সত্যজিৎ- চিত্রপ্রেমী থেকে চিত্র নির্মাতা

এই পৃথিবীতে বাস করে সত্যজি রায়ের চলচ্চিত্র না দেখা চন্দ্র-সূর্য না দেখার মতোই অদ্ভুত ঘটনা।

কথাটি বেরিয়েছে আকিরা কুরাশাওয়ার কণ্ঠ থেকে।

আকিরা কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘রাশোমন’ এর পরিচালক।  

সত্যজিত যে মহীরুহ হবেন, এ অবধারিত ছিল। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পৌত্র আর সুকুমার রায়ের পুত্র যদি এলেবেলে কেউ হন, সেটাই বরং অস্বাভাবিক।

তাই বলে আবার ভাববেন না বাপ দাদার নাম বেচে খেয়েছেন তিনি; বরং উল্টোটাই সত্যি বলা চলে। বাপ দাদাকে ছাড়িয়ে আপন মহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠেছেন সত্যজিত।

অসামান্য প্রতিভাধর এই মানুষটির জন্ম ১৯২১ সালে। তাঁর জন্মের মাত্র তৃতীয় বছরেই মারা যান সুকুমার রায়। এর তিন বছরের মাথায় বাবা এবং দাদুর চালানো পারিবারিক প্রেসটি তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। কলকাতা ছেড়ে সত্যজিত মায়ের সাথে চলে যান বালিগঞ্জে মামা বাড়িতে। সেখান থেকে তিনি পনের বছর বয়সে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাশ করেন।

স্কুলে থাকতেই, বন্ধুরা যখন ঠাকুরমার ঝুলিতে মশগুল সত্যজিৎ তখন “Picturegoer” এবং “Photoplay”তে মজে আছেন।

মা বললেন, বিজ্ঞান পড়তে হবে। তাই সত্যজিত প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞানে ভর্তি হলেন। দুই বছর পড়লেনও। এরপর এক আত্মীয় কথা দিলেন অর্থনীতি পড়লে তিনি সত্যজিৎকে একটা কাজ দিতে পারেন। তাই তৃতীয় বর্ষে তিনি বিভাগ পরিবর্তন করে অর্থনীতি নিয়ে পড়া শুরু করলেন। ১৮ বছর বয়সে হয়ে গেলেন গ্রাজুয়েট। আটপৌরে সত্যজিতের এখানেই সমাপ্তি।

ছবি আঁকার হাত তাঁর বরাবর ভাল। তিনি চেয়েছিলেন বাণিজ্যিক চিত্রকর হবেন। আবারো মা বললেন, বয়স বড্ড কম। চাকরী করার আগে তুমি বরং একটু লেখাপড়া করে নাও ওই ছবি আঁকার ব্যাপারে।

মায়ের ইচ্ছে, তিনি শান্তি নিকেতনে পড়েন। শান্তিনিকেতন তথা রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যাবস্থার প্রতি খুব একটা শ্রদ্ধা ছিলনা, তবে কবিগুরুর প্রতি ছিল প্রগাঢ় শ্রদ্ধা। তাই শেষমেশ কলকাতাপ্রেমী সত্যজিৎ পড়তে গেলেন শান্তি নিকেতন।অজন্তা, ইলোরা আর এলিফ্যান্টায় ঘুরে প্রাচ্যের শিল্পের প্রতি নতুন শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হল তার মনে।

শান্তিনিকেতনের পড়ালেখার পাঠ না চুকিয়েই ১৯৪৩ এ তিনি ফেরত এলেন কলকাতা। ব্রিটিশ বিজ্ঞাপনী সংস্থা ডি যে কেমারে ৮০ টাকা বেতনে। যোগ দিলেন জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার হিসেবে। পছন্দের কাজ, তার উপর রীতিমত আদরেই ছিলেন তিনি সেখানে। যদিও ইংরেজ কর্মচারীদের চেয়ে কম বেতন পাওয়ায় ভারতীয় কর্মচারীদের মধ্যে চাপা একটা উত্তেজনা ছিল, সত্যজিত তা নিয়ে মাথা ঘামাননি।

১৯৫০ সালে ডি জে  কেমার সত্যজিৎকে লন্ডন পাঠায় তাদের প্রধান কার্যালয়ে কাজ করতে। তিন মাস ছিলেন লন্ডনে, এই সময় তিনি ৯৯টি সিনেমা দেখেন। তার মধ্যে একটা ছিল বিখ্যাত ‘বাইসাইকেল থিফ।’ সিনেমাটি দেখে থিয়েটার থেকে বেরনোর সময় সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেললেন সত্যজিত- তিনি চলচ্চিত্র নির্মাতা হবেন।

সিনেমা বানাবেন, তার জন্য একজন ক্যামেরাম্যান চাই। জুটে গেলেন সুব্রত মিত্র। প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে সাথে পেলেন অনীল চৌধুরীকে। সত্যজিত সিনেমা বানাবেন, সে সিনেমার গল্প যেনতেন গল্প হলে চলবেনা। সত্যজিত তার প্রথম সিনেমার গল্প হিসেবে বেছে নিলেন বিভূতিভূষণের বিখ্যাত ‘পথের পাঁচালি।’ এই বইয়ের ভিতরের ছবিগুলো সত্যজিতের নিজের আঁকা ছিল, পরবর্তীতে তিনি সেগুলোকে শটে রুপান্তরিত করেন।

সিনেমা বানানো খরচের ব্যাপার। কিন্তু সত্যজিৎ তো বানিজ্যিক ছবি বানাচ্ছেন না, অর্থ লগ্নি করবে কে? তবুও সাহস করে গাঁটের পয়সায় শুটিং শুরু করলেন সত্যজিত। পয়সা আসছে দুজনের পকেট থেকে- স্বয়ং সত্যজিত আর তার প্রোডাকশন ম্যানেজার অনীল চৌধুরী।

সিনেমার কলাকুশলীরা কেউ পেশাদার নন। সিনেমায় জলসা মাতানো গান নেই। তবুও সত্যজিৎ আশা করেছিলেন যেটুকু কাজ হয় সেটুকু দেখালে কেউ না কেউ অর্থ লগ্নি করতে উতসাহী হবেন।

কিন্তু কেউ হলেন না।  দুএকজন বললেন সিনেমার করুণ সমাপ্তিকে বদলে সুখী একটা সমাপ্তি দিতে রাজি হলে তারা টাকা দিতে পারেন। কিন্তু সত্যজিত অনড়, চিত্রনাট্যে তিনি পরিবর্তন আনবেন না। তাই ‘পথের পাঁচালি’ সাড়ে তিন বছর সময় নিল সিনেমা হয়ে উঠতে। শেষ পর্যন্ত কাজ শেষ হল পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে ঋণ নিয়ে।

‘পথের পাঁচালি’ মুক্তি পেয়েই সাড়া ফেলে দিল। মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করলেন বোদ্ধারা। ‘পথের পাঁচালি’ এর পথ ধরে সত্যজিত রায় আরও নির্মাণ করেলেন ‘অপরাজিত’ আর ‘অপুর সংসার।’

আজ শুধু নির্মাতা সত্যজিৎকে নিয়েই কথা হোক, এক লেখায় নির্মাতা আর লেখক সত্যজিতকে তুলে ধরা বাতুলতা। সত্যজিতের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন শুধু ভারতীয় নন গোটা পৃথিবীর নামকরা সব নির্মাতারা। পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা। আজ পর্যন্ত কোন ভারতীয় সিনেমার কপালে অস্কার না জুটলেও নির্মাতা সত্যজিৎ ঠিকই অস্কার জিতেছেন।

সত্যজিৎ তার নির্মাণ নিয়ে এমন খুঁতখুঁতে ছিলেন যে সহকর্মীরা মাঝে মাঝে অতিষ্ঠ হয়ে যেত। সত্যজিতের নোটখাতায় নাকি কোনবেলায় কোন দৃশ্যের শুটিং হবে, কোন দিকে থেকে নায়িকার গায়ে আলো পড়বে, সেজন্য কোন রঙের শাড়ি থেকে শুরু করে কানের দুল পর্যন্ত পরতে হবে সব স্কেচ করা থাকত।

শুটিং সেটের একটা গল্প দিয়েই আজকের মত সত্যজিৎ বন্দনা শেষ করা যাক।

তখন ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ এর শুটিং চলছে। সত্যজিতের খুঁতখুঁতানিতে অতিষ্ঠ হয়ে ইউনিট ম্যনেজার একবার সিদ্ধান্ত নিলেন, আজ একহাত না নিলেই নয় সত্যজিতের সাথে। তিনি করলেন কি, ইউনিট শুটিং এ জায়গায় যাওয়ার  আগেই ইচ্ছে করে ভুতের রাজার দেয়া জুতোজোড়া বের করে রেখে গেলেন। জুতো ছাড়া গুপি-বাঘার শুটিং চলবেনা, সত্যজিৎ বাধ্য হবেন শুটিং বন্ধ রাখতে। হুট করে অমন জুতোও আর জোগাড় করা যাবে না।

শুটিং স্পটে গিয়ে বাক্স খুলে জিনিসপত্র বের করা হল। জুতো খুঁজে না পেয়ে ইউনিটের লোকজন হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দিয়েছে। এমন সময় সত্যজিৎ হাজির হলেন। কেউ তাকে ঘটনা বলতে চায়না। অবশেষে একজন সাহস করে বলেই ফেলল, ‘জুতোজোড়া খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।’

কি ভাবছেন? সত্যজিৎ রেগে বোম হয়ে গিয়েছিলেন?

সত্যজিৎ চোখের পাতাও ফেললেন না, শান্ত গলায় বললেন- ‘ওই ওখানে যে বাক্সগুলো রাখা, ওখান থেকে তিন নম্বর বাক্সটা খোল। ওর মধ্যে একই রকম আরেক জোড়া জুতো রাখা আছে। ওটা নিয়ে এখনি শুটিং শুরু করগে।’ 

লেখকঃ মাহফুজুর রহমান, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।