দুইদিন আগেই ঈদ উদযাপন- টাইগারদের ক্যাঙ্গারু বধ; মহাকাব্যের নাম বাংলাদেশ ক্রিকেট!

dhবারবার বিভিন্ন ইস্যুতে নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে বারবার বাংলাদেশ সফর এড়িয়ে যাচ্ছিল অজিরা। অবশেষে কয়েক দফায় সিকিউরিটি চেক-রিচেক করে বাংলাদেশে এলো ওরা। প্রায় এগারো বছর পর মাঠে গড়ালো বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়ার স্বপ্নের টেস্ট।

টেস্টে টস বরাবরই উত্তেজনাকর৷ অভিজ্ঞতা, কন্ডিশন, পিচ, একাদশের কথা বিবেচনা করলে এই ফরমেটে সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট হলো টস৷ অধিনায়ক মুশফিক যখন টস জিতে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নিল, তখন মোটেও অবাক হইনি৷ আগেই কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল, খেলা হবে টার্নিং উইকেটে৷ পেসারদের জন্য যাই থাকুক না কেন, অন্তত স্পিনারদের স্বর্গই হবে৷ আমরা পরে দেখেছি- দিনের প্রথম সেশনে পেসাররা খানিকটা দাপট দেখালেও দ্বিতীয় এবং শেষ সেশনে স্পিনাররাই ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দখলে রেখেছিল৷ ফলে এই পিচে চতুর্থ ইনিংস তো দূরে থাক, তৃতীয় ইনিংসেই রীতিমতো যুদ্ধ করতে হবে ব্যাটসম্যানদের৷ উপরন্ত এই ফরমেটে চেজ করে জেতার অভিজ্ঞতা খুবই কম৷ শেষ হোম সিরিজে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্টের কথা মনে পড়ে৷ ওয়ানডে সিরিজের ধারাবাহিক দলটি চতুর্থ ইনিংসে জয়ের খুব কাছে গিয়েও বন্দরে ভিড়তে পারেনি৷ সেটা অভিজ্ঞতার খানিকটা ঘাটতিই বলা চলে৷ কিন্তু পরের টেস্টে মিরাজ-সাকিবরা ঠিকই প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে দিয়েছিল৷ তাই সব বিবেচনা করলে স্বভাবতই কোচ, ক্যাপ্টেন চাইবেন চতুর্থ ইনিংস এড়াতে৷ এতে ভাবনার কিছু নেই৷

মিরপুরের আকাশে ঝলমলে রোদ৷ গ্যালারিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দর্শকেরা৷
দিনের শুরুতে তামিম-সৌম্য জুটি রোপ পেরিয়ে মাঠে ঢুকে গেল৷ প্রথম টেস্টের আগে স্কোয়াড ঘোষণা নিয়ে বিস্তর হইচই হয়েছে৷ মমিনুল, মাহমুদউল্লাহকে বাইরে রেখে অনভিজ্ঞ সাব্বির সৌম্য কতটা উপযোগী- সে প্রশ্নের উত্তর দিতে তোপের মুখে পড়তে হয়েছে খোদ হাতুড়া সিংহেকে৷ কিন্তু আমার মনে হয়- তার ভেতর বিশেষ একটা পরিকল্পনা ছিল৷ টার্নিং উইকেটে স্পিনের বিপক্ষে ব্যাটসম্যানরা সলিডলি সার্ভাইভ করতে চাইলে, সেটা খুব একটা ভালো সিদ্ধান্ত হবে না৷ এখানে টিকে থাকার পাশাপাশি দ্রুত রান তুলতে হবে৷ সে বিবেচনায় সাব্বির সৌম্য ভালো চয়েজ৷ ওদের লিটল ক্যামিও ইনিংসগুলো সত্যিই উপকারি৷ কিন্তু বলাই বাহুল্য, সাতসকালে সে আশায় গুঁড়েবালি৷ প্রথম তিন ওভার মাঠে গড়াতে না গড়াতেই তিন টপঅর্ডার ড্রেসিংরুমে৷ সৌম্য(৮), ইমরুল(১), আর সাব্বির তো রানের খাতাই খুলতেই পারেনি৷ জস হ্যাজউডের প্রথম ওভারটা ভালোই খেলল ওরা, শেষ বলে সৌম্য দারুন একটা কাভার ড্রাইভে চার বানিয়ে ফেলল৷ বিপত্তিটা ঘটল পেট কমিন্সকে খেলতে গিয়ে৷ পিচের হালকা মশ্চেয়ারে বল ভালোই মুভ করছিল৷ সেইরকম এক মুভিং ডেলিভারিটা ব্যাকফুটে খেলতে গিয়ে গালিতে তুলে দিল সৌম্য৷ কনিন্স তার দ্বিতীয় ওভারে এসে শেষ দুই বলে তুলে নিলেন ইমরুল, সাব্বিরকে৷ অফস্টাম্পের বাইরের বল তাড়া করতে যেয়ে ইমরুল, আর লেট সুইংয়ে পরাস্ত হলো মি. ক্যাটস আই৷ স্কোরবোর্ড যখন প্রথম সেশনেই অলআউট হবার ঘোষণা দিচ্ছিল, ঠিক তখনি ত্রাণকর্তা হিসেবে মাঠে নামল সাকিব৷ কার্যতঃ হয়ে উঠল ওপেনার৷ প্রথম দুই ওভারে মি. অলরাউন্ডারকে সত্যিই খুব সাবলিল মনে হচ্ছিল৷ উইকেটে বরাবরই তামিমের প্রিয় পার্টনার বন্ধু সাকিব৷ ক্যারিয়ারের সূচনালগ্ন থেকেই দুই বন্ধুতে মিলে কত দ্বৈরথ পাড়ি দিয়েছে৷ এবার তার সাথে আরেকটি অর্জন যুক্ত হলো৷ টি-ব্রেকে যাবার আগে দুই বন্ধুতে মিলে ১৫৫ রানের জুটি গড়েছিল৷ এরপর তামিম ব্যক্তিগত ৭৫ রানে ম্যাক্সওয়েলের ঘুর্ণির ফাঁদে পা দিলেও, সাকিব যেন তিন অংকের দিকেই এগোচ্ছিল৷ কিন্তু সে বিশ্বাস বেশিক্ষণ পোক্ত হয়নি৷ বন্ধুর পিছে পিছে সাকিবও ব্যক্তিগত ৮৪ রানে ড্রেসিংরুমের টিকিট পেলেন৷ 
সমস্ত দর্শক তখন মুশি- নাসিরের ওপর তাকিয়ে৷ এই জুটির শুরুটাও হয়েছিল দারুণ, কিন্তু শেষপর্যন্ত ধারাবাহিক হতে পারেনি৷ টি-ব্রেকের নামমাত্র রান যোগ করতে পেরেছিল ওরা৷ এরপরই লায়ন-আগারদের তোপের মুখে তাসের ঘরের মতো গুড়িয়ে যায় স্বাগতিকদের ইনিংস৷ শেষ বিকেলে খানিকটা বৃষ্টি কেবল অলআউট হওয়ার সময় কেবল দীর্ঘায়িতই করেছে৷ শেষপর্যন্ত মোট সংগ্রহ গিয়ে দাঁড়ায় ২৬০-এ৷

আমি বলব- এই পিচে প্রথম ইনিংসে এটা অতটা খারাপ টোটাল নয়৷ কোচ, ক্যাপ্টেনের মনে হয়তো আরো ৪০টি রানের আক্ষেপ ছিল, কিন্তু আমার ভেতর মিরাজ-সাকিব-মুস্তার ওপর তারচেয়ে বেশি ভরসা ছিল যেন৷ এবং তারা সেই ভরসার ষোলআনা প্রতিদান দিয়েছে৷ শেষ বিকেলে মিরপুরের দর্শকদের খানিকটা আক্ষেপের মাঝেও জ্বল জ্বল করছিল মিরাজ-সাকিবের জোড়া আঘাত৷ ডেভিড ওয়ার্নার(৮) পরাস্ত হয়েছে মিরাজের ঘুর্ণিতে।

নাইট ওয়াচম্যান হিসেবে নাথান লায়ন যখন নামছিলেন তখন আমি ফিরে গেলাম এগারো বছর আগে। নাথানও নিশ্চয়ই পূর্বের সুখস্মৃতি ভাবতে ভাবতে মাঠে যাচ্ছিলেন? আমার মতো তারও তো জ্যাসন গিলেস্পির কথা মনে থাকার কথা। বেচারা তো জানে না, এই বাংলাদেশ আর সেই বাংলাদেশ এক নয়। ২০০৬ এর পরে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। তাই জ্যাসন গিলেস্পির মতো ডাবল সেঞ্চুরির স্বপ্ন মনে চেপে রেখেই সাকিবের বলে ডাক মেরে ফিরতে হলো লায়নকে।

সফরকারীদের বিষফোঁড়া হিসেবে ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়ে উসমান খাজা হলেন রান আউট৷ স্কোরবোর্ড বলছে- অজিরা তখন ১৪ রানেই তিন উইকেট খুইয়েছে৷ শেষতক ক্যাপ্টেন স্মিথ এবং আরেক ওপেনার রেনশাও মিলে আর মাত্র ৪ রান যোগ করে হোটেলে ফিরেছে বটে, কিন্তু খুব একটা সুবিধেজনক অবস্থায় যে তারা নেই। এটা ভেবে ওয়ার্নারদের রাতের ঘুম হারাম যে হয়েছে, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না৷

বলা হয়- শেষ ভালো যার, সব ভালো তার৷ এই বাক্যটিই যেন দ্বিতীয় দিনের শুরুতে প্রমাণ হয়ে গেল৷ আগেরদিন বিকেলে সাকিব সংবাদ মাধ্যমে বলেছিল- কাল প্রথম সেশনে ভালো ক্রিকেট খেলতে হবে আমাদের৷ দ্রুত স্মিথকে ফেরাতে পারলে ওদের আটকানো সম্ভব৷

কথাটা কি ছোট ভাই মিরাজ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছিল? নইলে পরদিন উইকেটে স্মিথ থিতু হতে না হতেই মিরাজের ঘুর্ণিতে স্টাম্প ছত্রখান হয়ে যেত না বোধহয়৷ আগের দিনের ৩ উইকেটে ১৮ রান নিয়ে শুরু করা অজিদের স্কোরবোর্ডে দলীয় রান তখন মাত্র ২৪৷ ক্রিজে এলো হান্ডস্কম্ব৷ কদিন আগের ভারত সফরে জ্বলতে জ্বলতে জ্বলে ওঠেনি সে৷ তাই নির্বাচকদের আস্থার প্রতিদান দিতেই যেন তার উইকেটে আসা৷ রেনশাওকে সাথে নিয়ে এই জুটি লাঞ্চ ব্রেক পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেল৷ রাতে একজনকে বলছিলাম- সকালে প্রথম সেশনে ফিজকে কিছু করে দেখাতে হবে৷ কিন্তু সে আশায় জল ঢাললে সে৷ মাঝেমাঝে তাকে অ্যাটাকিংয়ে আনা হলেও কাটার বয় যেন তার চেনা রূপে ছিল না৷ এলোমেলো ডেলিভারিগুলো কেবল এই জুটির স্থায়িত্বকালই বাড়িয়েছে৷

অজিরা তখন মোটামুটি শ্বাস নেবার অবকাশ পাচ্ছে৷ কিন্তু লাঞ্চের পরপরই সাকিব তার রূপে ফিরে এলো৷ একেরপর এক ঘূর্ণিতে আজিদের ঘায়েল করল সে৷ লাঞ্চের পর বিপদজনক হয়ে উঠতে যাওয়া হান্ডস্কম্বকে এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে ফেলে আরেক বাঁহাতি তাইজুল৷ এরপর রেনশাও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি৷ ইনিংসের সর্বোচ্চ সংগ্রহক হিসেবে ব্যক্তিগত ৪৫ রান করে সৌম্যর হাতে সাকিবের শিকার হয় সে৷ এরপর দ্রুত ফিরে যায় ম্যাথু ওয়াইড, ভয়ংকর ম্যাক্সওয়েল৷ সাকিবের দুর্দান্ত এক টার্নিং ডেলিভারি ডাইনী দ্য গ্রাউন্ডে আসা ম্যাক্সি’র ব্যাট ফাঁকি দিয়ে উইকেটের পেছনে চলে যায়৷ দলীয় ১৪৩ রানে সপ্তম উইকেটের পতন টাইগার শিবিরে স্বস্তির বাতাস বইয়ে দিয়েছিল৷
কিন্তু নাটক তখনো শেষ হয়নি৷ অজিদের খানিকটা আশার আলো দেখাচ্ছিল আগার-কামিন্স জুটি৷ নবম উইকেটে এই দুজন মিলে বেশ কিছু রান যোগ করেন৷ ব্যক্তিগত ১২ রানে কামিন্সের সহজ ক্যাচ শফিউল ছেড়ে না দিলে বেশ লজ্জায় পড়তে হতো সফরকারীদের৷ চা বিরতির পর এই জুটি যখন আরেক টেলেন্ডার মার্ক গিলেস্পির পুরনো স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছিল, তখনি জোড়া আঘাত হানে সাকিব৷ আরেক রেকর্ডে নিজেকে যুক্ত করল সে৷ ইতিহাসের পঞ্চম বোলার হিসেবে টপ নাইন টেস্ট প্লেয়িং দেশের বিপক্ষেই ইনিংসে পাঁচ উইকেট নেয়ার গৌরব অর্জন৷

প্রথম ইনিংসে অজিদের দলীয় রান ২১৭৷ সর্বসাকুল্যে ৪৩ রানের লিড নিয়ে তামিম-সৌম্য জুটি দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করল৷ মন বলছিল- সৌম্যকে নিয়ে এইবার একটা বাজি ধরা যায়৷ ওর দ্রুত একটা ক্যামিও স্বাগতিকদের স্বস্তিদায়ক পর্যায়ে পৌঁছে দেবে৷ শুরুটা ভালোই বলা চলে৷ তামিমের যোগ্য সঙ্গী হিসেবেই এগিয়ে যাচ্ছিল৷সে৷ কিন্তু সেই পুরনো ভুল, দিনের মাত্র ১১ বল বাকী থাকতে অ্যাস্টন আগারকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে খাজার হাতে বন্দি হলো সে৷ ১ উইকেটে দলীয় ৪৪রান, আর ৭৭ রানের লিড নিয়ে হোটেলে ফেরে মুশিরা৷ গলায় বড় সংগ্রহের সুর৷ হাতুরা শিষ্যদের ফুরফুরে মেজাজই বলে দিচ্ছিল- কালকের দিনে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি হাতে থাকলেও তারা অবাক হবে না৷

এক বন্ধুকে বলেছিলাম- এই টেস্ট সাড়ে তিন দিনেই শেষ হবে দেখিস৷ দুদিনেই পিচের যা কন্ডিশন, তাতে ব্যাটসম্যানরা আউট হবার চিন্তা মাথায় নিয়েই উইকেটে আসবে৷ এবং সেকথা যেন তৃতীয় দিনের শুরুতেই ফলে গেল৷ আগের দিনের ৪৪ রান স্কোরবোর্ডে নিয়ে মাঠে নামল স্বাগতিকরা৷ তামিমের সাথে নাইট ওয়াচম্যান তাইজুল৷ শুরুটা হলো স্বস্তিদায়ক৷ তামিমের চওড়া ব্যাটের কাছে সুবিধে করতে পারল না কমিন্স-হাজলউজড৷ ফলত স্মিথ দিনের পঞ্চম ওভারেই লায়নের হাতে বল তুলে দেন৷ তাইজুল যেন যমের মুখে পড়ল৷ লায়নের একেকটা ঘুর্ণি যেন বারুদ হয়ে তার অভিমুখে ধেয়ে আসছিল৷ কখনো অস্বাভাবিক বাউন্স, কখনো বিপদজনক টার্ন, সাথে গতি- পুরো দিনটা যে টাইগারের জন্য সে এক বিভীষিকার নাম হবে, তা যেন দিনের শুরুতেই জানান দিয়েছে৷ নন স্ট্রাইকে থাকা তামিম বারবার তাইজুলকে সতর্ক করেও শেষরক্ষা হলো না৷ ব্যক্তিগত ৪ রানে লায়নের শিকার হলো সে৷

এরপরের দৃশ্য খানিকটা অবাক করার মতো৷ পিচে এলো খোদ ক্যাপ্টেন মুশি৷ অফ ব্রেক বলের সামনে বাঁহাতি ব্যাটসমানরা তেমন সুবিধে করতে পারছে না ভেবেই হয়তো সাকিবকে রেখে মুশিই এসেছে হাল ধরতে৷ ধরলেনও শক্ত হাতে৷ ওপেনার তামিমকে নিয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দই মনে হচ্ছিল মি. ডিপেন্ডেবলকে৷ লাঞ্চের আগপর্যন্ত দুজন অবিচ্ছিন্নই থাকল।

তীব্র রোদে মিরপুরের হোম অফ ক্রিকেট তখন ঝলসে যাচ্ছে৷ তাঁতিয়ে উঠেছে পিচ৷ সেই তাঁতানো পিচে হুটহাট বল বাউন্স করছে৷ মুশি-তামিমে ভর করে স্বাগতিকরা যখন বড় সংগ্রহের স্বপ্ন দেখছে, তখনি চা বিরতির আগে হুট করেই অ্যাটাকে আসে কমিন্স৷ গুড লেন্থ থেকে একটা ডেলিভারি আচমকা তামিমের বুক বরাবর ধেয়ে আসল৷ কোমর বাঁকিয়ে বলটাতে যাবার জায়গা করেও দিয়েছিল সে৷ কিন্তু সময়মতো হাতটা সরাতে পারেনি৷ জোরালো আপিলে আম্পায়ার সাড়া দিল না৷ স্মিথ রিভিউ চাইল, দেখা গেল- বলটা তামিমের বুক পার হবার আগে গ্লাভসে খানিকটা ঘষা দিয়ে এসেছে৷ ব্যক্তিগত ৭৮ রানে তামিম ফিরে গেল৷ এরপর সাকিবও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি৷ আগের ইনিংসের ত্রাণকর্তা এইবার সৌম্য’র পথ অনুসরণ করল৷ নাথান লায়নের বলে এগিয়ে এসে মারতে গিয়ে কভারে তালুবন্দি হয় সে৷ একটা বাউন্ডারির বাইরে আর কোন রান তার ব্যাট থেকে আসেনি৷
মুশি তখন সাব্বিরকে নিয়ে একটা সুবিধাজনক জায়গায় দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে৷ লিড বাড়ছে হু হু করে৷ মোটামুটি তিনশো প্লাসই আশা করছে সবাই৷ ঠিক তখনি অপ্রত্যাশিত সেই সেই দূর্ঘটনাটা ঘটে গেল৷ সাব্বিরের সজোরে মারা বলটা ধেয়ে এলো টপ অফ দ্য উইকেটে৷ বোলার হাত বাড়িয়েই রেখেছিল৷ হাত ছুঁয়ে সেটা বোলার এন্ডের স্টাম্পে গিয়ে লাগল৷ দেখা গেল- মুশফিক পরিষ্কার উইকেটের বাইরে৷ শুরু হলো ধ্বস৷ এরপর একে একে সাব্বির, নাসিরও দ্রুত ফিরে গেল৷ শেষদিকে মিরাজ শফিউলকে নিয়ে ছোট্ট একটা জুটি গড়েছে বটে, কিন্তু তা প্রয়েজনের তুলনায় অপ্রতুল৷ চা-বিরতির পর বেশিক্ষণ আর উইকেটে থাকতে পারেনি তারা৷ ২২১ রানে গুটিয়ে যায় টাইগার বাহিনী৷ সফরকারীদের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ২৬৫৷
পিচের যা হাল, তাতে তারাও খুব একটা স্বস্তিতে নেই৷ উপরন্ত সাব কন্টিনেন্টে অজিরা ইতিপূর্বে এত রান চেজ করে জেতেনি কখনো৷ সদ্য শেষ হওয়া ভারত সিরিজের খবর যারা রেখেছেন, তারা জানেন৷

জেতেনি, কিন্তু যে অসম্ভব- তা তো নয়৷ সেই মন্ত্রই যেন বুকে নিয়ে চতুর্থ ইনিংস শুরু করল ওয়ার্নাররা৷ স্টার্টিংটা মন্দও হলো না৷ ২৮ রানের ওপেনিং জুটি ভাঙল মিরাজ৷ অফ স্টাম্পের বাইরে পিচিং হওয়া ডেলিভারিটা যে আর্ম বল ছিল, সেটা বুঝতে পারেনি রেন’শ৷ যেমন বুঝতে পারেনি উসমান খাজাও৷ উইকেটে সুইপ ছাড়া খেলবার কিছু নেই ভেবে হাঁটু গেড়ে সাকিবকে স্কয়ার লেগে পাঠাতে চাইল৷ কিন্তু ব্যাটের কোণায় লেগে সার্কেলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা তাইজুলের হাতে স্বচ্ছন্দে গিয়েই পৌঁছানোর আগেই মিরপুরের দর্শকরা আরেকবার আকাশ ছুঁলো৷

https://www.youtube.com/watch?v=kr5LNN6CCGY

উইকেট পেলে সাকিবকে এভাবে বন্য উদযাপন করতে খুব কমই দেখেছি

এরপর পরের গল্পটা যেন স্মিথ-ওয়ার্নার মিলে নিজ হাতে লিখে গেল৷ দু’একটা সহজ সুযোগ তৈরি হলো বটে, কিন্তু ভাগ্যদেবী প্রসন্ন হয়নি আর৷ ৮৭ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়ে অজিরা শুধু জয়ের পথ সুগমই করেনি, পতিপক্ষকে বিশ্বাস করাতে বাধ্য করেছিল যে, তাদের আর করার কিছু নেই৷

রাতে হোটেলে শুয়ে শুয়ে ফোন করল সাকিব৷ ওপাশে নিজের স্ত্রী৷
সাকিব বলল, ‘মনে হয় না জিততে পারব৷’
একই ছাদের তলা থাকাতে নিজের জীবনসঙ্গীকে খানিকটা চেনেন বৈকি! ওপাশ থেকে শিশির বলল, ‘এই অবস্থা থেকেও ম্যাচ ফেরাতে পারে কে, জানো?’
সাকিব উৎকন্ঠিত৷ ‘কে পারে?’
‘তুমি৷’

____এটা একটা সামান্য ঘটনা৷ কাছের মানুষগুলো সবসময়ই মোটিভেশনাল কথাবার্তা বলে থাকে৷ কিন্তু তাই বলে সেটাই যে পরদিন সকালে সত্যি সত্যি ইতিহাস হয়ে যাবে, সেটা কি স্বয়ং সাকিব নিজেও ভেবেছিল? নিজের প্রতি বিশ্বাসটা হয়তো ছিল, কিন্তু চাপটাও নেহাত কম নয়৷

চতুর্থ দিন৷ ঝকঝক করছে সকাল৷ কিন্তু দর্শকদের মনে কালো মেঘ৷ অজিদের দুই সারথী ক্রমেই ভয়ংকর হয়ে উঠছিল৷ আগের দিনের ১০৯ রানের সাথে যোগ করল আরো ৪৭ রান৷ এরমধ্যে স্মিথের সহজ এক ক্যাচ ছাড়ল তামিম৷ ওয়ার্নার তুলে নিল ম্যাচের একমাত্র সেঞ্চুরি৷ ম্যাচ যখন অনেকটা নাগালের বাইরেই চলে গেছে, তখন বন্ধু তামিমের সাফাই গাইতেই যেন ওয়ার্নারকে তুলে নিল সাকিব৷ স্টাম্প বরাবর বলটি খানিকটা নিচু হয়েছিল, নইলে পুল করা ওয়ার্নারের ব্যাট ফাঁকি দেওয়া অত সহজ ছিল না৷ ১১২ রানের ঝলমলে ইনিংসটি অজি ওপেনার নিশ্চয়ই বাঁধিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু তার সাথে মিশে গেল এক দুঃস্বপ্ন, যখন সাকিবের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ফিরে গেলেন ক্যাপ্টেন স্মিথ৷ ততক্ষণে মিরপুর যেন প্রাণ ফিরে পেল৷ পঞ্চম উইকেটের পতন অজিদের। ম্যাচ থেকে খানিকটা সরিয়ে দিয়েছে৷ তখনো শত রানের অপেক্ষা৷ উইকেটে তখন হ্যান্ডসকম্ব, ম্যাক্সওয়েল৷ পিচের আচরন বলছে- খেলা তৃতীয় সেশন পর্যন্ত গড়ালে আর রক্ষে থাকবে না৷ তাই ব্যাটে খানিকটা তাড়া তো ছিলই৷ হ্যান্ডস্কম্ব উইকেটে নড়েচড়ে খেলছিল৷ মাঝেমাঝে দু’একটা বাউন্ডারি হাঁকাচ্ছিল তারা৷ কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি, তাইজুলের বলে সৌম্যর হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে গেছে সে৷ স্বাগতিকরা তখন আরো চেপে ধরেছে৷ সাকিব-তাইজুল জুটি দুদিক থেকেই দারুণ চাপ সৃষ্টি করেছিল৷ সে চাপের মুখে ম্যাথু ওয়াইডও বেশিক্ষণ টেকেনি৷ ব্যক্তিগত ৪ রানেই তাকে ফেরান সেই সাকিবই৷ সপ্তম উইকেট পড়ে গেল৷
অজিরা তখন বন্দর থেকে মাত্র ৬৩ রান দূরে৷ ম্যাক্সওয়েল কমিন্সকে নিয়ে লাঞ্চে গেল ঠিকই, কিন্তু ভেতর থেকে খচখচানি যায়নি৷ ম্যাক্সওয়েল তখন আরেক অস্বস্তির নাম৷ অস্ট্রেলিয়ান এই হার্ড হিটার যে যেকোন সময় ভোল পাল্টাতে পারে, তা তো অজানা নয়৷

নিজের ভোল পাল্টালো না বটে, কিন্তু বিরতির পর সাকিব প্রথম যে ডেলিভারিটি ম্যাক্সওয়েলকে করেছিল, সেটা পুরো ম্যাচেরই ভোল পাল্টে দিল৷ খানিকটা লো হয়ে স্টাম্পে ঢুকল যে বল, তাতে গতি ছিল বেশ ভালোই৷ ম্যাক্সি ব্যাকফুটে যেতেই অফ স্টাম্পে আঘাত করল বলটি৷ সাকিব ম্যাচে দ্বিতীয়বার ৫উইকেট নিল৷ স্বাগতিকদের জয় তখন হাতের কাছে৷ এরপর কামিন্স-লায়ন-হাজলউড মিলে জোর চেষ্টা চালিয়ে গেছে৷ শেষদিকে মিরাজকে খানিকটা চার্জও করেছিল কিন্তু সেটা কার্যকর হয়নি৷ মাত্র ২০ রান দূরে থেমে গেল অজিরা৷ শেষ দুই উইকেট তুলে নিয়েছে যথাক্রমে মিরাজ, তাইজুল৷

এবং!
এবং আমরা আমাদের বহু আকাঙখিত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্ট ম্যাচটা জিতে নিয়েছি! আম্পায়ার যখন কামিন্সের উইকেটের এলবিডাব্লিউর আবেদনে সাড়া দিয়ে আঙ্গুলটা তুলে দিয়েছে, আমি আইসা এক লাফ মেরেছি! আর পর মূহুর্তেই আমার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছিল। এমন মিশ্র অনুভূতি কেবল মাত্র বাংলাদেশ জিতলেই মেবি পাওয়া যায়!

  বাংলাদেশকে প্রশংসায় ভাসিয়ে ক্রিকেটের মহারথিদের টুইট

ম্যাচ হেরে অজিদের হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য, আভিজাত্য এর কি হাল হলো?! এত দিনের অহমবোধ!! স্যরি অস্ট্রেলিয়া! মাঠের বাইরের নিরাপত্তা আমরা দিতে পারলেও মাঠের ভিতরের নিরাপত্তা কী করে দেব? হেরে নিশ্চয়ই বলছ, স্পিনিং পিচ, আনস্পোর্টিং উইকেট এইসব হাস্যকর অজুহাত? তোমাদের সবুজ ঘাসের পিচ আমাদের জন্য আনস্পোর্টিং না হলে সাবকন্টিনেন্টের স্পিনিং পিচও আনস্পোর্টিং না।

ম্যাচশেষে প্রেজেন্টেশন সিরিমনিতে সাকিব আমাদের এই বিশাল সমর্থকবাহিনীকেও ধন্যবাদ জানিয়েছে। বিরতিতে সাকিব নাকি বলেছিল, সমর্থকেরা আমাদের উপর বিশ্বাস রেখে মাঠে এসেছে। আমাদেরও উচিৎ সেই বিশ্বাসে ভর করে ম্যাচটা জেতা!
এবং আমরা জিতেছি!

https://www.youtube.com/watch?v=DARrOGYczz0

ড্রেসিং রুমে টাইগারদের অদ্ভুত আনন্দ প্রকাশ

তবে, কিছু ব্যাপার না বললেই নয়। হাতুড়ু কি বুঝতে পারছেন না যে সৌম্য এবং সাব্বির টেস্ট প্লেয়ার নয়। এদের টেস্ট খেলার যোগ্যতা নাই। এদের মানসিক অবস্থা টেস্ট প্লেয়ারের না। এদের টেস্টে নেওয়া মানে এদের ওয়ানডে-টি২০ ক্যারিয়ার নষ্ট করা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিজের দায়িত্ব টা পালন করা। তাইজুলের ৪(২২) বলের ইনিংসকে সৌম্যের ১৫ রানের চেয়েও অনেক এগিয়ে রাখা যায়। কারণ তার দায়িত্বটা সে পালন করছে। সৌম্য – সাব্বির পরের ম্যাচে ২০০ করলেও আমি তাদের দলে নেয়ার পক্ষে নেই। কারণ তার টেস্টের ব্যাটসম্যান না। এরচেয়ে ২৮ গড়ের সাম্প্রতিক মমিনুল অনেক অনেক বেটার।
ওয়ানডে-টি২০ মেজাজের প্লেয়ারদের টেস্টে নেয়। ওদিকে মমিনুল, নাইম ইসলাম এবং শাহরিয়ার নাফীসরা বসে থাকে। অথচ দেখা যাবে নেক্সট টেস্টে বলির পাঠা হবে ইমরুল কায়েস। কিন্তু ইমরুল আরোও সুযোগ ডেজার্ভ করে। এগুলো কে বোঝাবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের “ওয়ান ম্যান আর্মি” হাতুড়েসিংহকে?

একটা দলের টপ ৩ জন ব্যাটসম্যান যদি এমন হয় তাহলে কিভাবে সেই দল ধারাবাহিক হবে? বাংলাদেশের ইতিহাসে টপ ৩ এর এমন নোংরা খেলা আর দেখি নাই।
বাম হাতি আর ডান হাতির ব্যাটিং কম্বিনেশন কতো ইম্পোর্ট্যান্ট, সেটা গতকাল তামিম-মুশফিক পার্টনারশিপ থেকে বুঝা যাচ্ছিল। সাব্বিরের পরিবর্তে মমিনুল থাকলে ব্যাটিং অর্ডারে বামহাতি ব্যাটস্ম্যান থাকতো ৫ টা। এটা কেউ বুঝবে? কে কারে বোঝাবে?

কমেন্ট্রির ব্যাপারে কিছু বলি।

অজি স্পিনার নাথানের একটি বল খেলতে মুশফিকুর রহিম তার ডান পা কিছুটা এগিয়ে নিয়ে ওয়াইডের দাগের প্রায় সোজাসুজি গিয়ে বলটি ডিফেন্স করার চেষ্টা করলেন।কিন্তু বলটি সরাসরি গিয়ে লাগল তার ডান পায়ে। বুঝতেই পারছেন, স্টাম্প থেকে বহু দূরের ওয়াইডের দাগের প্রায় সোজাসুজি থাকা ডান পায়ে স্লো টার্নের বল লাগলে আর যাই হোক না কেনো, LBW এর আবেদন করাটা ঠিক মানানসই হয়না। কিন্তু অজি প্লেয়াররা LBW আউটের জন্য সমস্বরে চেঁচিয়ে সেই বেমানান কাজটাই করলেন।

অজি প্লেয়ারদের সমর্থনে এগিয়ে এলেন ধারাভাষ্যকার Ed Rainsford.
“Woah, A massive shout for LBW. Really optimistic.”

এবার রেইন্সফোর্ডকে ঠিক ১৮০ ডিগ্রি কোণে সরাসরি ডিফেন্ড করে বসলেন আমাদের মেহরাব।

“No, Absolutely not. This shout hasn’t contact with the reality I think.”

মেহরাবের এমন ট্রলিং এবং লজিক্যাল কমেন্ট্রি শুনে Rainsford যারপরনাই চুপসে যান। লিয়নের ঠিক পরের বলটাতেই ১১ রানে থাকা মুশফিক ছয় হাঁকানোর পর বেচারা Rainsford কিছুক্ষণের জন্য কমেন্ট্রি বক্স ছেড়েই চলে আসেন।

মেহরাবের হিউমার বেশ অনেক ভালো। আশা করি মেহরাবকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিসিবি অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। আমাদের উচিৎ মেহরাব-নাফিসদের সুযোগ করে দেওয়ার। সময় তো এখন বদলাবার।

সবশেষে, আমার ঈদ উদযাপন হয়ে গেছে আজই। আপনার?