২৪ সেপ্টেম্বর : এক অসম সাহসী বীরাঙ্গনার প্রতি এক ইতিহাস বিস্মৃত বাঙালির শ্রদ্ধাঞ্জলী

pritilata.png

আজ বাঙিালির এক অসম সাহসী নারীর গল্প শুনাবো আপনাদের। ১৯১১ সালের ৫ মে চট্টগ্রামের এক নিভৃত পল্লীতে তাঁর জন্ম।  বাবা-মা আদর করে মেয়ের নাম রেখেছিল রাণী। এই রাণীই একসময় হয়ে উঠলেন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের এক অন্যতম প্রতিভু।  সেই গল্পটাই আজ আপনাদের শুনাবো।

১. শুরুর দিনগুলি:

রাণীর পিতা ছিলেন মিউনিসিপ্যাল অফিসের হেড কেরানী, নাম  জগদ্বন্ধু এবং মাতা প্রতিভাদেবী। তাঁদের ছয় সন্তান। জগদ্বন্ধু বাবু অল্প বয়সে পিতৃহারা হন। তিনি নিজের বাপের ভিটা ডেঙ্গাপাড়া ছেড়ে পটিয়ার ধলঘিাটে তাঁর মামার বাড়িতে আশ্রয় নেন। এখানেই রাণীর জন্ম। চাকুরীর সুবাধে পরবর্তীতে তিনি চট্টগ্রামের আসকার দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি টিনের ছাউনি দেয়া মাটির একটা দোতলা বাড়িতে স্থায়ীভাবে স্বপরিবারে বসবাস করতে থাকেন। অন্তমুর্খী,লাজুক ও চাপা স্বভাবের মেয়ে রাণী সারাদিন কাটতো তাঁর মায়ের সঙ্গে। বলতে গেলে মায়েই তাঁর পড়াশোনার প্রাথমিক শিক্ষাগুরু।

২. শিক্ষাজীবন :

১৯১৮ সালে চট্টগ্রামের ডা: খাস্তগির উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন রাণী। স্কুলে তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল আর্টস এবং সাহিত্য। ১৯২৬ সালে তিনি সংস্কৃত কলাপ পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন। ১৯২৮ সালে কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকার ইডেন কলেজে । ১৯৩০ সালে আই এ তে মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এসময় তিনি মাসিক বিশ টাকা বৃত্তি পান। পরবর্তীতে কলকাতার বেথুন কলেজে অনার্সে ভর্তি হন। বি.এ. তে  তাঁর অন্যতম বিষয় ছিল দর্শন। দর্শনে তাঁর রেজাল্ট ছিল খুব ভালো। এই বিষয়ে  অনার্স করতে চেয়েছিলেন কিন্তু বিপ্লবের সাথে যুক্ত হবার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় অনার্স পরীক্ষা তাঁর আর দেয়া হয়নি। ১৯৩২ সালে ডিসটিংশান নিয়ে তিনি বি.এ. পাশ করেন। রাণীর এক বড় গুন ছিল তিনি খুব ভালো বাঁশি বাজাতে পারতেন্। হোস্টেলে থাকার সময় তাঁর বাশীঁ বাজানো উপভোগ করত কলেজের মেয়েরা। বিপ্লবী দলে যোগ দেয়ার আগে তাঁর অবসর কাটতো লেখালেখি করে। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর অবসর দিনগুলিতে তিনি এক নাটক লিখেন এবং মেয়েরা সবাই মিলে সে নাটক মঞ্চে পরিবেশন করেন। বি এ পরীক্ষার পর চট্টগ্রাম ফিরে আসেন রাণী। এই সময় অর্পণাচরণ দে’র উদ্যোগে নতুন একটি ইংরেজী বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এর প্রধান শিক্ষয়িত্রী পদে নিযুক্ত হন। চট্টগ্রামে আসার কারণ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন-

“১৯৩২ সালে বি এ পরীক্ষার পর মাষ্টারদার সাথে দেখা করবই এই প্রত্যয় নিয়ে বাড়ী ফিরে এলাম”।

৩. স্বদেশী জাতীয়তাবাদের দীক্ষা ও বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ

ঢাকায় সে সময়ে “শ্রীসংঘ” নামে একটি বিপ্লবী সংগঠন ছিল। যার মহিলা শাখার নাম “দীপালী সঙ্ঘ”। সংগঠনটি নারী শিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি গোপনে মেয়েদের বিপ্লবী কাজে অন্তর্ভুক্ত করার কাজও করতো। ইডেন কলেজে পড়ার সময় রাণী সেই সংগঠনের সাথে যুক্ত হন। এসময় রাণী স্কুলের প্রিয় শিক্ষক ঊষাদির কাছ থেকে বিপ্লবের দীক্ষা নিতে থাকেন। ঊষাদির দেয়া “ঝাঁসীর রাণী”,“দেশের কথা”, “বাঘা যতীন”, “ক্ষুদিরাম” আর “কানাইলাল” বইগুলো তাঁর জীবনে রেখাপাত করে। দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদারের কাছে বিপ্লবী সংগঠনে যোগদান করার গভীর ইচ্ছার কথা বলেন। কিন্তু তখনো পর্যন্ত বিপ্লবীদলে মহিলা সদস্য গ্রহণ করা হয়নি।  

৪. মাষ্টারদা সূর্য সেনের সাথে প্রথম সাক্ষাত

দীপালী সঙ্ঘে যোগ দিয়ে রাণী লাঠিখেলা, ছোরাখেলা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষন নেন। পরবর্তীকালে তিনি লিখেছিলেন

“আই এ পড়ার জন্য ঢাকায় দু’বছর থাকার সময় আমি নিজেকে মহান মাস্টারদার একজন উপযুক্ত কমরেড হিসাবে নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়েছি”।

১৯২৯ সালের মে মাসে চট্টগ্রামে সূর্য সেন ও পূর্ণেন্দু দস্তিদারের বিপুল উৎসাহের জন্যই সূর্য সেন নারী সম্মেলন আয়োজনের সম্মতি দেন। চট্টগ্রাম ফিরে এসে রাণী মাষ্টারদার সাথে দেখা করার উদ্যোগ নেন। ১৯৩২ সালের ১৩ জুন চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের অন্যতম প্রধান ঘাঁটি ধলঘাটে এক গোপন আশ্রয় সাবিত্রী দেবীর বাসায় রাণীর সাথে সূর্য সেনের দেখা করার ব্যাবস্থা করা হয়। মাস্টারদার সঙ্গে ছিলেন বিপ্লবী অপূর্ব সেন ও নির্মল সেন।

৫. প্রথম বিপ্লবী কর্মকান্ড: ধলঘাট সংঘর্ষ

মাস্টারদার সাথে রাণীর আলাপ পরিচয়ের সময় সাবিত্রী দেবীর এক প্রতিবেশি অর্থলোভে ধলঘাটে অবস্থিত পুলিশ-মিলিটারির ক্যাম্পে খবর দেয়। পুলিশ এসে বাড়ী ঘিরে ফেললে নির্মল সেন তাদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে মারা যান। এই যুদ্ধে নিহত হন ব্রিটিশ মিলিটারির ক্যাপটেন ক্যামেরন। পালাতে যেয়ে গুলি লেগে মারা যান অপূর্ব সেন। মাস্টারদা ও রাণী কোন মতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। আশ্রয় দেয়ার অপরাধে সাবিত্রী দেবী ও তার ছেলের চার বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়।

৬.আত্মগোপনের সময়গুলি

ধলঘাট যুদ্ধের পরে রাণী আবার পিত্রালয়ে ফিরে এসে স্কুলে শিক্ষাকতা করতে থাকেন। সাবিত্রী দেবীর ঘরের ভেতর চালানো তল্লাশীতে রিভলবার, রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের দুইটা ছবি, পাশাপাশি দুইটা মেয়ের ছবি (যার মধ্যে একজন ছিল রাণী) সহ কিছু চিঠি এবং দুইটা বইয়ের পান্ডুলিপি পাওয়া যায়। ১৯ জুন পুলিশ বাসায় গিয়ে রাণীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ২২ জুন এস.আই শৈলেন্দ্র সেনগুপ্ত এর নেতৃত্বে একটি দল সাবিত্রী দেবীর বাড়ি এবং তার আশেপাশে আরেক দফা তল্লাশি চালিয়ে বিপ্লবীদের মতবাদ সম্পর্কিত নানা কাগজপত্র এবং সামরিক প্রশিক্ষনের নানা সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।  এসময় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ফাঁসির প্রতীক্ষারত রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে সাক্ষাতের জন্য রাণীর হাতে লেখা একটা বিবরন পাওয়া যায়। ঐ হাতের লেখা মেলানোর জন্য ৩০ জুন রাণীর বাসা থেকে পুলিশ তাঁর গানের একটা বই নিয়ে যায়। মাষ্টারদা রাণীকে আত্মগোপনের নির্দেশ দেন। ৫ জুলাই মনিলাল দত্ত এবং বীরেশ্বর রায়ের সাথে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে রাণী আত্মগোপন করে।

৭. বৃটিশ সরকার কর্তৃক্ গ্রেফতারি পরোয়ানা

রাণীর আত্মগোপনের খবর ১৩ জুলাই ১৯৩২ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। “চট্টগ্রামের পলাতকা” শিরোনামে রাণীর অন্তর্ধানের খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। রাণীকে ধরার জন্য বেঙ্গল পুলিশের সি আই ডি কর্তৃক প্রকাশিত ছবিসহ রাণীর বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে পুরস্কারসহ নোটিশ সারা দেশে বিলি করা হয়।

৮. ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ

১৯৩০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সালের চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অন্যতম কার্যসূচি ছিল চট্টগ্রামের দামপাড়া ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নেয়া। এই ইউরোপীয়ান ক্লাবে তখন স্বদেশীয়দের প্রবশাধিকার ছিল না। সূর্য সেন সিদ্ধান্ত নেন ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণে নেতৃত্ব দেবেন ‘রাণী’ । তাঁকে পাঞ্জাবী ছেলেদের মত পোষাক পড়ানো হলো। রানীর নেতৃত্বে সাতজনের এই দল ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ করে। হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেবার পরেই ঘন ঘন গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব কেঁপে কেঁপে উঠছিল। হঠাৎ ক্লাবঘরের সব বাতি নিভে গেল। সবাই অন্ধকারে ছুটোছুটি করতে লাগল। ক্লাবে কয়েকজন ইংরেজ অফিসারের কাছে রিভলবার ছিল। তাঁরা পাল্টা আক্রমণ করল। একজন মিলিটারী অফিসারের রিভলবারের গুলিতে রাণীর বাঁ-পাশে গুলির আঘাত লাগে। রাণীর নির্দেশে আক্রমণ শেষ করে পালিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন।

৯. অত:পর অন্য বিপ্লবীদের জীবন রক্ষার্থে আত্মদান

সকলেই নিরাপদে ফিরে এলেন, ফিরে এলেন না দলনেতা। ধরা পড়ার অপমান ঠেকাতে ‘পটাশিয়াম সায়ানাইড’ খেয়ে আত্মদান করলেন। পরের দিন পুলিশ ক্লাবের পাশে পড়ে থাকা লাশকে পুরুষ ভেবেছিল। কিন্তু মাথার পাগড়ি খুলে লম্বা চুল দেখে শুধু ব্রিটিশ পুলিশ নয়, গোটা ব্রিটিশ সরকারই নড়েচড়ে উঠল। আলোড়িত হলো গোটা ভারতবাসী। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রথম এক বাঙালি নারীর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে রচিত হল ইতিহাস।

১০.মায়ের কাছে রাণীর শেষ চিঠি:

শেষ চিঠিতে রাণী মাকে জানায়,

‘মাগো, অমন করে কেঁদোনা! আমি যে সত্যের জন্য, স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে এসেছি, তুমি কি তাতে আনন্দ পাও না? কী করব মা? দেশ যে পরাধীন! দেশবাসী বিদেশির অত্যাচারে জর্জরিত! দেশমাতৃকা যে শৃঙ্খলভাবে অবনতা, লাঞ্ছিতা, অবমানিতা!তুমি কি সবই নীরবে সহ্য করবে মা? একটি সন্তানকেও কি তুমি মুক্তির জন্য উত্সর্গ করতে পারবে না? তুমি কি কেবলই কাঁদবে?’

ধলঘাটের কাঁদামাটি মেখে বড় হওয়া মায়ের আদরের লাজুক, মৃদুভাষিণী সেই রাণী কখন যে সবার ভালোবাসার মেয়ে  প্রীতিলতা হয়ে উঠলো মা জানতেও পারেননি।

আজ সেই প্রতিলতার প্রয়ান দিবস। আজো আমরা ২৪সেপ্টেম্বর ঘটা করে প্রীতিলতাকে স্মরণ করি। যুগে যুগে সব মায়েদের ঘরে ভয়ডরহীন প্রীতিলতারা জন্মায় বলে, তাদের আত্মত্যাগে আমরা পায় একটি স্বাধীন ভূমি। তাইতো প্রীতিলতারা কখনো হারিয়ে না। হারতে শেখে না তারা। তারা চিরঅবিনশ্বর।

আজ এই লেখার মধ্য দিয়ে প্রীতিলতার সাথে সাথে সকল সংগ্রামী নারীকে এক ইতিহাস বিস্মৃত বাঙালির বিনম্রচিত্ত শ্রদ্ধাঞ্জলী ।