পথশিশু : ব্যস্ত শহরের “নিত্য বিড়ম্বনা”? দায় তবে কার?

kay chornush for US state department

কত হবে ছেলেটার বয়স? পঁচিশ কিংবা ছাব্বিশ। ক্লান্ত কাঁধে সারাদিন ধরে বয়ে বেড়ানো ভার্সিটি ব্যাগ। সারাদিনের ছুটোছুটিতে সকালে পড়া শার্টের ইস্ত্রির ভাজগুলোও মলিন হয়ে গেছে। খুব ক্লান্ত কিন্তু হাসিখুশি মুখের ছেলেটি দাঁড়িয়ে ছিলো একটা টঙ দোকানের সামনে। হাতে ধরা ছিলো দুটো প্যাকেট – একটা কেকের আরেকটা বনরুটির। আর সেই যুবককে ঘিরে ছিলো কিছু ছোট ছোট বাচ্চাকাচ্চা, ময়লা হাফপ্যান্ট বা তার চেয়েও ময়লা গেঞ্জি পড়া!  এসব অপুষ্টিতে ভোগা ধুলো ময়লা মাখা বাচ্চাগুলোকে আমরা টোকাই বলি, অথবা কেউ কেউ বলি পথশিশু। বাচ্চাগুলো সব চিৎকার করে বলছিলো, এটা না ওটা! আর সেই যুবক তাদের ইচ্ছে মতই তাদেরকে কেক আর রুটি দিচ্ছিলো। আমি অনেক দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। সন্ধ্যার ক্ষীণ আলোতে, দ্রুতগতিতে নিজের আবাস পানে ছুটে চলা এই ব্যস্ত শহরে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর খুঁজে পাইনি সেদিন। পাশে দাঁড়ানো একজনকে জিজ্ঞাস করে জানলাম, ছেলেটি প্রায় প্রতিদিনই এভাবে এই পথে ঘুরতে থাকা বাচ্চাদের কিছু না কিছু কিনে খাওয়ায়। আর বাচ্চাগুলোও প্রতিদিন তার জন্য অপেক্ষা করে!

পথশিশু! পথে পথে ঘুরে বলেই আমরা তাদের এই নামে ডাকি। ব্যস্ত শহরে বসবাসরত এমন একজন মানুষও হয়তো পাওয়া যাবে না, যারা এদের মিনতির শিকার হয়নি! কখনও দুই টাকা দেওয়ার মিনতি, কখনও বা কারো হাতে থাকা খাবার খেতে দেওয়ার অনুরোধ। আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই এদের দেখে বিরক্ত হই। অফিস বা স্কুল কলেজে যাওয়ার তাড়াহুড়ায় এসব উটকো ঝামেলার মুখোমুখি হতে ইচ্ছে হয় না!

নগরীর ট্রাফিক সিগন্যাল বা বাণিজ্য মেলার প্রবেশমুখ, কিংবা বাস বা টেম্পু থামার জায়গায় অহরহ দেখা যায় এদের। বয়স হয়তো ২ বছর থেকে ১০ বছরের মধ্যে হয়। কেউ কেউ আবার কোলে করে নিজের এক বা দেড় বছর বয়সী ভাই বোনকে নিয়ে পথে নামে। উচ্চবিত্তদের দামি গাড়ির কাচের ফাঁক দিয়ে ওদের মিনতি পোঁছায় না, তাই সেখানে তাদের প্রাপ্তি প্রায় শূণ্য। তাই তারা মধ্যবিত্ত লোকাল গাড়িতে চড়া কিংবা রাস্তা দিয়ে হেটে যাওয়া মানুষগুলোর কাছেই হাত পাতে। কিন্তু মধ্যবিত্তদের সামর্থ্যই বা আর কতটুকু! একজনকে দিয়ে আরেকজনকে দিতে গেলে নিজের পকেটের হিসেব কষতে হয়!

সারা শরীরে ধুলো ময়লা বেষ্টিত বাচ্চাগুলো আদৌ কোনোদিন স্কুলে গিয়েছে কিনা কেউ জানে না। পরিবারের অন্নসংস্থানই তাদের জন্মের পর প্রধান দায়িত্ব হয়ে উঠে। আর তাই রাস্তার পাশে ধুলো পাথর নিয়ে খেলা এই বাচ্চাগুলো যখন মোড়ে কোনো গাড়ি থামতে দেখে বা ট্রাফিক সিগন্যাল এ গাড়ি গুলো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে,  দৌড়ে যায়। কখনও পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া কোনো পুরুষের শার্ট বা নারীর ওড়না ধরে মিনতি জানায়। আর আমরা পরিষ্কার কাপড় পড়া মানুষগুলো, নিজেদের পরিপাটি জামা নোংরা করে দেওয়ার জন্য কড়া ভাষায় তাদের ধমক দেই। খুব চিৎকার দিয়ে বলে উঠি ” সর! “

খুব স্বাভাবিকভাবেই আমরা এসব বাচ্চাদের তুই বলে সম্বোধন করি! কেন? তারা নোংরা বলে? নাকি তারা সমাজের নিচু স্তর বলে? কিন্তু নিজের ঘরের বাচ্চাটির সামনে আমরা কখনই তুই শব্দটা মুখেই আনি না, বাজে কথা শিখবে বলে! তবে এসব দরিদ্র শিশুদের প্রতি কেন এমন আচরণ? এরাও ভালো ব্যবহার পাওয়ার অধিকার রাখে। আর এটা তো আমাদের নৈতিকতাবোধেই আসা উচিত।  কিন্তু আমরা কেন জানি এটাকে নিয়ম বানিয়ে ফেলেছি যে, এদের সাথে এইভাবেই কথা বলতে হবে!

ব্যক্তিগতভাবে আমি এমন কিছু মানুষকে চিনি যারা এসব বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করেন। অবশ্য তাদের বেশিরভাগই আমার মতোই ছাত্রজীবন শেষ করেছে মাত্র বা চালিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করেই তারা এই কাজগুলো করছে। অন্য যারা সামর্থ্যবান, তাদের কাছ থেকে তেমন একটা সাহায্য পায় না! জিজ্ঞাস করছিলাম, কেন? উত্তরে তারা বললো, সবাই মনে করে এসব ভুয়া! সাহায্যের নামে টাকা নিয়ে নিজেরাই খরচ করে! তাই কেউ সাহায্য দিতে চায় না!

প্রায় প্রতিদিন ফেসবুকে বন্ধুদের বিভিন্ন দামী রেস্টুরেন্টে চেক ইন বা খাবার খাওয়ার ছবি আপলোড হতে দেখি। অনেকেই পুরো খবার খেতে না পেয়ে খাবার নষ্ট করে রেখে আসি। আর পরবর্তীতে সেই বেঁচে যাওয়া খাবারগুলোর স্থান হয় ডাস্টবিনে! আমরা কি পারি না সেই বেঁচে যাওয়া খাবারগুলো পার্সেল করে এনে এইসব পথ শিশুদের দিয়ে দিতে? অনেকের কাছেই সংকোচ হয়, এভাবে খাবার পার্সেল করে দিতে বলতে। কিন্তু এর বিনিময়ে কোনো এক অভুক্ত শিশুর খাদ্যসংস্থান হবে, সেই আনন্দ কি কোনো অংশে কম?

সমাজের এই পথশিশুগুলোর দায়িত্ব আমাদের কারো একার পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়, একথা সত্য। উন্নয়নশীল এই দেশে আমরা আমাদের নিজেদের কপাল ঘষতেই দিন শেষ, তাই সমাজসেবা করার সাধ থাকলেও সাধ্য থাকে না। কিন্তু কিছু ব্যাপার টাকার অংকে মাপা সম্ভব নয়। অন্তত একটু ভালো ব্যবহার তো করায় যায়। তাচ্ছিল্য না হয় নাই বা করলাম। দারিদ্রতা ওদের জন্মসাথী, কিন্তু আমাদের দুর্ব্যবহারকে কেন ওদের সইতে হবে?

সেদিনের সেই তরুণ বা সেই অভুক্ত বাচ্চাগুলোর মধ্যে কেউই ফেসবুকের ছবি আপলোড দেওয়ায় ব্যস্ত ছিলো না, কিংবা কেউ চেক ইন দিচ্ছিলো না। রেস্টুরেন্ট এর দামি ফ্রাইড রাইস বা ব্রোস্ট চিকেন নয় বরং তাদের আনন্দের উৎস ছিলো কিছু বনরুটি আর কেক। কিন্তু তাদের মধ্যে যে আনন্দ ছিলো,  তা ফেসবুকের হাজারখানেক লাইক বা কমেন্টের চেয়ে কম ছিলো না। সত্য তো এটাই, সন্তুষ্টি কখনও লোক দেখানো বিষয় নয়, বরং সেটা পুরোপুরি নিজস্ব একটা ব্যাপার মাত্র…..