ডায়েরি অফ এ লোনলি ট্রাভেলার: দূর্গাসাগর দীঘি, রাণী দূর্গাবতী ও অন্যান্য

গুগল

একটা গল্প বলি না হয় প্রথমে। ১৭শ’ সালের শেষের দিকের কথা। বরিশালের বর্তমান মাধবপাশা অঞ্চল, সূদুর অতীতে যা ছিল চন্দ্রদ্বীপ নামে পরিচিত। এখানকারই খুব সুন্দর, গাছপালা ছায়া ঢাকা একটা গ্রাম। ঠিক যেভাবে আমরা গল্পের বইয়ে পড়ে থাকি; অনেকটা সেরকম। বরিশালে জালের মত নদ-নদী ছিটিয়ে থাকলেও এই অঞ্চলে সুপেয় পানির অভাব ছিল। সাল ১৭৮০। রাজা জয় নারায়ণ এই অঞ্চলের রাজা। তিনি প্রজাদের পানির কষ্ট নিয়ে পড়লেন মহা বিপাকে। কি করা যায়? পানি তো লাগবেই। খাবার পানি ছাড়া মানুষ বাচঁবে কি করে! রানীমা দূর্গাবতী এই সংকটময় পরিস্থিতে ঠিক দেবী দূর্গা মত দশভুজা হয়ে যেন আবির্ভূত হলেন। প্রজাদের কষ্ট দেখে রানীর মন হা হা করে ওঠে। মায়ের নির্দেশেই রাজা জয় নারায়ণ এখানে একটি বিশাল দীঘি খনন করেন। মায়ের নামেই এই দীঘির নামকরণ করা হয়, ‘দূর্গাসাগর। দীঘিটি স্থানীয় ভাবে মাধবপাশা দীঘি নামেও পরিচিত। কথিত আছে যে, কোন এক ভরা চাঁদনী রাতে রানী দূর্গাবতী এই দীঘিতেই আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। যদিও এই কিংবদন্তীর কোন সত্যতা নেই। লোকের মুখে মুখে ছড়ানো গল্প। এই দীঘি শুধু বরিশাল এরই নয়, পুরো দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় দীঘি বটে।

লেখিকা নিজেই যখন বেরিয়ে পড়েছেন ভ্রমণে… ক্লিক!

প্রায় ২৫০০ হেক্টর এলাকা জুড়ে ছড়ানো এই দীঘি বরিশাল হতে ১১ কিমি দূরে বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধব পাশা গ্রাম হতে একটু অদূরেই অবস্থিত। পূব ও পশ্চিম দিকে এটির দুটো গেট আছে। একটার নাম আব্দুর রব সেরনিয়াবাত গেট, অন্যটি হল শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক গেট। বরিশালের দুইজন বিখ্যাত রাজনীতিবিদের নামে নাম এই প্রবেশপথ গুলোর। দীঘির মাঝখানে দ্বীপের মত একটা উঁচু জায়গা আছে। নারিকেল সহ অন্যান্য গাছে সেই জায়গা পরিপূর্ণ। শীতকালে এখানে পাখি দেখা যায়। শুরুতে এই দীঘিতে চারদিকে চারটি ঘাট ছিল। প্রবেশমুখে লাগানো বোর্ড এও চার ঘাটের কথা উল্লেখ করা। কিন্তু এখন আপাতত তিনটি ঘাট আছে। যার একটি ব্যতীত বাকি সবগুলোই ব্যবহার অযোগ্য। ঘাটগুলো লম্বায় প্রায় ১৫ মিটার। দীঘির পানিও এখন আর স্বচ্ছ নেই তেমন। জায়গায় জায়গায় কচুরিপানা, শাপলা-শালুকের বাসস্থান। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে এটা আর তেমন কি! বিশাল দীঘি, জীর্ণ ঘাট আর গাছপালা। কিন্তু এই একটা দীঘি আপনাকে অভিভূত করে দেবে যদি আপনি খানিকটা প্রকৃতি প্রেমিক হন। বরিশাল এসে শহরের কোলাহল থেকে বেরিয়ে যদি দুদণ্ড গাছপালা ঘেরা কোন নির্জন জায়গায় ঘুরে আসতে চান, তাহলে দূরগাসাগর একটা ভাল স্থান। এখানে একটা পিকনিক স্পটও আছে। ছুটির দিনে লোকজন পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসে। আসে আশেপাশের জায়গা হতে আসে চড়ুইভাতিতেও। খুব কাছেই আছে গুঠিয়া মসজিদ; মাত্র আধাঘণ্টা দূরত্বে। হাতে যদি ঘোরাঘুরি করার জন্য পুরোটা দিন থাকে তাহলে এক ফাঁকে এই অনিন্দ্য সুন্দর মসজিদটিও দেখে নিতে পারেন।

এখন প্রশ্ন হল, কিভাবে যাবেন? যাওয়া খুব সহজ। আপনি বরিশাল যদি চলেই যান, আর আপনার হাতে সময় থাকে আর সেই সাথে থাকে বরিশালকে অনুভব করার ইচ্ছা; তাহলে হালকা স্ন্যাক আর পানির বোতল ব্যাগে নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। বরিশাল শহরের নথুল্লাবাদ বাস স্টপেজ হতে সরাসরি বাসে যেতে পারেন অথবা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে ও যেতে পারেন (১৩০/১৪০ ঘন্টা প্রতি)। ৪০ মিনিট হতে বেশি হলে ১ ঘন্টা লাগবে। দুধারের গাছপালা আর গ্রামীণ পরিবেশ দেখতে দেখতে যেতে আপনার চোখ যে জুড়িয়ে যাবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন। প্রবেশ পথ হতে ঢুকতে টিকিট কেটে ঢুকতে হবে; জনপ্রতি ১০ টাকা। আশেপাশে কিছু ছোট দোকান আছে, ভিতরের দিকে আছে ফুচকার দোকান। মন চাইলে হালকা টক-ঝাল ফুচকা খেয়েদেখতে পারেন।

গুগল

প্রতিবছর বরিশালের হিন্দু সম্প্রদায় এই দীঘির প্রাঙ্গনে “আস্তানি স্নান” নামক এক ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করেন। এখানে তারা বিভিন্ন ধর্মীয় আলোচনা, আচারেও অংশ নেন। এখানে ছোট একটা পার্ক এর মতন ও আছে। আরো আছে হাঁটা পথ পুরো দীঘির চারিপাশ ঘিরে। চাইলে পুরো এলাকা আপনি হেঁটেও দেখতে পারেন। ইটবিছানো এই ছোট রাস্তাটা খুব সুন্দর আর শান্ত। হঠাৎ হঠাৎ পথের পাশে শান বাঁধানো বেঞ্চি চোখে পড়বে। চাইলে কিছুক্ষণ বসে আর শুধু পানির দিকে তাকিয়ে থেকে আশেপাশের সবুজকে অনুভব করার চেষ্টা পারেন।

কথা শেষ করব কিছু অভিযোগ নিয়ে। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এর অভাবে এর অবশিষ্ট ঘাটগুলিও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, দেখার কেউ নেই। ১৯৭৫ সালে বরিশাল উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ  এখানকার কিছু সংস্কার করেছিল। কিন্তু দেখভালের অভাবে এই জায়গা আবারো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, এত বিশাল একটা দীঘি; কিন্তু এই পানির ওপরে ঘোরার জন্য কোন নৌকা নেই। আপনাকে দেখতে চাইলে শুধু পুরোটা পায়ে হেটেই দেখতে হবে। উপযুক্ত কতৃপক্ষ যদি তাদের দৃষ্টি এই দিকে ফেরান তাহলে এটা হতে পারে বরিশাল বিভাগ এর অন্যতম আকর্ষণ।

বরিশাল যখন ঘুরতে যাবেন, তখন আপনার ভ্রমণ তালিকার অবশ্য দ্রষ্টব্য জায়গাসমূহের মধ্যে রানী দূর্গাবতীর স্মৃতি বিজড়িত এই দূর্গাসাগর দীঘিকে রাখতে ভুলবেন না কিন্ত। অনেক ঝা চকচকে কিছু দেখার বাসনা নিয়ে গেলে হতোদ্যম হয়ে ফিরে আসতে পারেন। তবে, শুধু প্রকৃতি দেখার জন্য এটা খুব ভাল একটা অপশন হতে পারে।

লেখিকা সম্পর্কেঃ নাহিদ জাহান মুনা । ডাক্তারি পড়তে গিয়ে পলিটিক্স পড়তে চলে এসেছি এবং অত্যন্ত সৌভাগ্যের সাথে ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক’ নামক একটা ভয়াবহ রসকষহীন সাবজেক্ট থেকে পোস্টগ্রাজুয়েশন শেষ করে ফেলেছি। বই পড়া, মুভি দেখা, ঘুরাঘুরি করা ভাল লাগে। বই পড়তে পড়তে বাসায় একটা ছোটখাটো লাইব্রেরি বানিয়ে ফেলেছি। লেখার অভ্যাস কখনোই ছিল না। তারপরও শুরু করে ফেলেছি সাহস করে।