলের বাবা এগিয়ে এলেন আমার দিকে। লজ্জায় মাথা নিচু করে বললেন, ‘আমার স্ত্রীকে দেখানোর জন্যই আপনাকে ডেকে এনেছি। অনেক বছর ধরেই এসব হয়ে আসছে। আমি আর নিতে পারছি না …’ 

( জাপানিজ গল্প অবলম্বনে )