খ্যাতির আড়ালের বেদনা- ১০ শীর্ষ বিজ্ঞানীর আত্মহত্যা ও অন্যান্য

%e5%89%b5%e6%a5%ad%e8%9e%8d%e8%b3%87%e5%b0%81%e9%9d%a2-810x540

১। এলান টুরিং

এলান টুরিং একজন ইংরেজ বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, যুক্তিবিদ এবং সাংকেতিক লিপি বিশারদ। কারো কারো মতে তিনি  বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় বৃটিশ বিজ্ঞানী ছিলেন। আধুনিক কম্পিউটারের জনক হিসেবেও তিনি বিবেচিত।  টুরিং এলগরিদমের ধারণা নিয়মমাফিক পদ্ধতিতে সন্নিবেশিত করেন এবং তার আবিষ্কৃত টুরিং  মেশিনের মাধ্যমে তা গণনার কাজে ব্যবহার করেন। টুরিং টেস্টের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ ধারণা প্রদান করেন যার মাধ্যমে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, তার এ মেশিন সচেতনতা এবং চিন্তা করার সক্ষমতা অর্জনে সক্ষম। পরে তিনি ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরীতে কাজ করেন এবং সেখানে তিনি একটি সংরক্ষিত প্রোগ্রাম কম্পিউটারের নকশা তৈরি করেন। অবশ্য সেখানে তার পক্ষে তৈরি করা সম্ভব হয়নি। ১৯৪৮ সালে তিনি ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন এবং এই সময়েই তিনি MARK-I কম্পিউটার উদ্ভাবনের সাথে যুক্ত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি Bletchey Park, Britain’s Code Breaking Center, Hut-8 প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। ১৯৫২ সালে সমকামিতার জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং তার বায়োলজিক্যালভাবে দৈহিক পরিবর্তনের জন্য বাধ্য করা হয়। এ ব্যবস্থা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ছিল। সেসময় বৃটেনে সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হত। ১৯৫৪ সালের ৮ জুন অসহ্য যন্ত্রনা  সহ্য করতে না পেরে সায়ানাইড মিশ্রিত আপেল খেয়ে আত্মহত্যা করেন।

২। ওয়ারলেস ক্যারোথারাস

ওয়ারলেস হিউম ক্যারোথারাস্ একজন আমেরিকাল রসায়নবিদ ছিলেন। তিনি নাইলন আবিষ্কার করেন। তিনি Dupont’s পরীক্ষা কেন্দ্রে গঠিত গবেষণাগ্রুপের নেতা ছিলেন। এই গবেষণা কেন্দ্রটি ছিল Wlmington এর কাছাকাছি। যেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পলিমার নিয়ে গবেষণা করা হয়। এখানেই প্রথম নাইলনের প্রক্রিয়া উদ্ভাবিত হয় যা সিনথেটিক  পলিমার উদ্ভাবনের  প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। পিএইচডি ডিগ্রি প্রাপ্তির পর  Dupont কোম্পানি তাকে মৌলিক গবেষণার  কাজে নিযুক্ত করেন। এর পূর্বে তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তার বিস্ময়কর আবিষ্কারের পর ক্যারোথারাস্ কোন নতুন আবিষ্কারে ভূমিকা রাখতে না পারায়  তিনি বিষন্নতায় ভুগতে থাকেন। এই সময় তার বোনের আকস্মিক মৃত্যু হয়। এর কিছুদিন পর ১৯৩৭ সালে ক্যারোথারাস্ বিষ পান করে আত্মহত্যা করেন। সেসময় তার বয়স ছিল ৪১ বছর।

৩। জর্জ ইস্টম্যান

১৮৫৪ সালে জর্জ ইস্টম্যান নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কোডাক কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা এবং রোল ফিল্মের উদ্ভাবক। তিনি ফটোগ্রাফিকে মূলধারার সাথে যুক্ত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৮৮৮ সালে তিনি চলচ্চিত্র উদ্ভাবনের মূল সূত্র হিসেবে কাজ করেন। ১৮৭৪ সালে তিনি এমন এক চক্রান্তের শিকার হন যেখানে ফটোগ্রাফিতে আনাড়ি এক পদ্ধতি ব্যবহার চালু হয়। এ পদ্ধতিতে একটি কাঁচের প্লেটের ওপর তরল ইমালসনের প্রলেপ দেয়া হয় যেটি ব্যবহারের পূর্বে শুকনো রাখতে হত। ১৮৮৪ সালে তিনি একটি ফোটোগ্রাফিক মিডিয়াম পেটেন্ট করেন যেখানে ভঙ্গুর কাঁচের প্লেটের ওপর ফোটো ইমালসনের সাথে কাগজের রোলের প্রলেপের ব্যবস্থা রাখা হয়। এই ফিল্ম রোল উদ্ভাবনের মাধ্যমে মাল্টিপল ইমেজ রেকর্ডিং তৈরির প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়এবং ১৯৮৮ সালে ৪ সেপ্টেম্বর ইস্টম্যান ট্রেডমার্ক কোডাক নিবন্ধিত করেন। ১৯৩২ সালে ইস্টম্যান আত্মহত্যা করেন। তিনি তার সুইসাইড নোটে লিখে যান,‘আমার কাজ সম্পন্ন। তবে কেন এত অপেক্ষা ? ’ নিউইয়র্কের রচেস্টার শহরে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।

৪। নিকোলাস ল্যাবেঙ্ক

নিকোলাস ল্যাবেঙ্ক একজন ফরাসি রসায়নবিদ ও সার্জন ছিলেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যে সাধারণ লবন  থেকে সোডা তৈরির প্রক্রিয়া আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত হয়েছিলেন। ১৭৪২ সালে তার জন্ম। তরুন বয়সে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রতি উৎসাহী ছিলেন। ১৭৫৯ সালে তিনি প্যারিস কলেজ অব সার্জান্স-এ ভর্তি হন। ১৭৮০ সালে ডিউক অব অরলিন্স এর লুই ফিলিপ (দ্বিতীয়) এর পারিবারিক চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৭৭৫ সালে ফান্সের সায়েন্স একাডেমী লবন থেকে সোডা উৎপাদনের প্রক্রিয়া আবিষ্কারের জন্য তাকে পুরস্কৃত করা হয়। ফরাসি একাডেমী তার এই সোডা উৎপাদনের প্রক্রিয়া দেশব্যাপী প্রচারণা চালাতে সচেষ্ঠ ছিল। ১৯৯১ সালে ল্যাবেঙ্ক একটি প্লান্ট স্থাপন করেন যেখানে ২ ধাপে লবন থেকে সোডিয়াম উৎপাদনের ব্যবস্থা রাখা হয়। কিন্তু ২ বছর পর ফরাসি বিপ্লবী সরকার নিকোলাস ল্যাবেঙ্ককে তার সোডা তৈরির প্লান্ট বন্ধ করে দেয় এবং তার পুরস্কারের অর্থ প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়। এর সাথে তার পূর্বের ১০ বছরের প্রাপ্ত অর্থ বাজেয়াপ্ত করে। ১৮০২ সালে নেপোলিয়ন ল্যাবেঙ্ককে তার প্লান্টে কাজ করার অনুমতি প্রদান করে। কিন্তু তখন তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তার আর প্লান্ট চালানোর মত সামর্থ্য ছিল না। ১৮০৬ সাল তিনি আত্মহত্যা করেন।

৫। এডউইন আর্মস্ট্রং

এডউইন আর্মস্ট্রং ১৮৯০ সালের ১৮ই ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পেশায় ছিলেন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তিনিই এফএম রেডিও উদ্ভাবন করেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে এফএম রেডিও এর ধারণা দেন এবং এ নিয়ে কাজ শুরু করেন। ১৯৪১ সালে তিনি তার এই উদ্ভাবনকে পেটেন্ট করেন। সেসময় অনেকেই এই পেটেন্টের বিরোধী ছিলেন। এমনকি আমেরিকান রেডিও কর্পোরেশন এটি বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা নেয়। তাদের ধারনা ছিল এর ফলে এম রেডিও এর কার্যক্রম ঝুঁকির মুখে পড়বে এবং এম রেডিওর অগ্রগতি ধ্বংস হয়ে যাবে। কাজেই তারা এফএম রেডিওর কার্যক্রমে বাঁধা প্রদান করে এবং এফএম রেডিও যাতে সফল না হয় তার জন্য নানারকম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। ১৯৫৮ সালে  এই বিজ্ঞানী তার এপার্টমেন্টের ১৩ তলা হতে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তখন তার বয়স ৬৩ বছর।

৬। হান্স বার্জার

হান্স বার্জার ১৮৭৩ সালে জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেন। পেশায় তিনি ছিলেন সাইক্রেটিস্ট। ইলেক্ট্রএনসেফ্যালোগ্রামের (EEGs) আবিষ্কারক হিসেবে কার অবদান অনস্বীকার্য। সেসময় স্নায়ু তন্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বিভিন্ন যন্ত্র উদ্ভাবন করেন যা মস্তিষ্কে আবর্তিত আলফা তরঙ্গের ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। জিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে তিনি মেডিসিন, নিউরোলজি, মনোরোগ বিদ্যা এবং মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীকালে তিনি স্নায়ু বিজ্ঞানের উপর মনোনিবেশ করেন এবং বৃটিশ বিজ্ঞানী রিচার্ড ক্যাটনের সাথে যুক্ত হয়ে পশুদের নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯২৪ সালে (EEGs) পরীক্ষার মাধ্যমে অত্যন্ত সফলভাবে প্রথম মানুষের মস্তিষ্কের স্নায়ুর সার্বিক কার্যক্রম লিপিবদ্ধ করতে সক্ষম হন। নাৎসিবাদের উত্থান এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে তিনি বিরক্ত এবং মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ১৯৪১ সালে নিজের বাসায় দড়িতে ঝুলে আত্মহত্যা করেন।

৭। ভ্যালেরি লিগাসভ

ভ্যালেরি আলেকভিক লিগাসভ্ একজন সোভিয়েত বিজ্ঞানী ছিলেন। ইউএসএসআর বিজ্ঞান একাডেমীর সদস্য ছিলেন তিনি। ২৬ এপ্রিল ১৯৮৬ সালে সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে তিনি চেরনোবিল দুঘর্টনার তদন্ত কমিটির প্রধান হিসেবে চেরনোবিল বিপর্যয়ের কারন অনুসন্ধান সম্পর্কিত যে রিপোর্ট প্রদান করেন তা তৎকালীন সোভিয়েত সরকারের জন্য ছিল অস্বস্তিকর। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের কাছে তার এই রিপোর্ট প্রশংসিত হয়। ১৮৮৬-৮৭ সালে তার কাজের জন্য সমাজতান্ত্রিক শ্রম হিরো হিসেবে তার নাম দুইবার ঘোষিত হলেও প্রতিবারই প্রত্যাখ্যাত হন। এসব ঘটনায় তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। প্রচন্ড বিষন্নতায় ভুগতে থাকেন। এতে তার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। ১৯৮৮ সালের ২৭ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

৮। লুডউইগ বোল্টস্ম্যান

লুডউইগ বোল্টস্ম্যান একজন অস্ট্রীয় পদার্থ বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি পরিসংখ্যানগত বলবিদ্যা এবং তাপবিদ্যার ক্ষেত্রে ব্যপক অবদান রাখেন। মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি পিএইচডি লাভ করেনএবং ২৫ বছর বয়সে গ্রাস বিশ্ববিদ্যালয়ে গাণিতিক পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৮৯৩ সালে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে সফলতা অর্জন করেন। পরবর্তীকালে তিনি মানসিক ব্যাধিতে ভুগতে থাকেন এবং এক ছুটির দিনে নিজের বাড়িতে আত্মহত্যা করেন।

৯। ডেভিড ক্যালি

ডেভিড ক্যালি যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ে কর্মরত ছিলেন। তিনি বায়োলজিক্যাল সমরাস্ত্র বিশেষজ্ঞ  ছিলেন। ইরাকের অস্ত্রভান্ডার পরিদর্শনে তিনি একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। তৎকালীন ব্লেসরকার কর্তৃক সংকলিত ইরাকের  গণবিধ্বংসী অস্ত্র বিষয়ক দলিলগুচ্ছের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেন যা ব্লেয়ার সরকারের রাজনৈতিক কলঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত। এ নিয়ে সংসদীয় কমিটি তাকে ভৎসনা করে। ২০০৩ সালের ১৭ জুলাই অক্সফোর্ডসায়রের কাছে তার দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। সরকারী প্রতিবেদন অনুযায়ী তিনি ২৯ডট ব্যথানাশক ঔষধ সেবন করেছিলেন। তার মৃত্যুর সঠিক কারণ এখনও উদঘাটিত হয়নি।

১০. ভিক্টর মেয়ার

ভিক্টর মেয়ার একজন রসায়নবিদ ছিলেন। জৈব  এবং অজৈব রসায়নে তার উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। ১৯৪৮ সালে তিনি বার্লিনে জন্মগ্রহণ করেন। বাষ্প ঘনত্বের একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেন তিনি। তিনি কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন এবং দীর্ঘক্ষণ ল্যাবে কাজ করতেন। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে এই প্রতিভাধর রসায়নবিদ ১৮৯৭ সালে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে সায়ানাইড খেয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

লেখিকা সম্পর্কেঃ পাপিয়া দেবী অশ্রু। শখ -বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে বেড়ানো, গান করা, ছবি আঁকা। লেখা – লিখিতে বেশ আগ্রহ থাকলেও তেমন ঘটা করে হয়ে উঠেনি কখনও। শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত আছি। ইচ্ছে আছে একেবারেই নতুন কিছু করার, যা বিশ্বজুড়ে সবার দেখার মতই। অদ্ভুত ইচ্ছে!!!