‘মুঘল-ই-আজম’ মুভি সম্পর্কে কিছু দুর্দান্ত ফ্যাক্টস

এমনটা খুব কমই দেখা গেছে যখন একটা চলচিত্রই একটা স্ট্যান্ডার্ডের জন্ম দেয়। কে. আসিফে’র মুঘল-ই-আজম এমনই একটি চলচিত্র। যখনই বলিউডের গত ১০০ বছরের সেরা কাজের কথা আলোচনায় আসে, ‘মুঘল-ই-আজম সেই তালিকায় প্রথম দিকেই থাকে সব সময়। প্রযোজকের নির্ভেজাল উচ্চাকাঙ্খা, আসিফের দূরদর্শিতা আর ছোটখাটো ব্যাপারগুলোও পর্দায় বিস্তারিত দেখানোর সুনিপুণ পরিচালকীয় দক্ষতার কারণে ১৯৬০ সালে চলচিত্রটি মুক্তির পরে ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল।

আলফোনসো কুরোন যখন ‘গ্র্যাভিটি’ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় টেকনোলজি ডেভলপ করছিল, কিংবা জেমস ক্যামেরন যে কিনা পাক্কা ছয় বছর লাগিয়েছিল থ্রিডি তে ‘অ্যাভাটার’ ধারণ করতে অথবা দীর্ঘ বারো বছর ধরে একটু একটু করে ‘বয়হুড’-এর শ্যুটিং করা রিচার্ড লিংকলেইটার– এদেরও অনেক আগে কে. আসিফ তার পারফেক্টশনের অবসেশনকে নতুন একটা স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন।
চলুন জেনে নেয়া যাক বলিউডে নতুন ক্রেজের জন্ম দেয়া গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সিনেমা ‘মুঘল-ই-আজম’ সম্পর্কে কিছু অজানা বিষয়-

১। চলচিত্রটির প্রোডাক্টশান পিরিয়ড ছিল প্রায় ১৬ বছর (বলিউডের ইতিহাসের দীর্ঘতম)।
১৯২২ সালে ইমতিয়াজ আলী তাজ রচিত মঞ্চ নাটক ‘মুঘল-ই-আজম’ অবলম্বনে ১৯৪৪ সালে ডিরেক্টর কে. আসিফ প্রথম চলচিত্রটি তৈরির পরিকল্পনা করেন। তিনি স্ক্রিপ্ট লেখার কাজে তাকে সহযোগিতা করার জন্য আমানউল্লাহ খান, ওয়াজাহাত মির্জা আর কামাল আমরোহীকে নিয়োগ দেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরে প্রডিউসার সিরাজ আলী খান পাকিস্তানে চলে যান। তবে যাবার আগে তিনি হীরা ব্যবসায়ী শাপূরজী পালোনজী মিস্ত্রীর কথা আসিফকে বলে যান, যার সাথে আসিফ প্রায় পরের এক যুগ ধরে নানা ঝড়-ঝাপটা সামলে অবশেষে ১৯৬০ সালের ৫ই আগস্ট চলচিত্রটি মুক্তি দেন।

২। নির্মাণ ব্যয় ছিল প্রায় দেড় কোটি রুপি (১৯৫০ সালে), প্রযোজক ছিলেন প্রায় দেউলিয়া হবার পথে!
তৎকালীন ভারতবর্ষের সবচেয়ে ব্যববহুল সিনেমা ছিল এটি। তবে স্বস্তির ব্যাপার হচ্ছে সিনেমাটি টানা ২৫ সপ্তাহ হলে চলেছিল। তখনকার সময়ে মুঘল-ই-আজমের নেট ইনকাম ছিল প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি রুপি, এখনকার টাকার মানে কনভার্ট করলে যেটা দাঁড়ায় প্রায় ১৩২ কোটি টাকা! তো বলতে পারেন, মুঘল-ই-আজম ই ছিল বলিউডের প্রথম ১০০ কোটি রুপির বেশি আয় করা সিনেমা।

৩। এ মোহাব্বত জিন্দেবাদ গানে ১০০-রও বেশি কোরাস শিল্পী ছিল।
সর্বদাই বাস্তবতা খোঁজা আর অসম্ভবকে সম্ভব করায় বিশ্বাসী আসিফ আর নওশাদ মিলে ১০০-রও বেশি ব্যাকাপ সিঙ্গার জোগাড় করেছিলেন যারা ‘এ মোহাব্বত জিন্দাবাদ’ গানটিতে লিড ভোকাল মোহাম্মদ রাফি’র সাথে সাথে কোরাস গেয়েছিল।
 

৪। শীষ মহল তৈরি করতে সময় লেগেছিল ২ বছর, গ্লাস আনা হয়েছিল বেলজিয়াম থেকে।
গত শতাব্দীর সেরা জনপ্রিয় গান ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া’র সেটটি তৈরি হয়েছিল লাহোর কেল্লার আদলে, সেট সাজিয়েছিলেন আর্ট ডিরেক্টর এম কে সায়েদ। এতে খরচ হয়েছিল প্রায় ১৫ লাখ রুপি (যা ছিল সিনেমাটির মূল বাজেটের ১০ শতাংশ)। মোহন স্টুডিও তে সেটটি শুধু বসাতেই সময় লেগেছিল ছয় সপ্তাহ। শ্যুটিং শেষ হবার ছয় মাস পরেও সেটটি সরানো হয় নি, কারণ তখনও দেশের নানা প্রান্ত থেকে লোকজন সেটটি দেখতে আসত!

৫। নওশাদ এবং গীতিকার শাকিল বাদাউনি মিলে পেয়ার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া গানটি চূড়ান্ত করার আগে এর প্রায় ১১০ টি খসড়া তৈরি করেছিলেন!
লেজেন্ডারি মিউজিক ডিরেক্টর নওশাদ একবার এক টিভি শো তে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া’ গানের মূল ভার্সনটি চূড়ান্ত করার আগে তিনি আর গীতিকার শাকিল বাদাউনি নিজেদেরকে বেশ কয়েকদিন একটা বদ্ধ কামরায় আটকে রেখেছিলেন। এই সময়ে তারা গানটির প্রায় ১১০ টি খসড়া প্রস্তুত করেন এবং সবশষে গিয়ে মূল ভার্সনটি চূড়ান্ত করেন।

https://www.youtube.com/watch?time_continue=1&v=TdOS-0sIW-Y

৬। বাড়ে (বড়) গুলাম আলী খান সাহেব ডিরেক্টর কে. আসিফের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে পারেন নি!
কথিত আছে যে বাড়ে (বড়) গুলাম আলী খান সাহেব সিনেমাটির জন্য প্রথমে গাইতে রাজি ছিলেন না, কারণ তার কাছে গানগুলো তেমন মান সম্মত মনে হয়নি! তবে ডিরেক্টর কে. আসিফও ছিলেন নাছোড়বান্দা, যে কোন মূল্যেই তিনি এই লেজেন্ডারি ক্লাসিক্যাল সিঙ্গারের বলিউড ডেব্যু তার সিনেমাতেই করাতে চেয়েছিলেন। গায়কীর সম্মানী হিসাবে তিনি ২৫,০০০ রুপি সেধে বসলেন, লতা মুঙ্গেশকরের মত স্টার সিঙ্গারও তখন মাত্র ৩০০-৪০০ রুপির বিনিময়ে গাইত! স্বভাবতই খান সাহেব আসিফের অফারটি রিফিউজ করতে পারেন নি।

৭। যুদ্ধের দৃশ্যগুলো বাস্তবসম্মত করার জন্য ইন্ডিয়ার আর্মি থেকে বেশ কিছু সত্যিকারের সৈনিক ব্যবহার করা হয়েছিল।
কে. আসিফের নিখাদ প্যাশনের আরেকটি উদারহরণ হচ্ছে যুদ্ধের দৃশ্যগুলোর চিত্রায়ন। যুদ্ধের দৃশ্যগুলো অধিক বাস্তবসম্মত দেখানোর জন্য তিনি ইন্ডিয়ান আর্মি থেকে কিছু সত্যিকারের সৈনিক নিয়োগ দেন। বেশ মোটা রকমের অর্থের বিনিময়েই তাদেরকে ভাড়া করা হয়েছিল এবং শ্যুটিং শেষে দেখা গেল সে অর্থ মোটেও জলে যায় নি। সিনেমার যুদ্ধকে বরং সত্যিকারের যুদ্ধই বলে মনে হচ্ছে!

৮। পৃথ্বীরাজ কাপুর তার আকবর চরিত্রটির জন্য সর্বোচ্চটুকুই দিয়েছিলেন।
কে. আসিফ যখন পৃথ্বীরাজ কাপুরকে আকবর চরিত্রটি করার জন্য বলেন, কাপুর সাহেব তখন তার ক্যারিয়ারের শ্রেষ্ঠ সময় পার করছিলেন। কিন্তু আকবর চরিত্রটির কাজ হাতে নেওয়ার পরে তিনি পরিচালকের ভিশনের সাথে এতটাই গভীরভাবে মিশে যান যে ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৬০ সালের মাঝে তিনি আর কেবল মাত্র একটি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। ওয়েল, পেছন ফিরে তাকালে এখন মনে হয়না যে তিনি কোন ভুল করেছিলেন।

৯। শ্যুটিং করতে করতে আসিফকে অবসেশনে পেয়ে বসেছিল, মূল এডিটের আগে মোট নেগেটিভের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ মিলিয়ন ফিট!
আসিফ যখন পুরো সিনেমার কাজ শেষ করে এডিটিং টেবিলে বসেন, তখন তার সামনে মোট নেগেটিভের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩০ লক্ষ ফুট! আসিফ যেসব সিকোয়েন্স আর যতগুলো গান শ্যুট করেছিলেন, সিনেমার ১৯৭ মিনিটের মূল রানিং টাইমে সেই সবের অর্ধেকও কভার করেনি।

১০। তবলা মাস্টার জাকির হুসাইনকে যুবক সেলিম চরিত্রে নেয়ার জন্য বিবেচনা করা হয়েছিল।
বিষয়টা অবাক করার মত যে এক সময় উস্তাদ জাকির হুসাইনকে যুবক সেলিমের চরিত্রটি করার জন্য ভাবা হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত কাজটি আরেক তরুণ অভিনেতা জালাল আগা’র কাছে যায়। জালাল আগা পরবর্তীতে আরেক বিখ্যাত চলচিত্র ‘শোলে’তে অভিনয় করে পরিচত মুখ হয়ে উঠেন।

বলিউড ভবিষ্যতেও হয়ত যোধা-আকবর, বাজিরাও-মাস্তানির মত আরো অনেক হিস্টোরিক্যাল-রোমান্টিক মুভি বানাবে, কিন্তু তাদের কোনটারই আবেদন সেলিম-আনারকলি’র মত হবে না। এখনকার পরিচালকেরা যতই চেষ্টা করুন না কেন, তাদের প্রচেষ্টা কে. আসিফের দীর্ঘ ১৬ বছরের সাধনার সমান হবে না। সম্ভবত আর কেউই কখনো একটি মাত্র মুভি তৈরির জন্য এতটা প্যাশন দেখাতে পারবে না।