অবসরে পড়তে পারেন সেরা কিছু থ্রিলার বইয়ের কিছু সেরা অনুবাদ

দ্য সার্জন 
টেস গেরিটসেন

মেডিকেল জ্ঞানে দক্ষ, কিন্তু সাইকো এক লোক। রাতের বেলায় ঘুমন্ত অবস্থাতে আক্রমণ করছে মেয়েদের। কেবল মাত্র মেয়েদের। ভয়ঙ্কর এই খুনি এমনভাবে মেয়েদের শরীরে সার্জারি করে খুন করে যে, সবাই এই সাইকো’র নাম দিয়েছে – ‘সার্জন।’ হোমিসাইড ইউনিটের ডিটেকটিভ টমাস মুর আর তার পার্টনারের উপর এই রহস্য সমাধানের ভার পড়েছে। তারা এমন একটি বিষয় খুঁজে পেল, যা এই কেসটাকে অন্য এক জটিল রহস্যের নিয়ে যাচ্ছে। দুই বছর আগে, অন্য এক সিরিয়াল কিলার ঠিক একই পদ্ধতিতে তার শিকারদের হত্যা করতো। কিন্তু দুধর্ষ সেই খুনি নিজের শেষ শিকারের হাতে খুন হয়েছে সেই সময়টাতেই। সে মহিলা নিজেও একজন ট্রমা সার্জন। মহিলার সাথে এই খুনগুলোর কি সম্পর্ক ? এই ভয়ঙ্কর খুনীর হাত থেকে মুক্তির উপায় কী?

এই বইটার চ্যাপ্টারে চ্যাপ্টারে টুইস্ট। এত বড় বই! অথচ বই থেকে একবারের জন্যও মনোযোগ বিচ্যুত হবে না একবারো মনে হবে না এই অংশটুকু আমি জোর করে পড়ছি। একদম মেদহীন, খুঁতবিহীন ঝরঝরে থ্রিলার। পরিপূর্ণ। 
এটা এমন একটা অনুদিত থ্রিলার, যেটায় সত্যি সত্যিই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টান টান উত্তেজনায় আটকে রাখতে পেরেছে। বেশিরভাগ অনুবাদেই যেটা ব্যর্থ হয়। 
বইয়ের শেষটা পড়ে খুব খুব তৃপ্তি পেয়েছি।

ড্রেসডেন ফাইলস- স্টর্ম ফ্রন্ট
জিম বুচার

হ্যারি ড্রেসডেন শহরের একমাত্র জাদুকর গোয়েন্দা। যখনই পুলিশের হাতে এমন কেস আসে যেটার জট যুক্তি দিয়ে খোলা সম্ভব নয়, ডাক পড়ে তার। নিরীহ মানুষ অতিপ্রাকৃত শক্তির হাতে জিম্মি হয়ে পড়লেও ডাক পড়ে হ্যারির। নিজের পেশায় সে এক এবং অদ্বিতীয়। কিন্তু এই তুখোড় গোয়েন্দা কল্পনাও করেনি কোন মহাবিপদ ধেয়ে আসছে তার দিকে। জীবনের সবচেয়ে কঠিন কেসে জড়িয়ে পড়ে হ্যারি। অসম্ভব নিষ্ঠুর এবং বুদ্ধিমান এক শত্রুর মোকাবেলা করতে হয় তাকে। প্রতিবার দু-ধাপ পিছিয়ে থাকতে হচ্ছে, পরবর্তি আক্রমণ কোত্থেকে আসবে কিছুতেই আন্দাজ করা যাচ্ছে না। এই বিপদ থেকে কি হ্যারি বেঁচে ফিরতে পারবে?

উত্তম পুরুষে সবাই ভালো লিখতে পারে না। উত্তম পুরুষের বর্ণনাভঙ্গীটা এতোই বাস্তবিক যে আমি ভাবতে শুরু করেছি, এই বইয়ে যা যা ড্রেসডেনের সাথে হচ্ছে, তার সবই আমি নিজের সাথে ফেইস করছি। বাচনভঙ্গি খুব চমৎকার। অবশ্য এর পুরো ক্রেডিট অনুবাদকের।

ফ্যান্টাসি বলে ভেবে বসবেন না, এটা নেহায়েত বাচ্চাদের বই। জাদু দুনিয়ার অনেককিছুর চমৎকার বিশ্লেষন এটা। সেই সাথে মসৃণ কাহিনি। কোথাও হোঁচট খাবার উপায় নেই। 
একদম ঝরঝরে একটা বই। কাহিনীতে কোন মেদ নেই, কোন প্লট হোল নেই, কোন অসংগতি নেই। অন্তত আমার চোখে এগুলির কিছুই ধরা পড়েনি। 
অনুবাদ এতো ঝরঝরে যে মেইন বইয়ের চেয়ে অনুবাদ বেশি ভালো হয়েছে, এমন মন্তব্য করছেন সমালোচকরা।

স্যান্ডস্টর্ম (সিগমা ফোর্স #১)
জেমস রোলিন্স

কাহিনী সংক্ষেপঃ
লন্ডন মিউজিয়ামে প্রচন্ড এক বিস্ফোরণে এক ধনী মহিলার মূল্যবান সব সংগ্রহ উড়ে গেলো। কে করলো এই কাজ? কারা তার বাবার স্মৃতিচিহ্ন উড়িয়ে দিলো? কেমন করে এতো সিকিউরিটি ভেদ করে বিস্ফোরণ হলো সেখানে? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বের হলো লেডী কারা কেনসিংটন, সুন্দরী এবং তার বোনসম বান্ধবী, বিদূষী ড. সাফিয়া আল-মায়াজ। সেই সঙ্গে সাফিয়ার প্রাক্তন প্রেমিক, ওমাহা ডান। ওমাহা একজন নামকরা প্রত্নতাত্ত্বিক। তাদের সবার লক্ষ উবার শহর খুঁজে বের করা। সেটা করতে হলে অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে, অনেক ধাঁধার সমাধান করে, অনেক বিপদ মাড়িয়ে যেতে হবে। এর সব কিছু করতে পারলো তারা। প্রবেশ করল এমন এক শহরে যা কল্পনাকেও হার মানায়।
কিন্তু ওদের পিছু পিছু ধেয়ে এসেছে শত্রুরা। যাদের উদ্দেশ্য-সারা দুনিয়া জুড়ে বয়ে আনবে বিশৃংখলা। সেই সাথে আরব মরুভূমির বিপদ তো আছেই।
সবার লক্ষ্যই এক-এমন এক ক্ষমতার উৎস খুঁজে বের করা, যেটা দুনিয়াকে পরিণত করতে পারবে স্বর্গে অথবা ধ্বংস করে দেবে মানব সভ্যতাকে! এমন এক সময়ে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় তারা পৌঁছালো যখন মরুভূমি ধারণ করেছে করাল রূপ। ভয়াবহ বালুঝড়ে ঢেকে গেলো সব …

রোলিন্সের বই মানেই অন্য ধরনের কিছু। – এটা হলো রোলিন্স সম্পর্কে বহুল ব্যবহৃত বাক্য। ঠিক যেন বিজ্ঞানের সাথে ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্ম আর থ্রিলের অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ।

কী জীবন্ত বর্ণনা! মরুভূমির সূর্যাস্তের বর্ণনাটা – আমি যেন চোখের সামনে দেখছি! লাল সূর্য ডুবছে, আর বালিতে মরীচিকায় সূর্যের রিফ্লেক্সনটা, বালিঝড়ের ওই নীলাভ আলোটা একদম পরিস্কার দেখতে পেলাম। যে দৃশ্যটা জীবনে কখনো দেখিনি, সেটা চোখের সামনে একদম বাস্তবরূপে ফুটিয়ে তোলা কি চাট্টিখানি কথা?

কিছু কিছু ঘটনা এত আচমকা ঘটেছে যে পড়তে গিয়ে রক্ত ছলকে উঠেছে। 
বইটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। হৈ-হট্টগোলের মধ্যে কিংবা বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে এই বই পড়ে আরাম পাওয়া যাবে না।

রূপান্তর সত্যিই চমৎকার হয়েছে। বিশেষ করে কিছু কিছু ইংরেজি শব্দ, যেগুলির এক্সেক্ট বাংলা হয়না, সেসবের ব্যাখ্যা ব্র‍্যাকেটে লিখে দেওয়ার আইডিয়াটা বেশ ইউনিক। আর হেল্পফুলও। 
মোটকথা, এক বসায় পড়ে শেষ করার মতো বই।

দ্য আই অফ গড (সিগমা ফোর্স #৮)
জেমস রোলিন্স

স্যাটেলাইটের নাম আই অফ গড। ওটা বিধ্বস্ত হয়ে পড়ল মঙ্গোলিয়ায়। ওটায় ধারণকৃত ছবিতে দেখা গেল আমেরিকার তিনটি প্রধান শহর নিউ ইয়র্ক, বোস্টন, ওয়াশিংটন ডি.সি. আগুনে জ্বলছে। অথচ শহর তিনটির পরিস্থিতি স্বাভাবিক। তাহলে এই ছবি কি ভবিষ্যৎ বানী?
ভিগোর ভেরোনাকে মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা বই এবং তের শতাব্দীর অজ্ঞাত একজনের মাথার খুলি পাঠিয়েছেন অন্যদিকে ১০ বছর আগে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ফাদার জসিপ। ডিএনএ টেস্ট করে চমকে উঠলো। খুলির মালিক স্বয়ং চেঙ্গিস খান। খুলিটিতে লেখা: চার দিনের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে এই দুনিয়া।
একই দিনে দুনিয়ার দুই প্রান্তে ঘটলো এমন বিপরীতধর্মী দুইটি ঘটনা, যার ফলাফল একই। এবং ফলাফলটা ভয়াবহ। চারদিনে ধ্বংশ হয়ে যাবে পৃথিবী। সিগমার অভিজ্ঞ কয়েকজন সদস্য দুই দলে বিভক্ত হয়ে নেমে পড়লো মিশনে। একদলে রয়েছে পূর্বপরিচিত মঙ্ক, ফাদার ভিগোর, নবাগত জ্যাডা আর ডানকান। খবর পাওয়ার সাথে সাথেই দলটি নেমে পড়লো একশনে।
ওদেরকে একই সাথে খুঁজে বের করতে হবে আই অফ গডের ধ্বংসাবশেষ, আর সেই সাথে লুকিয়ে রাখা রেলিক (সংরক্ষিত স্মৃতিচিহ্ন। এই বইয়ে চেঙ্গিস খানের দেহের সং্রক্ষণ করা অংশাবশেষকে রেলিক বলা হয়েছে) গুলি। আবার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রেলিকে রাখা ধাঁধার সমাধান করতে হবে।

অপর দলে রয়েছে, কমান্ডার গ্রে, তার সঙ্গিনী সেইশান আর কমান্ডার কোয়াস্কসি। দ্বিতীয় দলের পৃথিবী বাঁচানোর মিশনে নামতে খানিকটা দেরি হয়ে গেল। কারণ ওই সময়টায় তাদের সেইশানের মাকে খুঁজতে এবং পরবর্তীতে বন্দী সেইশানকে উদ্ধার করতে উত্তর কোরিয়ায় ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল।
দুইদল একত্র হয়ে কঠিন আর দূর্গম পথ অতিক্রম করে দুর্যোগ আর বিপর্যয় মোকাবেলা করে চরম মুহূর্তটায় পৌঁছে গেল। কিন্তু সেখানেও তাদের জন্য দাঁড়িয়ে ছিল কঠিন বাঁধা। 
রোলিন্সের বইয়ে শেষটা কক্ষনো নির্বিঘ্নে শেষ হয় না। প্রাকৃতিক বৈরিতা, শত্রুপক্ষের আক্রমণ দুইটাই উপস্থিত থাকে লক্ষে পৌঁছুতে দেরি করানোর জন্য।

রোলিন্সের অন্যান্য বইয়ের মতো এটাতেও রয়েছে – ধর্ম, বিজ্ঞান, ইতিহাস, অ্যাডভেঞ্চার, একশন এর সবকিছুর পারফেক্ট সংমিশ্রণ।

এমন সব অস্থির বিষয় এক বইয়ে রাখার পরেও লেখক সাহেব থেমে যান না। একটু আধটু জীবনবোধও থাকে বইয়ে! যদিও খুব সূক্ষ, তবুও থাকে। উদাহরণ স্বরূপ আমি কয়েকটা লাইন বলতে পারি যেগুলি আমার খুবই ভালো লেগেছে –
“আমাদের নশ্বর শরীরের আয়ু অল্প। ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া একটি উপহার। এই উপহারকে অপচয় কোরো না, ভবিষ্যতে কাজে লাগাবে ভেবে আলমারিতে তুলে রেখো না, দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরো আর কাজে লাগাও।”
কী অসাধারণ জীবনবোধ!

পৃথিবীর আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা ইতিহাস, সংস্কৃতি আর থ্রিলকে সংমিশ্রিত করে একজন পশু চিকিৎসক আমায় পুরো পৃথিবী ঘুরিয়ে আনতে সক্ষম হচ্ছে! সেই অভিযান প্রচন্ড রোমাঞ্চকর এবং রহস্যে মোড়া। একমূহুর্ত রেস্ট করার কোন চান্স নেই।

সিগমাফোর্স সিরিজে সবচেয়ে ভালো লেগেছে যেই জিনিসটা, লেখক প্রতিটা বইয়েই শত্রু মিত্র দুই পক্ষেই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে মেয়েদের রাখছেন। আর সেই মেয়ে চরিত্রটাও হবে একদম কমপ্লিট প্যাকেজ। বুদ্ধিমতী, করিৎকর্মা, একরোখা। বিশেষ করে সিগমার চিরশত্রু গিল্ট’এর হয়ে কাজ করা মেয়েগুলি; স্যান্ডস্টর্মে ক্যাসান্দ্রা, দ্য জুডাস স্ট্রেইনে শেইচান – অসাম লাগে! 
তাই বলে সিগমার হয়ে কাজ করা মেয়েগুলি যে পিছিয়ে আছে, তাও নয়। তারাও অ-সা-ধা-র-ন!

সাবলীল অনুবাদে বইটা পড়তে বেশ ভালো লেগেছে। অনুবাদ পড়ে মনেই হয়নি, এটা অনুবাদকের প্রথম অনুবাদ।

দ্য নেকেড ফেইস
সিডনি শেলডন

একজন সাইকো অ্যানালিস্টের সাথে সম্পর্ক আছে এমন দুইজন একই দিনে খুন হয়ে গেল। সন্দেহের তীরটা পুলিশ তার দিকেই তাক করলো। কিন্তু পরের চ্যাপ্টারে বোঝা গেল, তার নিজের জীবনই বিপন্ন! কিন্তু বেচারা পুলিশকে কিছুতেই বোঝাতে পারছে না, সে দোষী নয়, বরং তাকেই খুন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। জীবন বাজি নিয়ে সে আসল খুনিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। একে সন্দেহ করছে, তাকে সন্দেহ করছে। সেই ডক্টরের সাথে সাথে আমিও একে তাকে সন্দেহ করছি। আবার নিজে পাগল হয়ে গেল কিনা, তাও ভাবছে। ওই সময়টায় আমারো মনে হলো, সত্যিই পাগল হয়ে যায়নি তো? নইলে পুলিশ এসে তার আততায়ীকে খুঁজতে গেলে, সব প্রমাণ উল্টোপাল্টা হয়ে যায় কেন? তার নিজের দিকেই আঙ্গুল উঠে কেন?

জোরালো সন্দেহ করবো, এমন কাউকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত রহস্য গল্পে যা হয়, এমন একজন এসবে যুক্ত থাকে, যাকে সন্দেহের আওতায় ফেলাই হয়নি!

প্রতি পেজেই টান টান উত্তেজনা ছিল। এক বসায় শেষ করে ফেলার মতো বই। তবে এই বইকে “বছরের সেরা রহস্যোপন্যাস” অ্যাখ্যা দেবার মতোও মনে হয়নাই। বইটা অবশ্যই খুব ভালো, কিন্তু যেমনভাবে বলা হয়েছে তেমনটা নয়।

অনীশদার অনুবাদ নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তিনি বহু আগে থেকেই একজন দক্ষ অনুবাদক।