১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস : অন্ধত্ব এড়াতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন

wdd2016.pngএবার (২০১৬) বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস এ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে চোখের চিকিৎসার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যার ক্ষতিকর প্রভাব বহুমাত্রিক। ডায়াবেটিস শরীরের বিভিন্ন অংশের ক্ষতি করতে পারে। যেমন: চোখ। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে না থাকলে এবং  সময়মত চিকিৎসা করা না গেলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তি অন্ধ হয়ে যেতে পারেন। বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আইডিএফ এর তথ্য মতে, ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪১৫ মিলিয়ন ব্যক্তি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ লোক ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। বর্তমানে ৩৯ মিলিয়নের অধিক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তি চোখের নানা রোগে আক্রান্ত। তাই এখনই সকলকে এ বিষয়ে সচেতন করা লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

ডায়াবেটিস জনিত চোখের বিভিন্ন রোগ

১. ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি:

ডায়াবেটিসজনিত চোখের একটি ভয়ঙ্কর রোগের নাম হলো ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি। ‘ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি’ হচ্ছে ডায়াবেটিসের কারণে চোখের ‘রেটিনার অসুখ’। রক্তে অতিরিক্ত শর্করার কারণে চোখের রেটিনার রক্তনালি সরু হয়ে যায়। ফলে  চোখে রক্তপাত, প্রদাহ, পানি জমা ইত্যাদি নানা সমস্যা দেখা দেয়। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে রোগীর দৃষ্টিহীন হওয়ার সম্ভাবনা  থাকে।

এর লক্ষণসমূহ:

  • এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ধীরে ধীরে দৃষ্টি কমে যায়।
  • রেটিনা সরে আসার কারণে দৃষ্টি সীমানার যে কোন পাশ কালো দেখা যেতে পারে।
  • রেটিনাতে পানি জমে ফুলে যেতে পারে, ফলে  দৃষ্টি ঝাপসা হতে পারে।
  • চোখের চাপ বেড়ে গিয়ে ব্যথা হতে পারে।

২. নন- প্রলিফেরিটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি

অনিয়ন্ত্রিত বা অনেকদিনের নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস রোগীদের রেটিনার রক্তনালিগুলো জায়গায় জায়গায় গাছের ছাল ওঠার মতো ছাল উঠে যায়। আবার কোনো কোনো জায়গায় গা পুরু হয়ে যায়। যে সব জায়গার ছাল উঠে যায়, সেসব দুর্বল জায়গা থেকে বিন্দু বিন্দু আকারে রেটিনার উপর রক্ত, চর্বি ইত্যাদি জমতে থাকে। এই অবস্থাকে নন- প্রলিফেরিটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি বলে।

৩. প্রলিফেরিটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি

রেটিনার যে সমস্ত জায়গার ঘা পুরু হতে থাকে, একসময় সেসব জায়গার রক্তনালির ছিদ্র বন্ধ হয়ে যায় যার কারণে  রক্ত সরবরাহ বাড়ানোর জন্য দ্রুত নতুন রক্তনালি তৈরি হয়। এভাবে তাড়াতাড়ি নতুন রক্তনালি তৈরি হওয়ায় রক্তনালিগুলো পরিপূর্ণ বিকশিত হয় না। ফলে হঠাৎ করে রক্তনালিগুলো ফেটে গিয়ে চোখের মধ্যে রক্তপাত ঘটায়। এই অবস্থাকে প্রলিফেরিটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি বলে। এর ফলে মানুষ সাময়িক দৃষ্টি হারিয়ে ফেলে। ।

৪. চোখের পাওয়ারে পরিবর্তন

ডায়াবেটিস যদি নিয়ন্ত্রিত না থাকে, তখন গ্লুকোজ চোখের লেন্সে চলে আসতে পারে তখন লেন্সটা মাইনাস পাওয়ারের দিকে চলে যায়। আবার যখন ডায়াবেটিস বেশি নিয়ন্ত্রনে থাকে , তখন লেন্সটা পাতলা হয়ে যেতে পারে। তখন লেন্সটা প্লাসের দিকে চলে যায়। একই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির ডায়াবেটিস যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে, দিনের বিভিন্ন সময়ে চোখের পাওয়ারের পরিবর্তন ঘটতে থাকে।

৫. ডায়াবেটিস জনিত ছানি:

চোখের স্বচ্ছ লেন্সের ভেতর দিয়ে আলো প্রবাহিত হয়ে রেটিনায় দৃষ্টির অনুভূতি তৈরী করে। আলোর এই প্রভাবের জন্যে লেন্সের স্বচ্ছতা অত্যন্ত  জরুরী।  ডায়াবেটিস রোগের কারণে স্বচ্ছ লেন্সের ভেতরে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি পায় বলে লেন্স ফুলে অস্বচ্ছ হয়ে  যায়, তখন দৃষ্টি কমে যায়। আস্তে আস্তে এই অস্বচ্ছতা বা ছানির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং রোগী ক্রমাগত দুষ্টিহীন হয়ে পড়ে।

৬. গ্লুকোমা

ডায়াবেটিক রোগীদের চোখের চাপ বেড়ে গিয়ে গ্লুকোমা রোগ হতে পারে। প্রাইমারী গ্লুকোমাতে ডায়াবেটিস হল

একটি রিস্ক ফ্যাক্টর। বহুদিনের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এর কারণে চোখে রক্ত স্বল্পতা দেখা দেয়। যা হতে চোখে প্রদাহ, রক্তপাত এবং পরবর্তীতে চোখের অভ্যন্তরীন চাপ বেড়ে গ্লুকোমা রোগ হতে পারে।

৭. ডিপ্লোপিয়া বা ডাবল ভিশন

ডিপ্লোপিয়া বা ডাবল ভিশন হচ্ছে মূলত একটি ইমেজের দুইটি প্রতিবিম্ব দেখা। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারনে চোখের এক বা একাধিক মাংসপেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে এক চোখে বা অনেক সময় দুই চোখে ডাবল ভিশন হতে পারে।

৮. মাকুলার ইডিমা

মাকুলা হচ্ছে চোখের রেটিনার অন্যতম প্রধান অংশ যা চোখের দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে। ডায়াবেটিক মাকুলোপ্যাথি রেটিনার এই মাকুলার অংশকে ক্ষতি করে যা মাকুলার ইডিমা নামে পরিচিত। এই রোগের কারনে রেটিনার ক্ষয় দেখা দেয় এবং মাকুলা অংশে ক্ষতের সৃষ্টি হয়।

ডায়াবেটিস জনিত চোখের রোগের প্রতিকার

  • অবশ্যই ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
  • ডায়াবেটিসজনিত ছানি হলে তা অপসারণ করা এবং কৃত্রিম লেন্স প্রতিস্থাপন করে অনেকাংশের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়া সম্ভব হয়। তবে রেটিনাতে সমস্যা থাকে, তাহলে দৃষ্টি পুরোপুরিভাবে ফিরে নাও আসতে পারে।
  • রেটিনোপ্যাথির পরিমাণ খুবই সামান্য যদি হয় তাহলে কোন চিকিৎসার প্রয়োজন পড়েনা।
  • যদি রেটিনায় পানি জমে ফুলে যায়, সেক্ষেত্রে এনজিওগ্রামের মাধ্যমে সমস্যাযুক্ত রক্তনালী চিহ্নিত করে লেজার চিকিৎসার মাধ্যমে ওই রক্তনালীর রক্তপাত বন্ধ করা যায়
  • ডায়াবেটিক ম্যাকুলোপ্যাথির চিকিৎসায় (১) চোখের ভেতর স্টেরয়েড জাতীয় ইঞ্জেকশন দিয়ে (২) লেসার রশ্মির মাধ্যমে এবং  (৩) লেসার রশ্মি কাজ না করলে ভিট্রেকটমি অপারেশন করা হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই এর ফলাফল ক্ষণস্থায়ী।
  • ডায়াবেটিক রোগী নিয়মিতভাবে চোখ পরীক্ষা করালে, সময়মতো চিকিৎসা করা গেলে রোগ নির্ণয় সহজ হয় এবং অন্ধত্ব থেকে চোখকে রক্ষা করা যায়।

চোখ ভালো রাখার প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা:

১. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখা

ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের  চেখের বিভিন্ন রোগের প্রধান কারণ যেহেতু ডায়াবেটিস,তাই ডায়াবেটিসকে সুনিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে। রক্তে কোলেস্টেরল বেশি থাকলে ঔষধের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তাহলে এই ডায়াবেটিসের কারনে চোখের সূক্ষ্ম রক্তনালিগুলোর ওপরে কোন প্রভাব ফেলবে না। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মানুবর্তী জীবনযাপন করতে হবে।

২. সুষম খাদ্যের ব্যবস্থা

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য সুষম পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার পরিমিত আকারে খেতে হবে। একসঙ্গে অনেকটা না খেয়ে কিছুক্ষণ পর পর অল্প পরিমাণে খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। আঁশ জাতীয় খাবার বেশী পরিমানে, প্রক্রিয়াজাত খাবারের পরিবর্তে পরিমিত মাত্রায় ভুসিযুক্ত রুটি এবং লাল চালের ভাত খাওয়া অভ্যাস করতে হবে। চর্বি ছাড়া মাংস, মাছ, বাদাম, বিভিন্ন ধরনের ডাল এবং কম মিষ্টিযুক্ত মৌসুমি ফল খাওয়া উচিত।

৩. প্রারম্ভিক রোগ সনাক্তকরণ এবং সময়মত চিকিৎসা

ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি স্থায়ীভাবে রেটিনার ক্ষতি করে এবং অন্ধত্বের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাই রেটিনা ক্ষয় প্রাাথমিক পর্যায়ে সময়মত রোগ নির্ণয় করা এবং নিয়মিত চোখ পরীক্ষা অপরিহার্য । প্রথমেই সময়মত চিকিৎসা করা গেলে চোখকে ভবিষ্যতের অন্ধত্ব হতে রক্ষা করা যায় এবং চোখের দৃষ্টিশক্তিও ফিরিয়ে আনা যায়।

৪. ডায়াবেটিস আক্রান্তদের চক্ষু বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ:

ডায়বেটিস আক্রান্তদের নিয়মিত চোখের চেকআপ করাতে হবে। ডায়াবেটিস হলে  মেনে নিতেই হবে যে, এটির কারনে চোখ আক্রান্ত হতে পারে। সুতরাং একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে চোখ নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করাতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় চোখের চিকিৎসকদের মধ্যে যারা রেটিনা বিশেষজ্ঞ, তাদের দিয়ে রেটিনা চেকআপ করানো, যে রেটিনাতে কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা। ডায়াবেটিসের অবস্থার ওপর নির্ভর করে এই চেকআপ করাতে হবে।

 (৫) পারিবারিক ও সামাজিক সহায়তা

পারিবারিক ও সামাজিক সহায়তায় একজন ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তি ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রনে রাখা এবং ডায়াবেটিস জনিত চোখের নান সমস্যা মোকাবেলা সহজে করতে পারেন।  সমাজের অবস্থানকারী বিভিন্ন ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ ও স্বাস্থ্য বিষয়ক আলোচনার মাধ্যমে ডায়াবেটিস এবং ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলাসমূহ প্রতিরোধে সচেতন হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।

 

ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য চোখ এক অপিরহার্য অঙ্গ। তাই চেখের যত্ন নেয়া খুবই প্রয়োজন। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির সময়মত চিকিৎসা না করলে এর নিশ্চিত পরিণতি অন্ধত্ব। তাই ডায়াবেটিস বিষয়ে সচেতন হোন। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে সমাজের বোঝা নয় দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক হিসেবে যথাযথ ভূমিকা রাখুন।